অনুভবের যৎসামান্য (১২)

‘তাহাদের’ চোখের ভাষা

বাজারে যাই, যেতেই হয়– কাঁচাবাজারের কথা বলছি – দেখেশুনে নিজের পছন্দমতো জিনিসপত্র কেনার বাতিক আছে আমার, সেজন্য নিজেই বাজার করতে পছন্দ করি। কিন্তু যতবার যাই ততবার নানা কারণে আমার মন খারাপ হয়ে যায়। তার মধ্যে কিছু কারণ একেবারেই অদ্ভুত। জিনিসপত্রের আকাশচুম্বি দাম, সীমিত আয়ের মানুষদের দুর্দশাগ্রস্ত-ক্লান্ত-বিপন্ন-অসহায় মুখ, কিংবা নিজের সামর্থ্যের মধ্যে স্বজনদের পাতে তুলে দেবার মতো ভালো মানের খাদ্যবস্তু কিনতে না পারার অক্ষমতা– এসব কারণে তো বটেই, কিন্তু কিছু অদ্ভুত কারণেও আমার মন খারাপ হয়। এই দুই মন খারাপের ধরন আলাদা।

বাজার তো বাজারই। হাজারও জিনিসের পসরা এবং সেগুলোর মধ্যে মাছ-হাঁস-মুরগি-কবুতর-কোয়েল-গরু-ছাগল-ভেড়ার মতো জীবগুলোও একেকটা খাদ্যবস্তুই। একেকটা প্রাণ, একেকটা খাদ্যবস্তু! আমি নিরামিষভোজী নই, আমিষ আমিও খাই এবং খাবার জন্য মাছ-মাংস কিনে আনি, তবু ওদের জন্য মন খারাপ হয় আমার। কী অদ্ভুত বৈপরীত্য আমার ভেতরে!

মোরগ/মুরগি কিনতে গেলে দেখি, খাঁচার মধ্যে ঠাসাঠাসি করে বন্দি করে রাখা হয়েছে ওদেরকে। ক্রেতা-বিক্রেতার দরদাম শেষে একেকটা মুরগি চলে যাচ্ছে ছুরির নিচে, প্রাণ হারিয়ে মুহূর্তে পরিণত হচ্ছে খাদ্যবস্তুতে। একজনের মৃত্যুর সময় অন্যরা তাকিয়ে দেখছে, নিশ্চয়ই নিজেদের অনিবার্য পরিণতিও বুঝতে পারছে, তবু পালাবার উপায় নেই। ব্রয়লারের মুরগিগুলো, ফার্মের মুরগি নামেই যারা অধিক পরিচিত, এমনিতেই কৃত্রিম উপায়ে বড় করে তোলা হয়; ওষুধপত্র খাওয়ানো হয়, এন্টিবায়োটিক দেওয়া হয়, খাবারও দেওয়া হয় ওষুধ মেশানো। অতিদ্রুত তাদের মাংসপেশিগুলো ফুলে ওঠে, কিন্তু হাড় থাকে নরম। জন্মানোর দু-তিন মাসের মধ্যেই ওদের ওজন হয়ে যায় স্বাভাবিকমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। বন্দি ঘরে জন্ম ওদের, ওখানেই দু-তিন মাসের আয়ুষ্কাল, তারপর বাজারের খাঁচায়, অবশেষে মানুষের পাতে খাদ্যবস্তু হয়ে জীবনাবসান। পাখির জাত হয়েও জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এক মুহূর্তের জন্যও স্বাধীন জীবন পায় না ওরা। আমি, অনিচ্ছাসত্ত্বেও, ওই খাঁচাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। ওদের অভিব্যক্তি বোঝার চেষ্টা করি।

মনে হয়, ওদের ছোট্ট নিরীহ চোখে বিষণ্ণতা কিংবা প্রশ্ন। যেন জিজ্ঞেস করে– আমাদের অপরাধটা কী? দেশি মুরগিগুলো যদিও খানিকটা শক্তিশালী, জন্মাবার পর কিছুদিনের স্বাধীন জীবন পায় ওরা, প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘুরেফিরে বেড়াবার সুযোগ পায়, তবু শেষ পর্যন্ত ওই খাঁচাবন্দিই, ওই মানুষের খাদ্যবস্তুই, পালাবার উপায় নেই। দোকানিরা যখন ওদেরকে ধরে এনে টিপেটুপে ক্রেতাকে দেখায় কিংবা জবাই করার জন্য নিয়ে যায় তখন তাদের ডাকগুলো শুনেছেন কখনো? যদি শুনে থাকেন, আর্তচিৎকার বলে মনে হয়নি? আমার তো মনে হয়েছে। কখনো কখনো ইচ্ছে হয়, খাঁচাগুলো খুলে দিই। কিন্তু লাভ কী? পালাতে তো পারবে না। ফার্মের মুরগিগুলোর শরীরে তো দৌড়োবার শক্তিই নেই, জন্ম থেকেই বন্দি বলে ওরা দৌড়াতেও শেখেনি, দেশি মুরগিগুলো দৌড়াতে পারে বটে, কিন্তু আগ্রাসী মানুষের থাবা থেকে পালানো? সে এক অসম্ভব ব্যাপার।

আবার জলে ভেসে বেড়ানো হাঁস, আকাশে উড়ে বেড়ানো কবুতর কিংবা কোয়েলও জবাই হবার অপেক্ষায় বসে থাকে নিরুপায়। কবুতর বা কোয়েলগুলো আবার খুব ছোট, উড়তেও শেখেনি, জন্মানোর কয়েকদিন পরই নিয়ে আসা হয়েছে মানুষের খাবার প্লেটে ওদের নরম তুলতুলে মাংস তুলে দেবার অভিপ্রায়ে। মাত্র কয়েক দিনের জীবন তাদের; অথচ ধরে আনা না হলে, উড়বার স্বাধীনতা পেলে, প্রাকৃতিক জীবন পেলে হয়তো আয়ু হতো পাঁচ বছর বা পঁচিশ বছর। ওটাই ওদের স্বাভাবিক আয়ুসীমা, ওদের পূর্ণাঙ্গ জীবনকাল। কেন ওদেরকে পূর্ণ জীবন যাপন করতে দেওয়া হলো না? এই যে কয়েক দিনের পাখিজীবন, এই জীবনের অর্থ কী? কেনই-বা তাদেরকে পৃথিবীতে নিয়ে আসা হয়েছিল, কেনই-বা একবারের জন্যও আকাশে ওড়ার স্বাধীনতা না দিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে বাধ্য করা হলো? এই প্রশ্ন আমি কাকে করি? মানুষ যে নিরাকার-নিখুঁত-সর্বজ্ঞ-সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কল্পনা করে, সে তো চির নীরব, চির নিরুত্তর। এই প্রশ্নের উত্তর তো সে দেবে না।

হাঁস-মুরগি-কোয়েল-কবুতরের অভিব্যক্তি খুব নিবিড়ভাবে লক্ষ না করলে বোঝা যায় না, মৃত্যুর আগে ওদের আর্তচিৎকারও দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কিন্তু গরু-ছাগল-ভেড়াদের অভিব্যক্তি তীব্র অনুভূতিময়। বাজারে সারি সারি মাংসের দোকান। আর দোকানের আশেপাশেই জীবন্ত গরু-ছাগল-ভেড়াদের বেঁধে রাখা হয়। জীবিতদের সামনেই জবাই করা হয় যেকোনো একটিকে। চামড়া ছাড়িয়ে তাদের শরীরের বিভিন্ন অংশ ঝুলিয়ে দেওয়া হয় ক্রেতাদের লোভনীয় দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। আর এই পুরো প্রক্রিয়াটি জীবিত প্রাণীগুলো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। যেটি এইমাত্র মরলো বা মরতে বাধ্য হলো, সে কিন্তু মরতে চায়নি।  চিৎকার, গোঙানি আর ছটফট করে বাঁচতে চেয়েছে। আর তার সহযাত্রী-সহমর্মী প্রাণীগুলো এই দৃশ্য দেখে ভয়ে-আতঙ্কে দিশেহারা। ছুটে পালানোর খুব চেষ্টা করে ওরা। পারে না। ওদের চোখের দিকে তাকানো যায় না। সেই চোখগুলোতে ভয়, অসহায়ত্ব, শঙ্কা আর করুণ বেদনা। কারো কারো চোখে জল, কাঁদছে! 

এ কেমন জীবন? এই জীবগুলোকে কেন পাঠানো হলো, কেনই-বা তারা পোষ মানলো মানুষের? না মানলেও তো পারতো! অজস্র পশু এবং পাখি পোষ না মেনে চলে গেছে বনের গভীরে, মানুষ থেকে দূরে, এরা যায়নি কেন? গেলে তো মানুষের সহজ শিকারে পরিণত হতো না। অবশ্য তাই বা বলি কীভাবে? মাছ তো পোষ মানেনি, জলাশয় ছেড়ে এসে মানুষের পায়ে পায়ে ঘোরেনি, তবু কি রক্ষা পেয়েছে? শিকারের নেশা মানুষকে নদী বা সাগরের গভীরেও নিয়ে গেছে তো! বাজারে সারি সারি দোকানে হাজার হাজার মাছ। মৃত মাছের চোখও খোলাই থাকে, ওরা অন্য জীবদের মতো নয়, মৃত্যুর পর চোখ বন্ধ হয়ে যায় না ওদের। সেই চোখের দিকে তাকালে মনে হয়, ওদের চোখে অপার বিস্ময় আর প্রশ্ন– কেন আমাদেরকে ধরে আনা হলো? আমরা তো মানুষের কোনো ক্ষতি করিনি! আমাদের অপরাধ কী? 

অবশ্য মানুষের দোষ দিয়েই বা লাভ কী? প্রকৃতির প্রাণীজগত জুড়েই চলছে এই খাওয়া-দাওয়ার পর্ব। অরণ্যের গভীরে বাঘ-সিংহ-নেকড়ের মতো হিংস্র প্রাণীগুলো খাচ্ছে হরিণ বা নীল গাইয়ের মতো নিরীহ প্রাণীদের। জলাশয়ে বড় মাছগুলো খাচ্ছে ছোট মাছদের। জীবন্ত শামুক-ঝিনুকগুলোকে মহাআনন্দে খাচ্ছে হাঁসেরা, পড়ে থাকছে খোলসটুকু। পাখিরা খাচ্ছে পোকামাকড়, কীটপতঙ্গদের। বৃক্ষরা কারো কোনো ক্ষতি না করেও খাদ্যে পরিণত হচ্ছে মানুষ ও অন্য প্রাণীদের। এইরকম কত কি! একে অন্যকে খেয়েই বেঁচে আছে জগতের সকল প্রাণী। এক অদ্ভুত খাদ্য-শৃঙ্খল বা ফুড চেইনে আটকে গেছে তারা। মানুষও তাই। এসবই বুঝি। 

অবশ্য অন্য প্রাণীদের সঙ্গে মানুষের একটা পার্থক্যও আছে। অন্যরা উদরপূর্তি হয়ে গেলে বাড়তি হত্যা করে না, খাদ্য সঞ্চয়ের ব্যাপার ওদের মধ্যে নেই। মানুষ তা করে। নিরাপত্তাহীনতার কথা ভেবে করে। প্রকৃতিতে মানুষই বোধহয় সবচেয়ে অসহায় প্রাণী, কারণ সে সবসময় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। খাদ্যের নিরাপত্তা, বাসস্থানের নিরাপত্তা, পোশাকের নিরাপত্তা, বেঁচে থাকার নিরাপত্তা। কত কিছু তাদেরকে ভাবতে হয়! তাদের সমস্ত কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় ওই একটি অনুভূতিকে কেন্দ্র করেই – নিরাপত্তাহীনতা! অন্য প্রাণীরা প্রকৃতির কাছেই ছেড়ে দেয় নিজেদের নিরাপত্তার ভার। প্রকৃতির সিদ্ধান্ত তারা মেনেও নেয়। মানুষ নিতে চায় না। এসবই বুঝি। তবু কেন মনে হয়, আমি ওইসব নিরীহ-অসহায়-বন্দি প্রাণীদের চোখের ভাষা পড়তে পারি? কেন আমার মনে হয়, ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করছে– কেন হত্যা করছো আমাদের, আমাদের অপরাধটা কী? আমি ওদের বলতে পারি না, তোমরা কোনো অপরাধ করোনি, অপরাধী আমরাই। নিজেদের খাদ্য-নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা তোমাদেরকেও খাদ্যবস্তুতে পরিণত করেছি। বিকল্প কিছু নিশ্চয়ই হতে পারতো, আমরা সে চেষ্টাই করিনি। 

যে কোন অসহায় মানুষের চোখের ভাষার অনুবাদ করা যায় না। ছবি: সংগৃহীত

অবশ্য কেবল খাওয়ার জন্যই নয়, কেবল বাজারেও নয়, সর্বত্রই চলছে জীব হত্যার উৎসব। বিনা কারণে হত্যাকাণ্ড তো কম ঘটে না। কিছু না ভেবেই কত মশা-মাছি-পোকামাকড় মেরে ফেলেছি থাপ্পড় মেরে! পায়ের নিচে চাপা পড়ে মারা গেছে কত পিঁপড়া, কত কীটপতঙ্গ! শস্য বাচাতেও কি হত্যা করিনি ওদের? শস্য প্রকৃতিরই দান, মানুষের চেষ্টাই শেষ কথা নয়, প্রকৃতি সদয় না হলে শস্য ফলে না। সেই শস্যে তো কীটপতঙ্গ-পশুপাখিরও অধিকার আছে প্রাকৃতিকভাবেই। এসব জেনেও মানতে চাইনি। খাদ্য সংস্থানকে যদি প্রয়োজন হিসেবে মেনেও নিই, তবু হিসাব মেলে না। কত প্রজাপতি, কত ফড়িঙ, কত মাকড়শা, কত টিকটিকি, কত তেলেপোকা যে মারা পড়েছে স্রেফ বিনা কারণেই, তার তো হিসেব নেই। সেসব হত্যাকাণ্ডের কথা ভেবে নিজেকে রীতিমতো খুনী বলে মনে হয়। বুঝে-না-বুঝে যাদেরকে হত্যা করেছি তারা কি কখনো ক্ষমা করবে আমাকে?

এসব ভাবতে ভাবতেই মানুষের মুখের দিকে তাকাই, তাদের চোখের ভাষা পড়তে চেষ্টা করি। দেখি সেখানেও ওই একই প্রশ্ন উৎকীর্ণ হয়ে আছে– কী আমাদের অপরাধ, কেন আমাদের এক জটিল জীবনের ফাঁদে বন্দি করে রাখা হয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই।     
 

Comments

The Daily Star  | English

Economic expectations: Did govt fall short?

When an interim government was sworn into office following the ouster of the Awami League regime just 100 days ago, there was an air of expectation that the Prof Muhammad Yunus-led administration would take steps to salvage a scam-ridden financial sector and rescue an ailing economy.

6h ago