কত অজানারে

হৃদয় নাড়ানো বিচিত্র এক আখ্যান

উনিশ বছরের তরুণ মণিশংকর মুখোপাধ্যায় 'বিভূতি'-দার হাত ধরে এসেছেন হাইকোর্টে। পিতৃহীন মণিশংকরের চাকরি হলো 'সায়েবের বাবু' অর্থাৎ চেম্বার ক্লার্ক হিসেবে। কলকাতা হাইকোর্টের সর্বশেষ ইংরেজ ব্যারিস্টার নোয়েল ফ্রেডরিখ বারওয়েলের সহকারি হলেন তিনি। বারওয়েল বনেদি বংশের সন্তান, লর্ড ক্লাইভের আমল থেকেই নানা পেশায় নানা সময়ে যুক্ত ছিল তার পূর্বপুরুষ। ওল্ড পোস্ট অফিস রোডে ছিল বারওয়েলের টেম্পল চেম্বার। সেই পুরনো কক্ষে বসেই তরুণ মণিশংকর শুনতেন মক্কেলদের জীবনের বিচিত্র ঘটনা। আবার, বারওয়েল সাহেব নিজেও স্মৃতির অর্গল খুলে বলে যেতেন নানা কাহিনী। মণিশংকর মুখোপাধ্যায় নামটাকে ছেঁটে তিনি তাকে ডাকতেন 'শংকর।' 

১৯৫৩ সালে বারওয়েল সাহেবের মৃত্যুর পর শংকর লিখতে শুরু করলেন বিচিত্র এক আখ্যান ৷ দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে বেরোলো ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত। ১৯৫৫ সালে বই হয়ে এলো সেসব কাহিনী 'কত অজানারে' শিরোনামে। 

হরেক মানুষের জীবনের নানারকম সংকটে উপলব্ধির চেষ্টা ছিলো তার বীক্ষায় ও লেখনিতে। ভূমিকায় লিখছেন, ' আইনের সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্কটা বিশেষ মধুর নয়। অন্তত সাহিত্যের কমলবনে আইনের কলরব ঠিক ভ্রমর গুঞ্জনের মতো শোনায় না। কিন্তু এই গ্রন্থে আমি আইনকে দেখিনি। ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রিটের যে মানুষদের একদিন ভালবেসেছিলাম,তা দের আজ অক্ষরে আবদ্ধ করবার চেষ্টা করছি মাত্র, আর কিছু নয়।' 

কলকাতা হাইকোর্টের সর্বশেষ ইংরেজ ব্যারিস্টার নোয়েল ফ্রেডরিখ বারওয়েল। ছবি: সংগৃহীত

আইনজীবীমাত্রই ধুরন্ধর- এমনটাই মনে করেন অনেকে। শংকর ভাঙতে চেয়েছেন সেই সরলীকরণ৷ তিনি লিখেছেন- "অনেকে ভাবে এ পাড়ায় আইনের নামে যত রাজ্যের বে-আইনি কাজ হয়। উকিলেরা মিথ্যা কথা বলে, এটর্নিরা সুযোগ পেলেই মক্কেলকে শোষে। ভাই-এ ভাই-এ মোকাদ্দমায় দুইজনেই পথে বসে, মাঝখান দিয়ে এটর্নিরা কলকাতায় বাড়ি তোলে। কথাগুলো যে সবসময় মিথ্যা তা নয়, কিন্তু সবাই এখানে কিছু চোর ডাকাত নয়। এখানে অনেক মানুষ আছেন, যারা জীবনে কখনো মিথ্যার আশ্রয় নেননি। সততাই তাদের জীবনের একমাত্র মূলধন। উড্রফ, স্যার গ্রিফিথ ইভান্স, উইলিয়াম জ্যাকসনের মত আইনিবিদরা যে কীর্তি রেখে গেছেন, আমাদের বারওয়েল সায়েব তার শেষ বর্তিকাবাহী। কলকাতা হাইকোর্টের শেষ ইংরেজ ব্যারিস্টার। অষ্টাদশ শতাব্দীতে যার শুরু, বিংশ শতাব্দীর মধ্যাহ্নে যার অবসান।'' 

সেদিন হয়তো শংকর ভাবতেও পারেননি, তার কলমে লিপিবদ্ধ সেসব মানুষেরা চিরদিনের মতো রয়ে যাবেন লক্ষ লক্ষ পাঠকদের হৃদয়েও। 


লেবাননে জন্ম নেয়া মেরিয়ন স্টুয়ার্টের জীবনটাই দেখা যাক। তার মা পেশায় ছিলেন গণিকা। মেয়েকে দিতে চেয়েছিলেন নতুন জীবন। কিন্তু মেয়ে আভা স্টুয়ার্ড (জন্ম নাম) জীবন ফুলের মতো হয়নি৷ ইংরেজ সেনা অফিসার হাওয়ার্ডের রক্ষিতা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে, প্রেমে প্রত্যাখ্যাত মেরিয়ন বহু কাঠখড় পোড়াবার পর মুম্বাই এসেছিলেন। 

এখানেও ভাগ্যের সেই পরিহাস পিছু ছাড়েনি তার। মেহেরুন্নিসা নাম নিয়ে মহিউদ্দিন নামে সেনাপতিকে বিয়ে করার পরও ঘর বাঁধা হলো না। তারপর আবার হিন্দু এক রাজকুমারকে বিয়ে করে নাম নিলেন মীরা আদিত্যনারায়ণ। বারওয়েল সাহেবের কাছে ঘটনাচক্রে আইনি সাহায্যের জন্য আসতে হয় তাকে। সেই সূত্রেই শংকরের সুযোগ হয় এসব জানার। 

এই নারী পরে কি নিজের কোনো পরিচয় দাঁড় করাতে পেরেছিলেন? জীবন কি পেয়েছিল স্থিতি? সেসব প্রশ্নের উত্তর পাঠকেরা বইয়ে পাবেন। এই নারী আপনাদের দাঁড় করিয়ে দেবে আরও অনেক প্রশ্নের সামনে। যেমন- উনি কি আপনাদের চোখে বিবেচিত হবেন একজন সংগ্রামী নারী হিসেবে, নাকি নেহাতই একজন অংসযত নষ্টা হিসেবে? 


একই পেশায় থাকা দুজন মানুষ। দুজনই লব্ধপ্রতিষ্ঠত। একজন ব্যারিস্টার বীরেন বোস, আরেকজন সুব্রত রায়৷ দুজনের জীবনে শূণ্যতা আসে দুই কারণে- একজন সব পেয়েও হারান, আরেকজনের হারাবার মতোই কিছু থাকেনা। কেমব্রিজে বারওয়েল সাহেবের সহপাঠী ছিলেন বীরেন কুমার বোস। জাত-পাত-ধর্মের বাধা ডিঙিয়ে এক বিদেশিনী এমিলি ডেরেনহ্যামকে বিয়ে করলেন৷ পরিবার হারালেন। তারপর অনিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপনে অভ্যস্ত স্ত্রীকে মেইনটেইন করতে গিয়ে পেশাগত জীবনে পড়লেন পিছিয়ে৷ একসময় দাম্পত্য আর আইন ব্যবসা দুটোই হারাতে হলো। কিন্তু সস্তার স্যুট পরা বীরেন বাহ্যিকভাবে 'অ্যাংলো ভিখিরি'-র রূপ পেলেও ভেতরে থাকা আইনজীবীটি মরে যায়নি। 

শংকর দেখতেন গনগনে রোদের দুপুরে সামান্য ছোলাভোজা দিয়ে উদরপূর্তি করছেন সেই উকিল। আর কেউ পরিচয় চাইলেই কার্ড বের করে দিচ্ছেন - বি কে বোস, ব্যারিস্টার অ্যাট। 

কিন্তু সুব্রত রায়? তার জীবনে শূণ্যতা এসেছিলো সফলতার ছায়া হয়ে। যখন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। প্রখ্যাত ব্যারিস্টার উইলমট ড্যানিয়েল রেম্পিনি ছিলেন তার গুরু। প্রথমে জীবনে দরিদ্র রেম্পিনির জীবন যেন এক কল্পলোকের গল্প। লন্ডনের দুঁদে ব্যারিস্টার স্যার হেনরির চেম্বারে কাজ করতেন তিনি। তারপর একটি কেসে রেফারেন্স যখন মিলছেই না, তখন তিনি দিলেন এর সন্ধান। ভাগ্যের দরজা খুলে গেলো৷ রেম্পিনিকে ব্যারিস্টার পড়ালেন হেনরি৷ রেম্পিনি হলেন কলকাতা হাইকোর্টের সেরা ব্যারিস্টার।

সুব্রত রায়ের তো তবে সুখের অন্ত থাকবার কথা নয়। বাহ্যিকভাবে হয়তো তা ছিলও না। কিন্তু রেম্পিনির জাগিয়ে দেয়া উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর সেই কালো গাউনটাকেই জীবনের সবকিছু মনে করা সুব্রত রায় কখন যে নিজের সংসার-স্ত্রী-সন্তান থেকে অলঙ্ঘনীয় মানসিক দূরত্বে চলে গেছেন, তা আর ভেবে দেখার অবসর তার ঘটেনি। যখন ঘটলো, তখন যে আর ফেরার উপায় নেই!


ভারতীয় সমাজের নারীদের দুর্বল অবস্থান ও পুরুষ-তন্ত্রের নগ্নরূপও চিহ্নিত হয়েছে শংকরের লেখায়। বাঙ্গাল যুবক সুরজিৎ রায় মন দিলেন ইংরেজ মেয়ে হেলেন গ্রুবার্টকে। তাদের ভালোবাসার লড়াই তুলে এনেছেন শংকর। নারী তা সে হোক, সুনন্দা দেবীর মতো অবস্থাসম্পন্ন ঘরের অথবা আরতি রায়ের হতদরিদ্র ঘরের; উভয়ের সংকট, বিড়ম্বনা ও তাদের ওপরে ঘটা নির্যাতন তাদের সমান্তরালভাবে দাঁড় করিয়েছে একই সরলরেখায়৷ দুটি ক্ষেত্রেই তাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য বারওয়েল সাহেবের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা আমরা দেখি। উলভারহ্যাম্পটনের জেমস ফ্রেডরিখ গোল্ড ও মিস ফিগিনের মর্মস্পর্শী গল্প আমরা জানতে পারি।

জাহাজ কোম্পানির করা প্রতারণার (নিকোলাস ড্রলাসের সাথে) মর্মান্তিক পরিণতি কিংবা ডা. শেফালি মিত্র বনাম সোফিয়া (ইংরেজ তরুণি)-র মধ্যকার মাতৃত্বের লড়াই আমাদের স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয়, আমাদের চেনাজেনা মানুষগুলো কীরকম মুখোশ পরে আছে। কীভাবে আচমকা এক দমকা বাতাসে তাদের মুখোশ খসে পড়ে। সে অবস্থায় একজন আইনজীবীর কাজ যে কত কঠিন হয়ে যায়, তার উল্লেখ রয়েছে কাহিনীর পরতে পরতে। নোয়েল বারওয়েল সাহবকে তখনো দেখি হৃদয়ের মমত্ববোধ না হারাতে; তাকে আমরা দেখি এর যৌক্তিক সমাধান খোঁজার জন্য সচেষ্ট হতে।


বারওয়েল সাহেব ছিলেন ইংরেজ, কিন্তু নেটিভদের প্রতি তার মমতার অন্ত ছিলো না। চট্টগ্রামের বিপ্লবী রবীন্দ্রকলিতা থানার দারোগাকে হত্যা করে তা নিজমুখে স্বীকার করেন। বারওয়েলের সাহেবের ঘুম উড়ে গিয়েছিল তাকে বাঁচাতে, তবুও পারেননি। আবার, সংখ্যালঘু খ্রিস্টান নরেন মণ্ডল যখন নিজ জমি রক্ষায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান, তখন দাঙ্গায় ফাঁসিয়ে দিতে চাওয়া নরেনকে বাঁচাতে বরিশাল ছুড়ে আসেন বারওয়েল সাহেব। সফলও হন তিনি। 

বারওয়েল ইংরেজ ছিলেন, কিন্তু উপনিবেশবাদী ছিলেন না। শংককে বন্ধুপ্রতীম মনে করতেন। তার সুযোগ হয়েছিল বারওয়েল সাহেবের আকাশের মতো বিপুল হৃদয়কে গভীরভাবে দেখার। নৈনিতালে সামার ভ্যাকেশন কাটাতে গিয়ে রাণীক্ষেতের এক গ্রামে বারওয়েল সাহেবের প্রতিবেশী মিস ফ্যানি ট্রাইটনের ঘটনাবহুল জীবন সম্পর্কেও লেখক জানতে পারেন।


লেখক শংকর বারওয়েল সাহেবের শৈশবকালের একটি গল্প বলে বইটির যবনিকা টেনেছেন। গল্পটি এমন,..... লন্ডনে তখন প্রথম এক্স-রে মেশিন আসে। বালক নোয়েল কৌতূহলী হয়ে দেখতে গেলেন, কাণ্ড দেখে তিনি অবাক। বিস্ময়সুলভ চপলতায় তিনি বলে উঠলেন, এই আলোতে দেহের হাড় পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে !!! পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক চীনা ভদ্রলোক তাকে বলেছিলেন, Yes my boy; but only bones. Unfortunately it doesn't show you your heart.

মণিশংকর মুখোপাধ্যায় ডাকনাম 'শংকর'। ছবি: সংগৃহীত

বারওয়েল ছিলেন এমন একজন আইনজীবী, যিনি মানুষের রক্ত-মাংস-হাড়ের শরীর আর পয়সাকড়ির হিসাবের বাইরেও তাদের হৃদয় দেখতেন। আর সেই আখ্যানই শংকর লিখে গেছেন ২৫৬ পৃষ্ঠার বইটি। ঠিক প্রথাগত উপন্যাসের মতো করে নয়৷ বরং পর্বগুলো আলাদা আলাদা গল্পের মতো হয়ে এসেছে৷ সব ঘটনাগুলো তিনি লিখেছেন উত্তম পুরুষে বৈঠকি আমেজে, যেন পাশে বসিয়ে কাউকে গল্প শোনাচ্ছেন। তাই এটিকে ঠিক উপন্যাসের মতো মনে না হলেও সব ঘটনা বা গল্পের যোগসূত্র এটিকে উপন্যাস হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। আর সেই যোগসূত্র হিসেবে কাজ করেছে নোয়েল ফ্রেডরিক বারওয়েলের আইনপেশায় সাধনা ও নিষ্ঠা- যা তাকে এক্সরে-র হাড়ের বাইরেও চিনতে ও অনুভব করতে শিখিয়েছিল মানুষের হৃদয়কে।  

Comments

The Daily Star  | English

Power, Energy Sector: Arrears, subsidies weighing down govt

The interim government is struggling to pay the power bill arrears that were caused largely by “unfair” contracts signed between the previous administration and power producers, and rising international fuel prices.

6h ago