মানুষ ভালো নেই
ভেতরে ঘনিয়ে উঠছে একটি লেখা, যার শিরোনাম হতে পারে, 'এই অশ্রু উপত্যকায়'। হ্যাঁ, এ আমার দেশ নিয়ে লেখা, দেশের মানুষ নিয়ে লেখা। যৎসামান্য'র এই লেখাগুলোকে আমি লিখতে চেয়েছিলাম নিজের সঙ্গে আপনমনে কথা বলার মতো করে। কতকিছু দেখি, কতকিছু শুনি, কত যে পড়ি; দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে, পড়তে পড়তে কতকিছু যে ভাবি, সেগুলো তো সবসময় লিখে রাখা হয় না। যা কিছু ভাবি, চিন্তা করি, উপলব্ধি করি, তার সামান্যই লিখতে পেরেছি। ভেবেছিলাম, যৎসামান্যতে জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে আমার বিবিধ উপলব্ধিগুলো লিপিবদ্ধ করে যাবো। সেই উপলব্ধির সবকিছু সমকালীন বিষয় নিয়ে নয়, বরং যেগুলো বহুকাল ধরে চিরন্তন প্রশ্ন হয়ে আছে, সেগুলো নিয়ে আমার বোঝাপড়ার কথাই বেশি বলবো। কিন্তু সমকাল তার দাঁত ও নখ নিয়ে এমনভাবে আছড়ে পড়ে আমাদের ওপর, আঁচড়ে-কামড়ে এমনভাবে একাকার করে দেয় যে, কোনোভাবেই মুখ ফিরিয়ে থাকা যায় না। আর তখন সেইসব চিরন্তন উপলব্ধিগুলোকে মনে হয় অপ্রাসঙ্গিক-অপ্রয়োজনীয়।
আমি কথাসাহিত্য নিয়ে কাজ করি। সমকালের মানুষ, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং পরিপার্শ্বের যাবতীয় বিষয়-আশয়ই কথাসাহিত্যের প্রধান উপকরণ। সেই অর্থে কথাশিল্পীরা আসলে নিজেদের সময়ের স্মৃতিই সংরক্ষণ করে যান তাদের লেখায়। সমকালীন প্রসঙ্গ ছাড়া যে কথাসাহিত্য হতে পারে না, তা বলছি না। হতে তো পারেই, হয়েছে, হচ্ছেও। কিন্তু প্রধান বিষয় ওই সমকালই। আমার গল্পে-উপন্যাসে-প্রবন্ধে-মুক্তগদ্যেও সেটি বারবার ফিরে এসেছে। ভেবেছিলাম, এবার একটু এসব থেকে দূরে থাকবো। কিন্তু পারা যাচ্ছে না কোনোভাবেই। ভেতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। মানুষ যখন কাঁদছে – নিঃশব্দ সেই কান্না, তবু আমি তা শুনতে পাচ্ছি – তখন কী করে মুখ ফিরিয়ে থাকি?
২
মানুষ ভালো নেই, এ-কথা সবাই জানেন। না, ভুল বলা হলো। সবাই নিশ্চয়ই জানেন না। যারা সমাজের উঁচুতলার মানুষ, কিংবা রাষ্ট্রক্ষমতার কাছের মানুষ, অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতা আর প্রাচুর্যভরা জীবন যাদের, তারা হয়তো জানেন না, কিংবা জানলেও মানেন না। কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ মানুষ, যাদেরকে জনসাধারণের সঙ্গেই ওঠা-বসা, চলাফেরা, জীবনযাপন করতে হয়, তারা জানেন, মানুষ ভালো নেই। সদ্যই শেষ হওয়া একটা মহামারির বিভীষিকা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছিল সবাই, সেটি করার আগেই তাদের জীবনে আঘাত হেনেছে বিবিধ বিপর্যয়–দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন এবং অসহনীয় ঊর্ধ্বগতি, সামাজিক এবং রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, অর্থনৈতিক এবং মানবিক বিপর্যয়। কত দিক সামলাবে মানুষ?
মহামারি যে কেবল স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে এসেছিল তা তো নয়। বহু পরিবার তাদের স্বজন হারিয়েছেন, বহু মানুষ কোভিড থেকে সেরে উঠলেও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে আক্রান্ত হয়েছেন অনেকরকম স্বাস্থ্য-জটিলতায়– ফুসফুসের সমস্যা, হৃদযন্ত্রের সমস্যা, কিডনির জটিলতা ইত্যাদি–সবই সত্য। কিন্তু সমস্যাটি শুধু স্বাস্থ্যের নয়। ওই সময় চাকরি হারিয়েছেন বহু মানুষ, দোকানপাট বন্ধ থাকায় ছোট ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন দারুণভাবে, নিম্ন আয়ের মানুষদের ভোগান্তির কথা আর নাই-বা বললাম। সেই সংকট থেকে তারা এখনো বেরোতেই পারেননি। আবার অযৌক্তিকভাবে প্রায় দুবছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে শিশু-কিশোর-তরুণদের কেবল শিক্ষাজীবনই ব্যাহত হয়নি, মানসিকভাবেও ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারা। এক জরিপে দেখা গিয়েছিল, শতকরা ৬১ ভাগ কিশোর-তরুণ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে, আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ফলাফল-বিপর্যয়ের দিকে তাকালেও বোঝা যায়, তারা ওই ট্রমা থেকে এখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি। এতসব সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য তো সময়ের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেই সময় আর পাওয়া যায়নি।
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে, দ্বিগুণ বা তিনগুণ পর্যন্ত, এ নতুন কোনো খবর নয়। কিন্তু এই পরিস্থিতির সঙ্গে মানুষ মানিয়ে নিচ্ছে কীভাবে? যারা সীমিত আয়ের মানুষ, হিসাব করে খরচ করতে হয় যাদের, তারা এই বাড়তি ব্যয় মেটাবেন কীভাবে? সঞ্চয় ভেঙে? সঞ্চয়ই বা কজনের থাকে যে ভেঙে খাবে? তাহলে উপায় রইলো একটাই। খাদ্যতালিকায় কাটছাঁট করা। এমনিতেই বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার পায় না, তারওপর যদি কাটছাঁট করতে হয়, কীভাবে চলে তাদের জীবন? কাটছাঁট করেই বা কতদিন চালানো যায়? টিসিবির ট্রাকের পেছনে মানুষের লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে, বাজারের চেয়ে কমদামে কয়েক কেজি চাল কেনার জন্য ভোররাত থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকছে তারা। কিন্তু যেখানে টিসিবির ট্রাক যায় না, সেখানকার মানুষ যাবে কোথায়? কোথায় গেলে সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে ন্যূনতম চাহিদাটুকু পূরণ করা যাবে? সবকিছু দেখে মনে হয়, যেন এক আদিম যুগে ফিরে গেছে দেশ, যখন খাদ্যের সন্ধান ছাড়া মানুষের আর কিছু করার ছিল না। বাজারে গেলে, রাস্তায় বেরুলে মানুষের মুখের দিকে তাকানো যায় না। সেইসব মুখে গভীর বিষাদ ও বিপন্নতা, ক্লান্তি ও হতাশা, বেদনা ও যন্ত্রণা লেপ্টে আছে।
৩
কেবল খাদ্যের সংকটই নয়, সব অর্থেই দেশ এখন খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে। নিরাপত্তাহীনতা হয়ে উঠেছে আমাদের নিত্যসঙ্গী। প্রকৃতিজগতে মানুষই বোধহয় সবচেয়ে অসহায় প্রাণী, আদিকাল থেকেই সে নিরাপত্তা খুঁজে চলেছে। খাদ্যের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা, বাসস্থানের নিরাপত্তা, পোশাকের নিরাপত্তা, বেঁচে থাকার নিরাপত্তা। অথচ এ-দেশে কোনো নিরাপত্তাই আর অবশিষ্ট নেই। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল দেশ, ভাবা হচ্ছিল– কেউ আর না খেয়ে মরবে না। কিন্তু বাজার চলে গেছে রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীদের হাতে, সরকারই তাদের হাতে সব তুলে দিয়েছে, জনসাধারণের জন্য তাদের বিন্দুমাত্র দায়বোধ নেই, কারসাজি করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে লুটে নিচ্ছে হাজার কোটি টাকা। মানুষ কোনোমতে, টেনেটুনে, ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে আছে। কতদিন থাকতে পারবে কে জানে! স্বাস্থ্যখাতে বিপুল লুটপাট তো সর্বজনবিদিত। সবই যাচ্ছে লুটেরাদের পকেটে, জনগণের জন্য কিছুই অবশিষ্ট নেই। শিক্ষাব্যবস্থা তো ধ্বংসই হয়ে গেল, কবে যে আবার গড়ে তোলা যাবে কে জানে! আবার ঘর থেকে বেরুলে যে আবার নিরাপদে ফিরে আসতে পারবেন, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। এমনকি ঘরের ভেতরেও নেই নিরাপত্তা। এত নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে মানুষ সুস্থ জীবন পাবে কীভাবে?
অসহিষ্ণুতা বেড়েছে সব জায়গায়। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছে না। মতবিরোধ বা মতদ্বৈধতা নিয়েও পাশাপাশি থাকার সংস্কৃতি একসময় এদেশে ছিল, এ-কথা এখন বোধহয় কেউ বিশ্বাসই করবে না। অথচ আমাদের তারুণ্যের কালে ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের হয়েও বন্ধু হতে অসুবিধা হয়নি আমাদের। ধর্মপরায়ণ এবং নাস্তিকদের বন্ধুত্ব দেখেছি, আওয়ামী লীগ-বিএনপি-বামদলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে বন্ধুত্ব দেখেছি, বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব দেখেছি। আমাদের সম্পর্কগুলো ছিল দল-মত-ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে। এখনকার তরুণরা কি মতের এইসব ভিন্নতা নিয়েও পরস্পরের বন্ধু হতে পারে? এখন তো দেখি কেউ কারো সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করলেই সে শত্রু হয়ে যায়।
সবচেয়ে বেশি অসহিষ্ণুতা তৈরি হয়েছে ধর্ম আর রাজনীতিকে ঘিরে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এ-দেশের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের চেয়ে যোগাযোগহীনতা তৈরিতেই অধিক ভূমিকা রেখেছে। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে এত রূঢ় এবং ভয়ংকর সব মন্তব্য করে বসে একজন আরেকজন সম্বন্ধে যে দেখলে বিবমিষা হয়। সর্বত্র ঘৃণার জয়জয়াকার। ওয়াজের নামে এক শ্রেণির তথাকথিত 'আলেম' অবর্ণনীয় ঘৃণার চাষাবাদ করেন। ভিন্ন ধর্মের, ভিন্ন মতের প্রতি তারা সর্বদা বিষোদগার করতে থাকেন। আর রাজনীতির নামে ঘৃণার চাষাবাদ করেন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মী-সমর্থকরা। সেইসব ঘৃণা ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। ঘৃণা হলো হাইয়েস্ট ফর্ম অফ পয়জন। এরচেয়ে মারাত্মক বিষ আর হয় না। একটা বিকাশমান সমাজে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণা ক্রমশ কমতে থাকে, সভ্য সমাজে ঘৃণা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। আর উল্টোটা ঘটে অবরুদ্ধ সমাজে। সেখানে ঘৃণা অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে জনসাধারণের মধ্যে। তাদের সমস্ত অবদমিত কামনা-বাসনা প্রকাশিত হয় ঘৃণার ভাষায়। বাংলাদেশে এখন সেই সময় চলছে।
৪
স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও আমরা একটা মুক্ত সমাজ তৈরি করতে পারলাম না। এর কারণ মূলত রাজনীতিই। একটা উদার গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরিতে এদেশের রাজনীতিবিদরা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। ব্যর্থতার কথা বললে অবশ্য সবটুকু বলা হয় না, তারা আসলে সেরকম সমাজ নির্মাণ করতে চানইনি। তারা চেয়েছেন রাজনৈতিক বিরোধকে একেবারে ব্যক্তিগত বিরোধে পরিণত করতে এবং সেটি করতে তারা সক্ষম হয়েছেন। এখন, এই সময়ে এসে, দুটো ভিন্ন দলের সমর্থকরা বোধহয় এক টেবিলে বসে চা খেতেও চাইবেন না। এখানে মতাদর্শের কোনো ব্যাপারই নেই। বড় বড় রাজনৈতিক দলের কোনো মতাদর্শ আদৌ আছে কি না, সেটি নিয়ে বরং সন্দেহ হয় মাঝেমাঝে। থাকলেও সেটি দলের কর্মী-সমর্থকরা জানেন কি না, বোঝার উপায় নেই। এই বিরোধ নিছকই ক্ষমতায় থাকা অথবা ক্ষমতায় যাওয়ার বিরোধ। রাজনৈতিক দল তো কেবল দেশ পরিচালনার জন্যই নয়, তারা জনগণের মনোজগতে পরিবর্তন আনতেও ভূমিকা রাখে। কিন্তু আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর সেই ভূমিকা আর দেখাই যায় না।
আমাদের মতো যারা নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যক্ষদর্শী, কিংবা কর্মী, তারা আশা করেছিলেন, জনগণের জন্য একটা কল্যাণকর রাষ্ট্র এবং গণতান্ত্রিক সমাজকাঠামো নির্মাণের জন্য আমাদের স্বপ্নযাত্রা শুরু হলো। কিন্তু পরবর্তীকালে, দেশের দুই বড় দলের নেতৃত্বে, সেই স্বপ্নের অপমৃত্যু হয়েছে। ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার লোভ সমস্ত সম্ভাবনাকে তছনছ করে দিয়েছে। এমনকি নির্বাচনের মতো একটা উৎসবমুখর আয়োজনকেও ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এখন আর ভোটারকে ভোট দেওয়ার জন্য কেন্দ্রে যেতে হয় না, এমনকি কাকে ভোট দেবে সেই চিন্তাও করতে হয় না। তাদের অজান্তেই তাদের প্রতিনিধিরা 'নির্বাচিত' হয়ে যান!
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোটের অধিকার কেড়ে নিলে কী হয়? দুটো বিষয় ঘটে। প্রথমটি, জনগণের কাছে রাজনৈতিক দলগুলোর এবং নেতা-কর্মীদের কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না। তারা জেনে যায়, ভোটের জন্য আর জনগণের দুয়ারে যেতে হবে না, জবাবদিহিও করতে হবে না। তখন একটা একরোখা ভাব এসে যায় তাদের মধ্যে, যা ইচ্ছে তাই করার মানসিকতা জন্ম নেয়। অবাধ লুটপাট, সন্ত্রাস, মাদকবাণিজ্য, টেন্ডারবাণিজ্য, ব্যাংক লোপাট, শেয়ারবাজার লোপাট– কোনোকিছুকেই তারা বাদ দেয় না। এবং তাদের এসব মারাত্মক অপরাধ নিয়ে যেন জনগণ কথা না বলতে না পারে, সেজন্য তারা তৈরি করে ভয়ের সংস্কৃতি। কথা বললেই জেল, জুলুম, গুম, খুন – কী নয়! দ্বিতীয়টি হলো, জনগণের মধ্যে মর্যাদাবোধের ঘাটতি দেখা দেয়। এমনিতেই উঁচুতলার মানুষরা এদেশের জনসাধারণকে মানুষ বলেই গণ্য করে না, মানবিক মর্যাদা দেওয়া তো দূরের কথা। তবু, ভোটের সময় রাজনীতিবিদরা যে তাদের দুয়ারে গিয়ে দাঁড়াতেন, তারা যে নিজেরা ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারতো, এতে তারা নিজেদেরকে মর্যাদাবান মনে করতো। কিন্তু সেই সুযোগটুকুও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। পঞ্চাশ বছর ধরে এদেশের মানুষ অনেক কিছু দেখেছে, শুনেছে, বুঝেছে। সেজন্যই এদেশে কোনো দলীয় সরকারের অধীনে আর কোনোদিন সুষ্ঠু-অবাধ-গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে, তা কোনো পাগলেও বিশ্বাস করে না।
৫
আমাদের কোনো উৎসবই সার্বজনীন হয়ে উঠলো না। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, নববর্ষের মতো জাতীয় উৎসবগুলো কিংবা ঈদ বা পূজার মতো ধর্মীয় উৎসবগুলোও যেন সবার জন্য নয়। অসহায়, দরিদ্র, নিপীড়িত, নির্যাতিত, প্রতারিত, বিশ্বাস আর আস্থা হারানো মানুষগুলোর কাছে উৎসব যেন এক নতুন ধরনের পীড়ন। কারণ এসব উৎসবে তাদের অংশগ্রহণের অধিকার নেই।
একমাত্র নির্বাচন বা ভোটই ছিল এদেশের সার্বজনীন উৎসব। গ্রামেগঞ্জে ভোটের সময় উৎসবের আমেজ আসতো। বাংলাদেশের মানুষকে দেখলে আপাতদৃষ্টিতে রাজনীতি-অনীহ বলে মনে হলেও বাস্তবিক অর্থে এমন একটি মানুষও বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে রাজনীতি নিয়ে কিছু-না-কিছু না ভাবে, না বোঝে। অবশ্য উঁচুতলায় এক শ্রেণির 'আই হেইট পলিটিক্স' প্রজন্ম তৈরি হয়েছে, সেটিও ওই রাজনীতিরই অংশ। ওরা যদি বুঝে যায় যে, রাজনীতির নামে কী ন্যক্কারজনক লুটপাট চলছে তাহলে বয়সের কারণেই বিদ্রোহ করে বসতে পারে। আর উঁচুতলার তরুণরা বিদ্রোহ করলে তো তাদেরকে পাখির মতো গুলি করে মারা যাবে না! ক্ষমতার মসনদ টলে উঠবে। অতএব তাদেরকে ইয়াবার মতো মাদক দিয়ে, পর্ন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখো। যাহোক, ভোট নেই বলে গ্রামেগঞ্জে সেই উৎসবও নেই আর। জনসাধারণের মর্যাদাবোধের শেষ সম্বলটুকুও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এমনকি তারা একটি সমাবেশ করতে চাইলেও অকস্মাৎ বুলেট এসে লাগে বুকে, কেড়ে নেয় প্রাণ। এই দেশ, এই রাজনীতি, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরও, প্রতিবাদের-সমাবেশের-কণ্ঠ উঁচু করার স্বাভাবিক অধিকারটুকুও জনগণকে দেয়নি।
জনসাধারণ এখন খুব ভালোভাবে বুঝে গেছে, রাজনীতিবিদরা ভালো ভালো কথা বলে ক্ষমতায় গিয়ে তাদের সঙ্গে চরম প্রতারণা করেছে। মানুষ সবচেয়ে আহত বোধ করে যখন সে অনুভব করে– সে প্রতারিত হয়েছে। প্রতারিত মানুষ আর অপমানিত মানুষ তাদের ক্ষোভ-দুঃখ-অভিমান প্রকাশের সুযোগ না পেলে, প্রতিবাদ করার সামর্থ্য বা সুযোগ না থাকলে নীরব-নিশ্চুপ হয়ে যায়। অভিশাপ দেয় অথবা কাঁদে একা একা। সেই কান্না দেখা যায় না, শোনা যায় না, তবে সংবেদন থাকলে অনুভব করা যায়।
মানুষ কাঁদছে, নিঃশব্দ সেই কান্না, আমি সেই অশ্রুত কান্না শুনতে পাচ্ছি কোনো এক অদ্ভুত কারণে। এরকম তো অনেকেই শোনেন। অনেকে না হলেও কেউ কেউ শোনেন। যেমন শুনেছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, আর তাই লিখতে পেরেছিলেন, মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াও।
মানুষ কাঁদছে। অভাবের কান্না, নিরাপত্তাহীনতার কান্না, প্রতারিত-অপমানিত হওয়ার কান্না; সেই নীরব কান্নায় ভাসিয়ে দিচ্ছে দেশ, পুরো দেশটাই হয়ে উঠেছে এক অশ্রু উপত্যকা।
Comments