পৃথিবীর নিঃসঙ্গতম মানুষ
পৃথিবীর নিঃসঙ্গতম মানুষটি মারা গেছেন- এরকম শিরোনামের কোনো খবর দেখলে মনে হওয়ার কথা, বাক্যটি রূপকার্থে বা প্রতীকী অর্থে বলা হয়েছে, যেমনটি বলা হয় কবিতায়। পৃথিবীর সব মানুষই তো কমবেশি নিঃসঙ্গ, কেউ কেউ একটু বেশিই নিঃসঙ্গ, যাদেরকে কেউ বুঝে উঠতে পারে না। সেরকম কেউ মারা গেলেও তো আমাদের এমনই মনে হয়। অথচ খবরের এই শিরোনামটি কোনো রূপকার্থে ব্যবহার করা হয়নি, ব্যবহার করা হয়েছে আক্ষরিক অর্থে। এরকম একজন মানুষ সত্যিই ছিলেন, বাস করতেন ব্রাজিলের আমাজন অরণ্যের গভীরে, সম্পূর্ণ একা। এও কি সম্ভব? একজন মানুষ কীভাবে বনের গভীরে একা বাস করেন, কেনই-বা করেন? একাই কি ছিলেন তিনি সবসময়, জন্ম থেকেই? সেটিই বা কীভাবে সম্ভব? তাকে জন্ম দেবার জন্যও তো অন্তত এক জোড়া নারী-পুরুষ দরকার!
আরো অনেকের মতো এই মানুষটি সম্বন্ধে আমিও কিছুই জানতাম না। বাংলাদেশের কোনো পত্রিকায় কখনো কিছু লেখা হয়নি তার সম্বন্ধে, এমনকি মৃত্যুর পরও নয়। তার কথা জানতে পারলাম তার মৃত্যুর পর, ফেসবুকে, বন্ধু ইশরাত শারমীনের পোস্ট দেখে। মনটা এলোমেলো হয়ে গেল মানুষটির কথা ভেবে। পড়তে শুরু করলাম বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবর আর বিশ্লেষণগুলো। এবার যেন খানিকটা পরিষ্কার হলো বিষয়টি।
না, সর্বদা একা ছিলেন না তিনি। ছিলেন এক নৃ-গোষ্ঠীর সদস্য, যারা বাস করতো ব্রাজিলের রনডোনিয়া প্রদেশের তিমারু নামক আদিবাসীদের অঞ্চলে। কিন্তু তাদেরকে সহ্য হয়নি মূলধারার এক কৃষকগোষ্ঠীর, যারা তাদের জমির পরিমাণ বাড়াতে চাইছিল। ১৯৭০ সালে এই 'সভ্য' লোকগুলো আক্রমণ শুরু করে আদিবাসী গোষ্ঠীটির ওপর, শুরু হয় নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ। এই আক্রমণ এবং হত্যাযজ্ঞ চলে পঁচিশ বছর ধরে। ১৯৯৫ সালে এই নৃ-গোষ্ঠীর মাত্র সাতজন বেঁচে ছিলেন, যার মধ্যে ছ'জন মারা যান ওই বছরের এক আক্রমণে, টিকে থাকেন কেবল একজনমাত্র মানুষ। নিজের নৃ-গোষ্ঠীর সবাইকে হারিয়ে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন তিনি, সরে যান অরণ্যের আরো গভীরে। তাকে অবশ্য খুঁজে বের করা হয়েছিল, ১৯৯৬ সালে, ব্রাজিলের আদিবাসী সংক্রান্ত জাতীয় এজেন্সি 'ফুনাই'-এর প্রচেষ্টায়। তার নিরাপত্তার দায়িত্বও নিয়েছিল তারা, দূর থেকেই। কাউকে কাছে যেতে দেননি তিনি 'সভ্য' জগতের সকল যোগাযোগ-প্রচেষ্টাকে সর্বদা প্রত্যাখ্যান করেছেন। করারই কথা। এই 'সভ্য' মানুষেরা তাঁর গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে, কেনই-বা তিনি তাদের কাউকে বিশ্বাস করবেন?
দূর থেকেই তাকে পর্যবেক্ষণ করা হতো। নানা কৌশলে কিছু ছবিও তোলা হয়েছিল তার জীবন-যাপনের, তাও অনেক দূর থেকে। দেখা গেছে, অনেকগুলো কুঁড়েঘর তৈরি করেছেন তিনি, খড় দিয়ে। তৈরি করেছেন অনেকগুলো চৌকোণা গভীর গর্ত, অনেকটা কবরের মতো দেখতে, তবে গভীরতা অনেক বেশি, প্রস্থে কম। এসব গর্ত সম্ভবত তিনি শিকারের জন্য ব্যবহার করতেন অথবা নিজে লুকাবার জন্য তৈরি করেছিলেন। যার স্বজনরা নিহত হয়েছেন নির্বিচার বর্বর আক্রমণে, তিনি যে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চাইবেন, এ আর অবাক কী! সম্ভবত কিছু ফসলও ফলাতেন তিনি, গম বা যব জাতীয়, সংগ্রহ করতেন মধু এবং ফলমূল আর শিকার করতেন প্রয়োজনমতো। এই দিয়েই তিনি বেঁচেছিলেন অন্তত ২৬ বছর (তাঁকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল এবং পর্যবেক্ষণ করা শুরু হয়েছিল ছাব্বিশ বছর আগে)।
তিনি মারা যাওয়ার অন্তত মাস-দেড়েক পর তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়, ততদিনে দেহটি পচে যেতে শুরু করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, তার বয়স ৫৫ থেকে ৬৫ মধ্যে কিছু একটা ছিল। তার মানে, তার জীবনের অর্ধেক কেটেছে নিজের জাতিগোষ্ঠীর নিশ্চিহ্ন হওয়া দেখতে দেখতে, বাকি অর্ধেক কেটেছে সম্পূর্ণ একা।
আদিবাসীদের ওপর নিপীড়িন আর তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করার এই বিষয়টি নতুন নয়। অস্ট্রেলিয়ায়, আমেরিকায়, ইউরোপে নির্বিচারে চলেছে আদিবাসী নিধন, শত শত বছর ধরে। প্রায় একই আচরণ করা হয়েছে পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও। আজকের এই বিকট সভ্যতা আসলে গড়ে উঠেছে আদিবাসীদের রক্তে রঞ্জিত হয়ে। নানান কায়দা-কানুন করে সেই রক্তের দাগ লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু এখন আর তা পারা যাচ্ছে না। ইতিহাসের খুঁটিনাটি খুঁজতে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ছে সেইসব নিপীড়ন আর নিধনযজ্ঞের ভয়াবহ কাহিনীগুলো।
পশ্চিমা দেশগুলো সেই নিপীড়ন, ধ্বংসযজ্ঞ আর নিধনযজ্ঞের বিষয়গুলো স্বীকারও করে নিচ্ছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমাও চাইছে কোনো কোনো দেশ। ২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী কেভিন রাড প্রথমবারের মতো পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে আদিবাসীদের ওপর চলা শত শত বছরের নিপীড়নের জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন। ২০১৭ সালে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো আদিবাসী শিশুদের জোরপূর্বক স্কুলে নিয়ে গিয়ে তাদের ভাষা-সংস্কৃতি-বিশ্বাস ভুলিয়ে দেবার জন্য যে অবর্ণনীয় নির্যাতন করা হয়েছিল, তার জন্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। সেখানেই থামেনি ব্যাপারটা। ওই স্কুলগুলো যেহেতু পরিচালিত হতো ক্যাথলিক চার্চ দ্বারা, সেজন্য পোপকে আহ্বান জানানো হয় ক্ষমা চাওয়ার জন্য। অবশেষে এ বছরের ২৫ জুলাই পোপ ফ্রান্সিস কানাডায় গিয়ে আদিবাসীদের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
ইতিহাস যখন নিজেই কথা বলতে শুরু করে তখন আর অপকর্মগুলোকে ঢেকে রাখা যায় না। পশ্চিমা দেশগুলোতে সেটিই ঘটছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সব দেশই তাদের অপরাধ স্বীকার করে নিচ্ছে কিংবা আদিবাসীদের ওপর নিপীড়নের জন্য অনুতপ্ত হচ্ছে। বরং এখনো নিপীড়ন অব্যাহত আছে বহু দেশে। জাতিসংঘের মতে পৃথিবীর ৯০টি দেশে প্রায় ৪৮ কোটি আদিবাসী বাস করে। তারা 'ঐতিহাসিকভাবে শোষণ, বৈষম্য, বঞ্চনা ও অবিচারের শিকার, যাকে জাতিসংঘ বলছে হিস্টরিকাল ইনজাস্টিস।'
জাতিসংঘসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠান আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাচ্ছে বলে তাদের ওপর নিপীড়নের ধরন পাল্টেছে, কিন্তু একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। বাংলাদেশে তো আদিবাসীদের 'আদিবাসী' বলাই যায় না সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে। বলতে হয় উপজাতি বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তা অথবা নৃ-গোষ্ঠী। অর্থাৎ তাদের জাতির মর্যাদা দিতে কুণ্ঠিত এবং নারাজ এই রাষ্ট্র। গত ৯ আগস্ট, আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে, তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে অদ্ভুত এক নির্দেশনা এসেছিল গণমাধ্যমে। বলা হয়েছিল, পত্র-পত্রিকায় যেন আদিবাসী শব্দটি না লেখা হয়, টেলিভিশনের টকশোগুলোতে আলোচকরা যেন আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার না করেন ইত্যাদি। একটা শব্দের জন্য এতকিছু? এত ভয় 'আদিবাসী' শব্দটি নিয়ে! কী উদ্ভট এক রাষ্ট্রে আমরা বাস করি!
একথা সত্য বিভিন্ন দেশের বহু আদিবাসী গোষ্ঠী 'সভ্য' জগতের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছে, নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি অক্ষুণ্ণ রেখেই মূল ধারার জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে, 'আধুনিক' শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে ইত্যাদি। আবার এও সত্য, বিশাল সংখ্যক আদিবাসী, বিশেষ করে যারা অরণ্যবাসী, নিজেদের আদিম জীবন-যাপন অক্ষুণ্ণ রেখেছে। তথাকথিত 'সভ্য' জগতে তারা আসতে চায় না, যোগাযোগও করতে চায় না। তাদের আছে নিজস্ব সংস্কৃতি, বিশ্বাস, সংস্কার, খাদ্যাভ্যাস, শিক্ষা-পদ্ধতি, এমনকি চিকিৎসাব্যবস্থাও। ভাবলেও অবাক লাগে, অরণ্যের গভীরে যারা বাস করে, কিংবা দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে, 'সভ্য' জগতের সঙ্গে যাদের যোগাযোগ নেই, তাদেরও তো অসুখ-বিসুখ হয়, সেগুলোর চিকিৎসা তারা করে কীভাবে? বোঝাই যাচ্ছে, আধুনিক চিকিৎসা-বিজ্ঞান সম্বন্ধে কিছু না জানলেও তাদের আছে প্রাকৃতিক চিকিৎসা-পদ্ধতি। বস্তুত তাদের সমগ্র জীবনই প্রকৃতিকেন্দ্রিক। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসা এমনকি শিক্ষার জন্যও তারা প্রকৃতির দ্বারস্থ হয়। আর প্রকৃতি তো অকৃপণ, এই প্রাকৃতজনদের সে কখনোই খালি হাতে ফেরায় না, উজাড় করে নিজের বৈভব এবং বিত্ত উপহার দেয়।
সভ্যতার নির্মাণই ঘটেছে প্রকৃতির সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার মাধ্যমে। আর সেজন্যই সে সঙ্গে নিয়ে এসেছে অনেক অসুখ-বিসুখ। কিংবা সভ্যতা নিজেই এক অসুখ। তার অনেক খাঁই। সে বনভ'মি উজাড় করে দেয়, জলাশয় ভরাট করে ফেলে, নদীগুলো দখল করে নেয়, পাহাড় কেটে সমতল ভ'মি তৈরি করে, সমুদ্রে প্লাস্টিক ফেলে জল দূষিত করে, এমনকি পারমানবিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে বিস্ফোরণ ঘটায় সাগরের তলদেশে। এরা কেন আদিবাসী প্রাকৃতজনদের সহ্য করবে?
যার প্রসঙ্গ ধরে এই লেখা শুরু করেছিলাম, তার কথা বলেই শেষ করি। সেই নিঃসঙ্গতম মানুষটির সঙ্গে কখনোই যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি বলে তার নাম জানা যায়নি; জানা যায়নি কোন ভাষায় কথা বলতেন তিনি এবং তার গোষ্ঠীর মানুষগুলো; বা কী ছিল তাদের সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-আশাকের ধরন; এমনকি জানা যায়নি তার নৃ-গোষ্ঠীর নামও। কোনোদিন জানা যাবে না, কী ভাবতেন তিনি তার নিঃসঙ্গ জীবদ্দশায়, কী ছিল তার চিন্তাপদ্ধতি, 'সভ্য' জগত সম্বন্ধে কোন ধারণা নিয়ে তিনি বিদায় নিলেন পৃথিবী থেকে।
নির্মম এবং অসুস্থ সভ্য-জগতের সমস্ত যোগাযোগ-প্রচেষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করে, তাদেরকে সারাজীবন ধরে অবিশ্বাস করে তিনি আসলে সভ্যতার গালে বিশাল এক চপেটাঘাত করে গেছেন। কিন্তু এই সভ্যতা এতটাই নির্বোধ যে সেই চপেটাঘাতের গ্লানিটিও তারা অনুভব করতে পারবে না কোনোদিন।
Comments