কথাশিল্পী রশীদ করীমের স্বাতন্ত্র্য ও সাহিত্যাদর্শ

রশীদ করীমের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় ১৬ বছর আগে। ২০০৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু, দেখা হওয়ার আগের দিন যাত্রাপথের অনাবিল অনুভূতি উপভোগ করতে পারিনি। অনুভূতির বিপরীতে একটা উত্তেজনা ও অমিশ্র-আশঙ্কায় আচ্ছন্ন বা অরক্ষিত আমি সেদিন বারবার ঔপন্যাসিক রশীদ করীম ও তার উপন্যাসে ঘুরপাক খাচ্ছিলাম!

বাংলাদেশের উপন্যাসশিল্পের টেকসই পথ—নির্মিতের প্রাজ্ঞ-পুরুষ কথাশিল্পী রশীদ করীমের সঙ্গে প্রথম দেখা হবে; তিনি তখন কী কী জিজ্ঞেস করবেন, করতে পারেন, আমিই বা তাকে কী কী জিজ্ঞেস করবো, তিনি আমাকে কীভাবে নিবেন, তার কাছে আমি নিতান্তই বালক বলে বিবেচিত হবো নাতো! বাংলা ও বাংলাদেশের সাহিত্যের আমি কতোটুকুই বা জানি, অধ্যাপক শহীদ ইকবাল কি আমার সঙ্গে যাবেন, আমাকে সহায়তা করবেন, আদৌ কি রশীদ করীমের সঙ্গে দেখা হবে, তিনি তো সাক্ষাৎ ও সাক্ষাৎকার দেন না- এসব প্রশ্ন ও আশঙ্কার মধ্যেও শিহরিত হচ্ছিলাম এই ভেবে যে, রশীদ করীমের সঙ্গে দেখা হচ্ছে কাল!

পরদিন অবশ্য আমার শিক্ষক, চিহ্ন-সম্পাদক ও অধ্যাপক শহীদ ইকবাল সঙ্গে ছিলেন না। তার অনুপস্থিতি রশীদ করীমকে সামান্য আহত করেছিল; কিন্তু আমার সঙ্গে থাকা বন্ধুর নাম শুনে তিনি শুধু নড়েচড়ে উঠলেন না, বিস্ময়ও প্রকাশ করলেন! গম্ভীরতা ভেঙে বললেন, ইয়াদ মোর্শেদ জুয়েল! আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার পুরো নাম জানোতো? বললাম, হ্যাঁ জানি, আপনার পুরো নাম হচ্ছে রশীদ করীম গোলাম মুরশেদ। জন্ম ১৪ আগস্ট ১৯২৫ খৃস্টাব্দে কলকাতায়, ৩০ নম্বর ইউরোপিয়ান এ্যাসাইলাম লেনে। রশীদ করীম যেন খুশি হলেন। বললেন, আশ্চর্য তোমরা দুই বাল্যবন্ধু, একজন প্রিন্স আরেকজন জুয়েল, নামের অর্থগত দিক থেকে কী অপূর্ব মিল!

এরপর আমরা তিনজনই গল্পে মেতে উঠি। আলাপচারিতায় অংশ নেই। বয়স আর পাণ্ডিত্যের ব্যবধান ভুলে যাই। আমাদের আলাপচারিতায় একসময় অংশ নেন সালিমা মুরশেদ (ডাকনাম ফুল)। রশীদ করীমের স্ত্রী। বুনোফুলের মতোই ছোট্ট ও সুশ্রী! সতেজ এবং মিষ্টি! তার রান্নার ঘ্রাণ ও স্বাদ আরও একবার উপভোগ করার সৌভাগ্য হয়েছিল, ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে। সেবার আর আমার সঙ্গে জুয়েল ছিল না, ছিল সুষমি। একসময়ের সহপাঠী, এখন আমার স্ত্রী। সেবার আমাদের আলাপচারিতার মাঝে সুদূর আমেরিকা থেকে তিশনার ফোন এসেছিল। তিনি আমাদের বললেন, আমার একমাত্র সন্তানের একমাত্র সন্তান, আমার নাতনি, প্রায়দিনই আমাকে ফোনে রবীন্দ্রসংগীত শোনায়; খুব ভালো বাংলা বলতে না পারলেও রবীন্দ্রসংগীত শেখে, গাইতে পারে!

রশীদ করীমের মেয়ে নাবিলা মুরশেদের সঙ্গে পূর্বেই আমার পরিচয় হয়েছিল মুঠোফোনে। রশীদ করীমকে পাঠানো 'রশীদ করীমের উপন্যাস: বিষয়-বৈভব ও শিল্পরূপ' শীর্ষক আমার গবেষণাপত্র পড়ে উনিই একদিন ফোন দিয়েছিলেন। তখন তিনি ঢাকায় বেড়াতে এসেছিলেন।

মনে হতে পারে, সেদিন আমাদের আলাপচারিতার মধ্যে তিশনার ফোনটি ছিল আকস্মিক ও অনাহূত। ওই ফোনের তেমন কোনো গুরুত্ব নেই, ছিল না। কিন্তু, সেদিন ও পরবর্তীতে ওই ফোনটি আমাকে যেভাবে ভাবিয়ে তুলেছে, তা কোথাও বলা বা লেখা প্রয়োজন। আমরা জানলাম, ব্যক্তি রশীদ করীমের উত্তরসূরি আমেরিকাপ্রবাসী একমাত্র নাতনি ঠিকমতো বাংলা বলতে পারে না। আর, আমরা জানি যে- অগ্রজ আবু রুশ্দ ও অনুজ রশীদ করীমদের পারিবারিক ভাষা ছিল উর্দু। তাদের মা-খালারা ছিলেন মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের প্রথম চারজন ছাত্রী।

রশীদ করীমের নানা সৈয়দ আবদুল মালেক এডিশনাল ডিপুটি ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালীন সদ্যবিধবা রোকেয়াকে স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য জায়গা দেন। অর্থাৎ, উর্দু ছেড়ে বাংলা ভাষা চর্চা ও বিকাশের জন্য, বাংলাদেশের সাহিত্যাদর্শ নির্মাণের জন্য, শিল্পসাহিত্য ও চিন্তা-চেতনায় স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের নেপথ্য-কারিগরির জন্য তাদের পরিবারের অগ্রণী ভূমিকা ও আন্তরিক বাসনাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। আর, তার বা তাদের উত্তরসূরিরা আজ কি-না ভাঙা ভাঙা বাংলায় কথা বলেন!

বিষয়টি দুঃখজনক এবং আমাদের জাতিগত ত্রুটি ও বিনাশরোধে এর তল অনুসন্ধান করাও বোধকরি জরুরি। কেন এমন হয়? এমনটি হলো? সহজ উত্তরের চেয়েও বেশি কিছু খুঁজতে রশীদ করীমের কয়েকটি উদ্ধৃতির সহায়তা নেওয়া যাক-

উদ্ধৃতি-১ :

'আমি আদর্শ পুরুষ নই। আদর্শ পুরুষের জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সবটুকুই এক নিরবচ্ছিন্ন সূত্রে গাঁথা। সবটাই চির পরিচিত রেলগাড়ির লাইন; কোন স্টেশনে গাড়ি কতক্ষণ দাঁড়াবে তাও আগে থেকেই জানা। কোথাও অপ্রত্যাশিত বিস্ময় বা অজ্ঞতার চমক নেই। সুতরাং আমি আদর্শ পুরুষ নই। চরিত্র যথেষ্ট বলীয়ান নয় বলেও বটে, মনের স্বাভাবিক প্রবণতাও কিছুটা অন্যদিকে প্রবহমান বলেও বটে।' [উত্তম পুরুষ, ১৯৬১]

উদ্ধৃতি-২ :

'আমি লোকটা আসলে একটা খচ্চর; যদিও, আমার বাপ লোকটা মোটের ওপর ভালোই ছিলেন। ভালো না বলে সজ্জন শব্দটিই ব্যবহার করতে পারতাম; কিন্তু কোথাও একটা বাধা পেলাম। তিনি যদি আর একটু অবস্থাপন্ন হতেন, তাহলে ঐ সম্ভ্রান্ত শব্দটিই ব্যবহার করা চলতো।' [আমার যত গ্লানি, ১৯৭৩]

উদ্ধৃতি-৩ :

'কেউ বলে আমার ধমনিতে হিন্দু-রক্ত আছে আমি হিন্দু-ঘেঁষা। কেউ বলে আমার মানস পাকিস্তানি। বাংলাদেশে আমার জায়গা হওয়া উচিত নয়। আবার আজ শুনছি আমি কমিউনিস্ট। আমি তো জানি আমি একজন সাধারণ নির্দলীয় মানুষ মাত্র!' [মায়ের কাছে যাচ্ছি, ১৯৮৯]

উদ্ধৃতি-৪ :

'মাঝে মাঝে মনে হয় আমি নিজেকেই চিনি না। যেমন চিনি না আরও অনেক লোককে, যাদের সৎ বলে জেনেছি, তারপর দেখেছি, তারা কতো সহজেই চলতি হাওয়ার পন্থী হয়ে গেছে। অথবা মন্দ জেনেছি, পরে দেখেছি, অকাতরে চরম আত্মত্যাগ করতে। কোনো মানুষকেই আমি তার আদর্শ বা মতবাদের জন্য অভিযুক্ত করি না সেটা আমার আদর্শ বা মতবাদের যতোই বিরোধী হোক না কেন। বরং নিষ্ঠার সঙ্গে মতকে আঁকড়ে থাকেন বলে শ্রদ্ধা করি।' [চিনি না, ১৯৯০]

উদ্ধৃতিগুলো নিবিড় পাঠে কথাশিল্পী রশীদ করীমের শিল্পী-মানস উপলব্ধি করা যাবে। যে কথাশিল্পী উত্তমপুরুষ 'আমি'-কে আদর্শিক করে তুলেন না, বরং 'আমি'-কে কেটে-চিরে তার হীনরূপ এবং পরস্পরবিরোধী উত্তাপ ও উপাদানগুলোকে সম্মুখে দাঁড় করেন; কিংবা যে ঔপন্যাসিক পৃথক আদর্শ বা মতবাদের জন্য অন্যকে অভিযুক্ত করতে পারেন না, বরং নিষ্ঠার সঙ্গে কোনো মতকে আঁকড়ে থাকার জন্য অন্যকে শ্রদ্ধা করেন, কিংবা যে ঔপন্যাসিক স্থান-কাল-পাত্র বুঝে ইতিহাস ও রাজনীতিচর্চায় 'চলতি হাওয়ারপন্থী' হতে পারেন না; একপেশে আর ভাগ-বিভাগ-বিভাজনের বাণী প্রচার করে শিল্পচর্চায় যে ঔপন্যাসিকের অনীহা, অরুচি ও বিরোধ। সেই ঔপন্যাসিক তো নিঃসঙ্গ হবেনই। নির্মোহ ও নিরাসক্তভাবে জীবন ও জাতীয় প্রেক্ষাপট-পরিপ্রেক্ষিতের রূপ-রূপান্তর রূপায়ণের জন্য তিনি তো কখনো কখনো কারো কারো কাছে অভিযুক্ত অথবা উপেক্ষিত হবেন। আর, এই অভিযোগ ও উপেক্ষার বিষয়টি উপলব্ধি করা যায় দুঃসময়ে।

খুব সম্ভব এমন অভিজ্ঞতা ও অভিমানেই তিনি ১৯৯২ সালের ২০ নভেম্বর পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার পর জীবনের অবশিষ্ট সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি-মিডিয়াকর্মীদের থেকে নিজেকে আড়াল করেছিলেন। সেসময় বন্ধুপ্রতীম শিক্ষাবিদ জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর উৎসাহে একটি টিভি চ্যানেল তার ওপর প্রামাণ্য চিত্র তৈরি করতে চাইলে তিনি রাজি হননি। ২৬ নভেম্বর ২০১১ ঢাকায় মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি একপ্রকার নিঃসঙ্গতাকেই বেছে নিয়েছিলেন।

অনেক সাহিত্যবোদ্ধাকে বলতে শুনেছি রশীদ করীমে রাজনৈতিক কমিটমেন্টের ঘাটতি রয়েছে, কেউবা বলেছেন তার লেখা বড্ড কমুনাল, কেউবা বলতে চেয়েছেন রশীদ করীমের জীবনার্থহীনতা ও জীবনবোধের দ্বিধা তাকে মহৎ ঔপন্যাসিক হতে দেয়নি।

সম্পূর্ণ বিপরীত বক্তব্য যে শুনিনি, পড়িনি, তাও নয়। কিন্তু, সত্য হলো রশীদ করীম আমাদের বাংলাদেশের কথাশিল্পের অগ্রগণ্য কথাশিল্পী এবং শক্তিশালী ঔপন্যাসিক। যারা পক্ষপাতদুষ্ট আর কল্পিত ও কাঙ্ক্ষিত ভাবনাকে আদর্শিক মাত্রায় উত্তীর্ণ করে প্রচার করতে চায়, শুধু তারাই রশীদ করীমকে ভুল বুঝবে, ভুল বুঝতে পারেন। তাদের জন্য রশীদ করীমের স্পষ্ট জবাব, 'আমি কোনো বাস্তবকে আদর্শায়িত করিনি অথবা কোনো আদর্শকে বাস্তবায়িত করিনি।' বস্তুত, এখানেই কথাশিল্পী রশীদ করীমের স্বাতন্ত্র্য প্রাতিস্বীকতার মূলকথা। আর তিশনাদের ভাঙা ভাঙা বাংলা বলার রহস্য-ব্যথা।

Comments

The Daily Star  | English

Govt forms 11-member media reform commission

Senior journalist Kamal Ahmed to lead the commission

28m ago