দ. এশিয়ায় খাদ্যের বিনিময়ে সাড়ে ৩ লাখ বই সংগ্রহ যুক্তরাষ্ট্রের

উপমহাদেশের বিভিন্ন ভাষার দুর্লভ বই এখন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক লাইব্রেরিতে পাওয়া যায়। নিজ দেশে হয়তো গুরুত্বপূর্ণ বইগুলোর আর কোনো ছাপা কপি নেই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অনেক লাইব্রেরিতে সেগুলো যত্ন সহকারে সংরক্ষণ করা আছে। সংরক্ষিত বইগুলোতে লেখা আছে পিএল ৪৮০ এর অধীনে সংগৃহীত।
যুক্তরাষ্ট্রের একটি লাইব্রেরি যেখানে পিএল ৪৮০ এর অধীনে সংগৃহীত বই আছে। ছবি: সংগৃহীত

উপমহাদেশের বিভিন্ন ভাষার দুর্লভ বই এখন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক লাইব্রেরিতে পাওয়া যায়। নিজ দেশে হয়তো গুরুত্বপূর্ণ বইগুলোর আর কোনো ছাপা কপি নেই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অনেক লাইব্রেরিতে সেগুলো যত্ন সহকারে সংরক্ষণ করা আছে। সংরক্ষিত বইগুলোতে লেখা আছে পিএল ৪৮০ এর অধীনে সংগৃহীত।

পিএল ৪৮০ মানে কী? এটি পাবলিক ল তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্যশস্য বণ্টন ব্যবস্থা সংক্রান্ত একটি আইন। একটু পরিষ্কার করে বললে, এই আইনের আওতায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপালসহ বেশ কিছু দেশে সাহায্য হিসেবে খাদ্য পাঠানো হতো। কিন্তু এর সঙ্গে বইয়ের যে সম্পর্ক আছে তা নিশ্চয়ই অনেককে অবাক করবে!

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপর বিশ্বজুড়ে খাদ্য ঘাটতি ও দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। তখন অর্থনীতিবিদ ম্যালথাসের 'পপুলেশন থিউরি' অনুসারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার খাদ্য উৎপাদনকে অতিক্রম করবে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্র তখন খাদ্যশস্য উৎপাদনে আগ্রহী হয়।

চাষীরা যেন উৎপাদিত খাদ্যের ন্যায্যমূল্য পায়, সেই চিন্তায় সরকারিভাবে কৃষকের কাছ থেকে শস্য কিনে মিত্র দেশগুলোকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৫৪ সালে আমেরিকার কংগ্রেস পিএল ৪৮০ নামে একটি আইন পাশ করে। এ আইনের মাধ্যমে বন্ধু রাষ্ট্রগুলোকে ধার কিংবা নগদ অর্থের বিনিময়ে খাদ্য বিক্রিসহ বিনামূল্যেও খাদ্য সহায়তার বিধান রাখা হয়।

একই সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থাৎ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের একাডেমিক বিষয়ে আগ্রহী হয়। এ বিষয়ে উচ্চতর গবেষণার উদ্দেশ্যে ১৯৪৭ সালে কার্নেগি করপোরেশনের সহায়তায় পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সাউথ এশিয়ান স্টাডিজে অগ্রগামী শিক্ষাদান ও গবেষণা কার্যক্রম প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। এই প্রোগ্রামটির জন্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরিগুলোর জন্য পর্যাপ্ত বই সংগ্রহের জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা চালানো হয়। যদিও প্রাথমিকভাবে বই সংগ্রহের ক্ষেত্রে অসংগঠিত ভারতীয় বই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ছিল হতাশাজনক কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটিও সাফল্যের মুখ দেখে।

এর আওতায় বই সংগ্রহ করতে গিয়ে যে সব সমস্যা দেখে দিয়েছিল সেগুলোর কয়েকটি হলো-বইগুলো পশ্চিমের লাইব্রেরির কর্মীদের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত এবং লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের ক্যাটালগেও কোনো তথ্য ছিল না। সংগৃহীত বইগুলোর শিরোনাম এবং লেখকদের মান যাচাই করা কঠিন ছিল। কারণ এর সঙ্গে কোনো গ্রন্থপঞ্জী বা বিবলিওগ্রাফি ছিল না।

লাইব্রেরিতে বই রাখার ধরন। ছবি: সংগৃহীত

এ ছাড়াও উপমহাদেশের বই বিক্রেতাদের অব্যবস্থাপনা যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরিগুলোর সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছিল। বিশেষ করে আঞ্চলিক ভাষার প্রকাশনা সংগ্রহ করা কঠিন ছিল।

যেমন কলকাতার একজন বাংলাভাষী বই বিক্রেতা সাধারণত তামিল বা গুজরাটি ভাষায় তথ্য দিতে সক্ষম ছিলেন না। অন্যদিকে ভারত বা পাকিস্তানের ডিলারদের কোনো জাতীয় নেটওয়ার্ক ছিল না।

সমস্যাগুলো নিরসনে সাউথ এশিয়া অব দ্য আমেরিকান কাউন্সিল এবং সোশ্যাল সায়েন্স রিসার্চ কাউন্সিল একটি যৌথ কমিটি গঠন করে যার উদ্দেশ্য ছিল এ সংক্রান্ত সমস্যাগুলোর সমাধানে সুপারিশ প্রণয়ন করা। 

কমিটি ১৯৫৭ সালে মার্কিন যেসব লাইব্রেরি দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে কাজ করে, তাদের নিয়ে একটি সম্মেলন আহ্বান করে, যা লাইব্রেরি অব কংগ্রেসে অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে সে দেশের পণ্ডিত-বিশেষজ্ঞ এবং গ্রন্থাগারিকদের সমন্বয়ে দক্ষিণ এশিয়া জন্য আমেরিকান লাইব্রেরি রিসোর্সেস কমিটি এশিয়া (CALROSA) নামের আরেকটি স্ট্যান্ডিং কমিটি গঠন করে। 

কমিটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একক কাজ ছিল দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একটি জাতীয় অধিগ্রহণ কর্মসূচির পরিকল্পনা প্রণয়ন করা, যা বিশ্ববিদ্যালয় ও লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের মধ্যে সমন্বয় করবে। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় পিএল ৪৮০ অধীনে উপমহাদেশকে যে গম দেওয়া হয়, তার মাধ্যমে আমেরিকা যে অর্থ আয় করে সেই অর্থ থেকে লাইব্রেরিগুলোর জন্য ভারতীয় বই কিনতে বরাদ্দ নেওয়া হবে।

১৯৫৫ সাল থেকে পিএল ৪৮০ এর অধীনে উপমহাদেশের দেশগুলোতে যে গম ও অন্যান্য সামগ্রী দেওয়া হচ্ছিল, চুক্তি অনুসারে দেশগুলোকে তার মূল্য পরিশোধ করার কথা। কিন্তু দেশগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা স্বল্পতার কারণে এর পরিবর্তে সাহায্যপ্রাপ্ত দেশগুলো সমপরিমাণ দেশীয় অর্থ ব্যাংকে জমা রাখার সিদ্ধান্ত ছিল। সেই অর্থ দিয়ে উপমহাদেশে প্রকাশিত সব বইয়ের কপি যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।

বই সংগ্রহ করে লাইব্রেরি অব কংগ্রেসে পাঠানো হতো। সেখান থেকে ক্যাটালগে অন্তর্ভুক্ত করে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। ১৯৫৮ সালে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করে বই সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হয় লাইব্রেরি অব কংগ্রেসকে। এর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট পিএল ৪৮০ এর আওতায় সংগৃহীত অর্থ থেকে ৮৪ হাজার ডলার প্রদান করে। 

সংগৃহীত বইগুলো ভৌগলিক দূরত্ব বিবেচনা করে ৩টি প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়। সেগুলো হলো-ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভেনিয়া, মিড ওয়েস্ট ইন্টার লাইব্রেরি সেন্টার ইন শিকাগো এবং ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে। এই কার্যক্রম পরিচালনার জন্য উপমহাদেশের দেশগুলোতে স্থানীয়ভাবে জনবল নিয়োগ করা হয়।

কিছু দিনের মধ্যেই এই প্রোগ্রামে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া (বার্কলে), ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো, কর্নেল ইউনিভার্সিটি, ডিউক ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াই, ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটা, ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন, ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন এবং ইয়েল ইউনিভার্সিটি, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়, মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়, সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়, ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় যোগ দেয় এবং ১৯৬৩ সালে আরও ৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি এবং নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

এতে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন লাইব্রেরি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং নেপালের প্রায় ৩ লাখ ৫০ হাজার বই সংগ্রহ করা হয়। যার মধ্যে হিন্দি ২০ ভাগ, বাংলা ১৫ ভাগ, উর্দু ১৩ ভাগ এবং তামিল ১১ ভাগ। বইগুলোর বেশিরভাগ ছিল সাহিত্য, ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস এবং রাজনীতি বিষয়ক। এই প্রোগ্রামের অধীনে দৈনিক সংবাদপত্র থেকে শুরু করে সূক্ষ্ম শিল্প, ১৫ শতকের পুরোনো হিন্দি এবং সংস্কৃত গ্রন্থের মতো মূল্যবান গ্রন্থের অনুলিপিও সরবরাহ করা হয়েছিল। এই প্রোগ্রামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল ৮ শতক থেকে ২০ শতক পর্যন্ত তিব্বতি সাহিত্যের পুনর্মুদ্রণ ভারত থেকে সংগ্রহ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো।

এ ছাড়াও পিএল ৪৮০ অধীনে সংগৃহীত স্থানীয় মুদ্রা ব্যয় করে উপমহাদেশের প্রকাশকদের মাধ্যমে ইংরেজি ভাষায় বিজ্ঞানের বই স্থানীয়ভাবে মুদ্রণ করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিতরণ করা হতো।

বই সংগ্রহের এই কার্যক্রম ১৯৫৮ সালে শুরু হয় ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত চলে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি হলে ১৯৭১ সালের পর ভারত এই চুক্তি থেকে বের হয়ে আসে। তবে স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ এই চুক্তির আওতায় গমসহ নানা ধরণের সামগ্রী সাহায্য হিসেবে পেতে থাকে।

এখানে ঐতিহাসিক একটি ঘটনা উল্লেখ না করা প্রয়োজন। পিএল ৪৮০ আইনে বন্ধুরাষ্ট্র বলতে বোঝানো হয় যারা কমিউনিস্ট দেশ নয় এবং যারা কমিউনিস্ট দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করে না।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে যে দেশগুলো অকৃত্রিম বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল কিউবা তাদের অন্যতম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে কিউবার ফিদেল কাস্ত্রোর দৃঢ় বন্ধুত্ব ছিল। ১৯৭৩ সালে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে তিনি আলজিয়ার্স যান এবং কিউবায় বাংলাদেশের পাট রপ্তানির সিদ্ধান্ত নেন। যুক্তরাষ্ট্রে তখন চলছে কিউবা ফোবিয়া। সমাজতান্ত্রিক কিউবার সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্পর্কের অজুহাতে তখন পিএল ৪৮০ এর গম ভর্তি জাহাজ ফিরিয়ে নেয় মার্কিন প্রশাসন, যা ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষের একটি অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। 

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, অমর্ত্য সেন তার গবেষণায় সেই দুর্ভিক্ষকে সরবরাহ ঘাটতি এবং চাপিয়ে দেওয়া দুর্ভিক্ষ হিসেবে অভিহিত করেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডি এই পিএল ৪৮০ কে 'শান্তির জন্য খাদ্য' নামে অভিহিত করেন। ১৯৭৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এই আইনের পরিসমাপ্তি ঘটে।

১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট বলেছিলেন, 'মানুষের মনের যুদ্ধে বই হলো বুলেট। মানুষ মরে, কিন্তু বই কখনো মরে না। বইকে আগুন দিয়ে মেরে ফেলা যায় না।'

সত্যিকার অর্থ আমেরিকানরা এটা শুধু বলেই না, তারা এটা ধারণ করে বলেই উপমহাদেশের বই সংগ্রহে এতটা পথ পাড়ি দিতে পেরেছে তারা।

তথ্য সহায়ক

1. The South Asian P.L. 480 Library Program, 1962-1968 Author(s): Maureen L. P. Patterson Source: The Journal of Asian Studies , Aug., 1969, Vol. 28, No. 4 (Aug., 1969), pp. 743- 754

2. David Helscher, Public Law 480, American Agriculture and World Food Demand, 10 Case W. Res. J. Int'l L.
739 (1978)

3. Food Bungle in Bangladesh Author(s): Donald F. McHenry and Kai Bird Source: Foreign Policy , Summer, 1977, No. 27 (Summer, 1977), pp. 72-88 Published by: Slate Group, LLC

আবদুল্লাহ জাহিদ: আবদুল্লাহ জাহিদ লেখক, অনুবাদক ও ব্যবস্থাপক, কুইন্স পাবলিক লাইব্রেরি নিউ ইয়র্ককের হলিস শাখা
myshathi@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English
Effects of global warming on Dhaka's temperature rise

Dhaka getting hotter

Dhaka is now one of the fastest-warming cities in the world, as it has seen a staggering 97 percent rise in the number of days with temperature above 35 degrees Celsius over the last three decades.

10h ago