শতবর্ষের ঐতিহ্যের এক গ্রাম্য বৈশাখী মেলা

মেলা
মেলায় আগত নারীরা হরেক রকম জিনিসপত্র কিনছেন।

ক্লান্ত শ্রান্ত রুদ্র মধ্য দুপুর। বৈশাখের তপ্ত সেই মধ্য দুপুরেই দেখা গেল গ্রামের ফসলের খেতের আইল-মেঠোপথ ধরে আশপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে মানুষ আসছেন। উদ্দেশ্য— গ্রামের মেলা। কেউ বা ততক্ষণে আবার কেনাকাটা সেরে বাড়ির পথও ধরেছেন। তাদের হাতে মেলা থেকে কেনা নানা সামগ্রী।

গ্রামটির নাম কাউয়ার বিল। অবস্থান মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার মহাদেবপুর ইউনিয়নে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গ্রামের একটি বটগাছকে কেন্দ্র করে গত সাড়ে ৩০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চৈত্র মাসের শেষ দিনে ও বৈশাখ মাসের প্রথম দিনে গ্রামটিতে বৈশাখী মেলা পালিত হয়ে আসছে। নতুন বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী বর্তমানে মেলাটি পালিত হয় পহেলা বৈশাখ ও পরের দিন।

বাঁশ ও বেতের পণ্য
বাঁশ ও বেতের তৈরি হরেক রকম পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা।

গত মঙ্গলবার কাউয়ার বিল গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামজুড়ে উৎসবের আমেজ। মেলা উপলক্ষে গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই অতিথিরা বেড়াতে এসেছেন।

গ্রামের বাসিন্দা মহিউদ্দিন বলেন, 'অহন তো প্রতি ঘরে ঘরে মেহমান। আত্মীয়-স্বজন সব আমগো বাড়িতে বেড়াইবার আসে। ঈদের সময়েও গ্রামে এত আনন্দ হয় না, যতটা মেলার সময় হয়।'

গ্রামটি ঘুরতে গিয়ে চোখে পড়ল গ্রামের কোনো উঠানে মিষ্টির মেলা বসেছে, তো কোনো উঠানের পাশে বসেছে মেয়েদের সাজগোজের পণ্য, কোথাও বা সারি বেঁধে বিক্রেতারা বসেছেন খই, বাতাসা আর গুড় নিয়ে। কোথাও আবার বসেছে বাঁশ ও বেতের তৈরি নানান কৃষিজ পণ্যের দোকান। আবার কোনো বাড়ির পেছনের খালি জায়গায় কুমারেরা বসেছেন মাটির তৈজসপত্র নিয়ে। এ সমস্ত দৃশ্যই বৈশাখী মেলাকে কেন্দ্র করে।

মেলায় আগত দর্শনার্থী, গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সারা বছর ধরে এই দুটি দিনের অপেক্ষাতেই থাকেন গ্রামটি ও আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দারা। গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মেলাকে উপলক্ষ করে নারীরা শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়িতে 'নাইওর' এসেছেন। তাদেরই একজন রোকসানা আক্তার। চৈত্র সংক্রান্তির দিনে শ্বশুরবাড়ি থেকে নাইওর এসেছিলেন রোকসানা।

রোকসানা বললেন, 'বছরের অন্য সময়েও বাড়িতে আসি, কিন্তু মেলার সময়ের মতো এত ভালো লাগে না। ঈদে চান্দে কেউ কেউ বাড়িতে আসে, তবে আমরা কি আর শ্বশুরবাড়ি ফালাইয়া আসবার পারি? মেলার সময়ই সকলের লগে দেখা-সাক্ষাৎ হয়। সইগো লগেও বছরে খালি মেলার সময়ই দেখা হয়।'

মেলা
মেলায় আগত এক শিশু।

রোকসানার সঙ্গে কথা বলার সময় তার চোখে-মুখে আনন্দের ঝলক লক্ষ করি। রোকসানা বললেন, একটু পরেই তারা সইরা মিলে মেলায় কেনাকাটা করতে যাবেন।

মেলাকে কেন্দ্র করে শিশু-কিশোরদের উচ্ছ্বাস ও উৎসাহের যেন কমতি নেই। শিশুরা এসেছে বাবা মা, দাদা-নানার হাত ধরে। কিশোর-কিশোরীরা সমবয়সী বন্ধু-বান্ধব নিয়ে। কেউ বা এসেছে পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়েও।

গ্রামের একটি বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির উঠোন জুড়ে মিষ্টির মেলা বসেছে। চৌকির ওপর বসে মিষ্টি বিক্রেতারা সামনে রাখা বোল থেকে মিষ্টি বিক্রি করছেন। সামর্থ্য অনুযায়ী কেউ কিনছেন আধা কেজি, আবার কেউ কিনছেন গোটা দশ কেজি। কেউ আবার দলেবলে বন্ধু বান্ধব নিয়ে মিষ্টি খেতে উঠোনেই বসে পড়েছেন।

৯ জনের একটি বন্ধুর দলকে পাওয়া গেল সেখানে। তারা দেড় কেজি মিষ্টি কিনে ততক্ষণে বসে পড়েছিলেন উঠোনে। আড্ডা আর কথাবার্তার ফাঁকে আঙুল দিয়ে মিষ্টি উঠিয়ে মুখে পুরতে পুরতে ঠাট্টা রসিকতার সঙ্গে সঙ্গে একে অন্যের গায়ে যেন লুটিয়ে পড়ছিলেন। রসে টইটুম্বুর মিষ্টি পেটে চালান করার কোন ফাঁকে যে দেড় কেজি মিষ্টি শেষ হয়ে গেল টেরই পেলেন না তারা। সঙ্গে সঙ্গে আরও এক কেজি মিষ্টি দিতে বললেন সেই বন্ধুদের কেউ কেউ।

তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তারা পাশের গ্রাম থেকেই এসেছেন।

বন্ধুদের একজন হাবিবুর রহমান বললেন, 'বন্ধুবান্ধব লইয়া মেলায় মিষ্টি খাওনের কোনো তুলনা নাই। একসময় তো আমরা বাজি ধইরা একেকজনে কেজি খানিক মিষ্টি খাইতাম।'

বন্ধু-বান্ধবদের রসিকতার মধ্যেই একজন আরেকজনকে পিঠে হাত দিয়ে বললেন, 'উনি হইলো আমগো দুলাভাই। খাওনের মাস্টার। আমগো বইন বিয়া দিছি খালি খাওন দেইখা!'

দোকান
মেলায় বসেছিল নানান মিষ্টান্নের দোকান।

যে বটগাছকে কেন্দ্র করে এই মেলার উৎপত্তি, সেই বটগাছ পার্শ্ববর্তী রাস্তায় দাঁড়িয়ে চটের বস্তায় করে খই, বাতাসা, চিনির ছাঁচ ও গুড় বিক্রি করছিলেন বিক্রেতারা। বিক্রি হচ্ছিল বিন্নি ধানের খইও। স্থানীয়রা বললেন, এক সময় গ্রামের ঘরে ঘরে বিন্নি খই পাওয়া গেলেও এখন বিন্নির খই প্রায় দুর্লভই বলা যায়। কদাচিৎ মেলাতেই উঠে বিন্নি খই। ২৫০ থেকে ৮০০ টাকা দরে বিক্রি হওয়া বিন্নির খই নিয়েও ক্রেতা বিক্রেতার মধ্যে চলছিল বিস্তর দর কষাকষি।

অপেক্ষাকৃত কম মূল্যের বিন্নির খই কিনতেও নানা কৌশল রয়েছে ক্রেতার। কারণ অপেক্ষাকৃত কম দামের খইয়ে চালের আধিক্য থাকে। ক্রেতারা তাই সদা সতর্ক। দেখা গেল বিক্রেতা খইয়ের দাম বললেন ৪০০ টাকা কেজি। ক্রেতা তাতেই রাজি। তবে শর্তারোপ করলেন, তিনি নিজে বেছে খই নেবেন। তখন বিক্রেতা নারাজি প্রকাশ করে বললেন, তাতে ৬০০ টাকা দাম দিতে হবে। শেষমেশ দর কষাকষিতে তা ৫০০ টাকায় এসে ঠেকে। আর তাতেও যেন দুজনেই নিমরাজি। শেষমেশ খই ওজন করতে গিয়েও চলল নানা বাকবিতণ্ডা। তবে তা সাময়িক। দামের তর্ক-বিতর্কে কী আর আসে যায়! ক্ষণিকের তর্ক-বিতর্ক শেষে ক্রেতা-বিক্রেতা একে অপরকে বাড়ির কুশলাদিও জিজ্ঞেস করতে দেখা গেল।

গ্রামের একটি বাড়ির উঠোনের সামনে দেখা গেল আলতা, চুড়ি, লেইস ফিতা, সিঁদুর কৌটা, টিপসহ মেয়েদের নানা সাজগোজের পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসে আছেন কয়েকজন বিক্রেতা। বিক্রেতাদের সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে রুদ্রাক্ষ মালা, পূজার ঘণ্টা, সিঁদুর দানি, কাঁসার বাসনকোসনসহ নানা পণ্য। এখানে আগত ক্রেতাদের মধ্যে সবাই নানা বয়সী নারী।

মেলা

ক্রেতা বিক্রেতার দরদামের এক ফাঁকে কথা হলো মেলায় আগত ক্রেতা রেখা রাণীর সঙ্গে। কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, তার বাবার বাড়ি এই গ্রামে হলেও শ্বশুরবাড়ি ঢাকায়। মেলার আগের আগে তিনি নাইওর এসেছেন।

বললেন, 'মেলার সময় বাড়িতে না আসলে মনে হয়, অনেক কিছু হারালাম।'

জানালেন, তার আগ্রহেই শ্বশুরবাড়ি থেকে এসেছেন তার ননদও। রেখা রাণীর কথা শুনে হেসে উঠেন তার পাশেই থাকা ননদ ঊষা ভৌমিক।

তিনি বললেন, 'আমাদের বাড়িতে বউদি সবসময়ই এই মেলার গল্প করেন। দেখার খুব ইচ্ছে ছিল এখানে মেলা কেমন হয়। এখানে এসে গ্রামের মেলা দেখে মুগ্ধ হয়েছি। চারপাশ এত সুন্দর আর উৎসব উৎসব ভাব।'

মেলার এক প্রান্তে একটি বাড়ির পথের দুপাশে বাঁশ ও বেতের গৃহস্থালি ও কৃষিজসামগ্রী নিয়ে বসে ছিলেন কয়েকজন বিক্রেতা। এসব সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে ধান মাপার জন্য ব্যবহৃত বেতের আড়ি, বেত ও বাঁশের তৈরি ঝুড়ি ও ঢাকনা, তাল পাখা, ফুল লতাপাতায় বুনন নকশী পাখা, মাথাল, বাঁশের চোঙাসহ নানান পণ্য। এক কৃষককে দেখা গেল মাথাল কিনতে। জানালেন, খেতে কাজ করার সময় প্রখর রোদে এই মাথাল বেশ কাজে দেবে। মেলার মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে দেখা গেল কোনো কোনো দোকানে বসে চলছিল অতিথি আপ্যায়নের পর্বও।

মেলাজুড়ে যেন শিশু-কিশোরদের পদচারণা। মেলাকে কেন্দ্র করে তাদের উৎসাহেরও যেন কমতি নেই। এক জায়গায় তরমুজ বিক্রি হচ্ছিল। পাশেই বসা কয়েকজন কিশোর দুটি তরমুজ কিনে কেটে নিজেরাই নিজেদের মধ্যে ভাগ করে খাচ্ছিল।

গ্রাম্য এই মেলাটি কতটা সম্প্রীতির চিত্র বহন করে তা দেখা গেল ভিউকার্ডের দোকানে এসে। একপাশে কাবা শরীফের দৃশ্য তো অন্য পাশে শিব-দূর্গার ছবি রাখা। কোথাও বা আবার নানান প্রাকৃতিক চিত্রের ছবি ঝোলানো।

জিলাপি
ভাজা হচ্ছে গরম গরম জিলাপি।

সংকটে কুমাররা

ঘুরতে ঘুরতে আমরা এগিয়ে যাই আরেকটি বাড়ির দিকে। বাড়ির শেষপ্রান্তে পৌঁছাতেই দেখা গেল খালি জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে মাটির তৈজসপত্র বিক্রি করছেন মেলায় আগত কুমাররা। মাটির তৈরি হাঁড়িপাতিল থেকে শুরু করে ধুপদানী, পেয়ালা, কয়েলের স্ট্যান্ড, নানা ধরনের পুতুল, এমনকি মাটির খোলাও বিক্রি হচ্ছে সেখানে।

ঘিওর উপজেলার পেচারকান্দা গ্রাম থেকে মেলায় মাটির তৈজসপত্র নিয়ে এসেছেন হরেন পাল। জানালেন, কয়েক পুরুষ ধরে বংশ পরম্পরায় তারা মাটির তৈজসপত্র বিক্রি করছেন।

তিনি বললেন, 'আগে তো মেলায় যে মানুষ আসত, মাটির জিনিস দিয়া কুলাইবার পারতাম না। আর এখন তো বিক্রিবাট্টা কম। সব প্লাস্টিকে খাইল। মেলায় তো যা বিক্রি হয়, সারা বছর বিক্রিবাট্টা আরও কম। কোনোমতে দিন কাইটা যায়।'

মেলা ছাড়া অন্য সময়ে মাটির তৈজসপত্র বিক্রি হলেও মাটির খেলনা কেবল বিক্রি হয় মেলাতেই—জানালেন এক কুমার।

মেলায় আগত তেমনই এক মাটির খেলনা বিক্রেতা গোবিন্দ পাল। ঘিওরের নালী গ্রাম থেকে আসা গোবিন্দ পাল গত ৩০ বছর ধরে প্রতি বছরই এই মেলায় আসছেন। গোবিন্দ পালের সামনে তখন ছড়ানো ছিটানো মাটির তৈরি পাখি, গ্রাম্য বধূ, হাতি-ঘোড়ার খেলনা।

গোবিন্দ পাল বললেন, 'মেলা ধইরাই আমরা এখনো টিক্কা রইছি। নয়তো অন্য সময় তো বেচাবিক্রি নাই। মেলার সময় এখন এই কিছু খেলনাপাতি বানাইলাম। মেলা বাদে ভাত কাপড় জোগাইতেই খবর হইয়া যায়।'

কুমারদের বিক্রি বাট্টা দেখতে দেখতে চোখ পড়ে ভিন্ন একটি জায়গায়। সেখানে বয়স্করা মাটিতে পাটি পেতে আড্ডা জমিয়েছেন। নিজেদের মধ্যে খুনসুটিতেও ব্যস্ত কেউ কেউ। তাদের সঙ্গে আলাপ জমাই। এক পর্যায়ে আড্ডা জমে ওঠে।

কথা প্রসঙ্গে জুনিকালসা গ্রামের বাসিন্দা ৮০ বছরের বেশি বয়সী ওবায়েদ উল্লাহ নিজের শৈশব আর বর্তমানের কথা বলতে গিয়ে বললেন, 'ছোটবেলায় দাদার হাত ধইরা মেলায় আসতাম। এখন আমি দাদা হইছি। নাতিরে নিয়া মেলায় আসছি। আল্লায় চাইলে এক সময় আমার নাতিও হয়তো দাদা হইব। সেও হের নাতিরে নিয়ে আইব।'

সময়ের ব্যবধানে মেলায় কেমন পার্থক্য দেখতে পান জানতে চাই সিংগারডাক গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা আবদুল আউয়ালের কাছে।

তিনি বলেন, 'আগে মেলায় আরও বেশি মানুষ হইতো। এখন তুলনামূলক কম। এখন তো জায়গায় জায়গায় বাজার হইছে। বাড়িতে বাড়িতে দোকান আছে। আগে এই মেলার লাইগা আমরা পুরো বছর অপেক্ষায় থাকতাম। বহু দূর থেইকা মানুষ আসত। সবাইর লগে তো আর সবসময় দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। মেলা উপলক্ষে এই যেমন সবার লগে দেখা সাক্ষাৎ হইল।'

এবার আমাদের ফেরার পালা। মেলা থেকে বের হতেই দেখা গেল দূর-দিগন্তে পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবছে। মেলায় আগত মানুষজন খেতের আইল ধরে মেলা থেকে বাড়ি ফিরছেন। তাদের হাতে মেলা থেকে কেনা নানা সামগ্রী। তবে এই চিত্র কেবল এই বছরেরই নয়, বছরের পর বছর ধরে একই দৃশ্য বহন করে চলেছে কাউয়ার বিলের গ্রাম্য এই মেলাটি।

ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক

 

 

Comments

The Daily Star  | English
China urges US for fair trade talks

China warns countries against striking trade deals with US at its expense

Beijing "will take countermeasures in a resolute and reciprocal manner" if any country sought such deals, a ministry spokesperson said

1h ago