স্বাধীন দেশে প্রথম নববর্ষ

১৯৭২ সালে নববর্ষ
১৯৭২ সালের ১৪ এপ্রিল রাজধানীর রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। ছবি: সংগৃহীত

ঠিক পূর্ববর্তী বছরের এই সময়ে দেশব্যাপী চলছিল মুক্তিযুদ্ধ। মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার তাগিদে রণাঙ্গনে হাজারো বীর সেনা।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলায় দেশের কোথাও বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হয়নি। নিভৃতেই কেটেছিল নববর্ষের দিনটি। ছিল না বর্ষবরণের আয়োজন।

মুক্তিযুদ্ধের বছর নববর্ষের আয়োজন না থাকায় কবি মুস্তফা আনোয়ার 'বৈশাখের রুদ্র জামা'  শিরোনামে লিখেছিলেন ২১ লাইনের এক কবিতা। কবিতাটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়েছিল। কবিতাটির প্রথম কয়েকটি চরণ ছিল এমন—

'বৈশাখের রুদ্র জামা আমাকে পরিয়ে দে মা  

আমি তোর উজাড় ভাঁড়ারে বারুদের গন্ধ বুক ভরে নেব।

এখন তোর ভীষণ রোগ, গায়ে চুলো গন্ গন্ করছে,

আমাকে পুড়িয়ে দিলি মা।'

মুক্তিযুদ্ধের বছর রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণের অনুষ্ঠান না হওয়ায় ছায়ানটের অন্যতম সংগঠক ও শিল্পী সনজীদা খাতুন নববর্ষের দিন সাভারে একটি মাটির ঘরে রমনার বটমূল কল্পনা করে নিজের সন্তানদের নিয়ে গান গেয়ে পারিবারিকভাবে নববর্ষের দিনটি উদযাপন করেছিলেন।

সনজীদা খাতুন একাত্তরের পহেলা বৈশাখ নিয়ে লিখেছিলেন, 'রমনায় এবার পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান হয়নি পহেলা বৈশাখ পালিত হবে না এটি আমি কখনো কল্পনাতেও আনতে পারি না।'

১৯৭২ সালে নববর্ষ
সদ্য স্বাধীন দেশে নববর্ষ উপলক্ষে দৈনিক বাংলার ‘নববর্ষ সংখ্যা’। ছবি: সংগৃহীত

এক বছরের ব্যবধানে পহেলা বৈশাখ স্বাধীন দেশে দারুণ সাড়ম্বরে উদযাপিত হয়। স্বাধীন দেশে প্রথম নববর্ষ উদযাপিত হয় ১৪ এপ্রিল, শুক্রবার। মাত্র চার ৪ আগে দেশ স্বাধীন হওয়ায় স্বাধীন দেশের প্রথম নববর্ষে মানুষের আনন্দ আর উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো।

১৯৭২ সালের ১৩ এপ্রিল রাত ১২টার কাঁটা অতিক্রম করা মাত্রই রাজধানী ঢাকার বেশ কয়েকটি এলাকায় বাজি ফুটিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়। মধ্যরাত থেকেই স্বাধীন দেশে নববর্ষ উদযাপন চলতে থাকে।

স্বাধীন দেশে নববর্ষের প্রথম দিনে রমনা বটমূলে ছায়ানটের উদ্যোগে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। সেদিন সকাল ৭টায় সনজীদা খাতুনের নেতৃত্বে ছায়ানটের শিল্পীরা রমনা বটমূলে সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে নতুন বছরকে স্বাগত জানান।

এছাড়া, নববর্ষের প্রথম দিনে নজরুল একাডেমী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে নববর্ষ, বৈশাখ, শান্তি ও প্রগতি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও অন্যান্য কবিদের রচনার ওপর ভিত্তি করে সংগীত পরিবেশিত হয়।

সেদিন নববর্ষ উপলক্ষে বাংলা একাডেমীতে আয়োজিত হয়েছিল বর্ষবরণের অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী বলেন, 'যে দিন বাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষের মুখে হাসি ফুটবে সে দিন আমাদের বর্ষবরণ সত্যিকার অর্থে সার্থক হবে।'

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছিলেন বাংলা একাডেমীর পরিচালক কবীর চৌধুরী।

সেদিন ঢাকার রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া সংগঠন এবং ছাত্র ও যুব সংগঠনগুলো নববর্ষ উপলক্ষে বিশেষ কর্মসূচি হাতে নেয়।

১৯৭২ সালে নববর্ষ
১৯৭২ সালে নজরুল একাডেমীতে নববর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে একাডেমীর শিল্পীরা। ছবি: সংগৃহীত

নববর্ষ উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে বিশেষ বাণী দেন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, 'আজ পহেলা বৈশাখ। আজ হতে শুরু হল আর একটি শুভ নববর্ষের- ১৩৭৯ বাংলা সালের। সেই সঙ্গে বাঙ্গালীর এক যুগের অপরিসীম দুঃখ আর ত্যাগের সাক্ষ্য বহনকারী ১৯৭৮ সাল মহাকালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেল। কিন্তু বিভিন্ন কারণে বিগত এই ১৩৭৮ সাল মানবতিহাসে চির উজ্জ্বল চির-অম্লান হয়ে থাকবে। কারণ সেই সালেই সাড়ে ৭ কোটি বাঙ্গালী ৩০ লক্ষ অমূল্য প্রাণের বিনিময়ে তাদের অনেক সাধের স্বাধীনতা লাভ করেছে।'

বঙ্গবন্ধু জাতি, ধর্ম ও দলমত নির্বিশেষে সব শ্রেণির জনগণের প্রতি দেশের দুর্গত মানুষের কল্যাণে নিজেদেরকে উৎসর্গ করার জন্য সংকল্পবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, 'আসুন, নববর্ষের শুভ লগ্নে সোনার বাংলা গড়ার শপথ নিই।'

নববর্ষের প্রথম দিন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী থেকে সর্বস্তরের মানুষ ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানায়। ঢাকার বাইরে থেকেও বিপুল সংখ্যক জনতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য তার বাসায় আসে। বঙ্গবন্ধু উপস্থিত সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন।

সেদিন নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময়ের জন্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে একদল শিল্পী গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎ শেষে তারা গণভবনে সংগীত পরিবেশন করেন।

স্বাধীন দেশে নববর্ষের প্রথম দিনে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডায় শান্তি-শৃঙ্খলা, উন্নতি কামনা করে বিশেষ দোয়া ও প্রার্থনা হয়।

১৯৭২ সালে নববর্ষ
১৯৭২ সালে নববর্ষ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে সংগীত পরিবেশন করছেন ছাত্রীরা। ছবি: সংগৃহীত

নববর্ষের প্রথম দিনে তথা ১৪ এপ্রিল দৈনিক বাংলার প্রধান শিরোনাম ছিল, 'রক্তস্নাত বাংলায় নববর্ষ এসেছে।' দৈনিক ইত্তেফাকের প্রধান শিরোনাম ছিল 'হে নূতন দেখা দিক/ আরবার/ জন্মের প্রথম শুভ'খন'।

ইত্তেফাকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, 'এতো এক চিরন্তন সত্য বার বার ফিরে ফিরে আসা, এই বাংলায় যেমন অজস্র সূর্যোদয় পূর্ণবার ঘুরে আসে একটি বছর, সেই রক্তিম দিনলিপির অমল চিত্রাবলি ১লা বৈশাখ। সুপ্রভাত, শুভ নববর্ষ…।'

এতে আরও বলা হয়—'আজ ১লা বৈশাখ। স্বাধীন বাংলাদেশের বিমুক্ত বিশাল শ্যামল অঙ্গনে আজ স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশের প্রথম নববর্ষ পালিত হইতেছে। বাঙ্গালী জাতীয় জীবনে আজিকার এই নববর্ষ উৎসব একটি জাতীয় উৎসব হিসাবে পরিগণিত হইয়াছে। আজ তাই সরকারী ছুটি। …বিগত বৈশাখের এই শুভ দিনটিকে আমরা বরণ করিতে পারি নাই; কারণ গত বৈশাখের এই পবিত্র দিনটি স্বৈরাচারী পাঞ্জাবী শাসক চক্রের হাতে ছিল বন্দী। বিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশে আজ হয়তো আমরা রঙ-বেরঙের রঙীন বাহারে নববর্ষকে সাদরে আহ্বান জানাইতে পারিব না, কিন্তু নিঃসন্দেহে বাংলার একটি মানুষের প্রাণেও এই শুভ দিনটিকে বরণ করিতে আবেগের আর প্রেরণার অন্ত নাই।'

নববর্ষ উপলক্ষে সেদিন দেশের প্রধান সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। সেদিন দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকায় নববর্ষ উপলক্ষে বিশেষ ক্রোড়পত্র 'নববর্ষ সংখ্যা ১৩৭৯' প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত নববর্ষ সংখ্যার ক্রোড়পত্রের প্রচ্ছদচিত্রে তুলে ধরা হয় 'পালকি, বংশীবাদক, ঢেঁকিতে ধান ভানা, কুলাসহ দেশীয় ঐতিহ্যের প্রতীক।

পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে দৈনিক ইত্তেফাক 'হে নূতন, এসো তুমি/ সম্পূর্ণ গগন পূর্ণ করি/ পুঞ্জ পুঞ্জ রূপে' শিরোনামে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। সেদিন বাংলার বাণীও একই শিরোনামে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে।

ইত্তেফাকে সেদিন 'নববর্ষঃ নতুন সূর্যঃ নতুন শপথ' শিরোনামে সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। এতে নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে নতুন আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়। বলা হয়, 'একটি রক্তঝরা বেদনাভরা অথচ আনন্দ বিহ্বল বৎসর দেখিতে দেখিতে কাটিয়া গেল। স্বাধীনতার নবঊষার স্বর্ণালোকে ঝলসিত শ্যামল বাংলার অবারিত প্রান্তরে আরেকটি নতুন বছরের নতুন সূর্য মাথা তুলিয়াছে। …সৃষ্টির প্রয়োজনেই ঘুণেধরা, অতীতকে জনগণ ভাঙ্গিয়া চুরমার করিয়াছে। সেই ধ্বংসের পালা শেষ হইয়াছে। এবার সৃষ্টির পালা।'

১৯৭২ সালে নববর্ষ
১৯৭২ সালে নববর্ষ উপলক্ষে দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত বিজ্ঞাপন। ছবি: সংগৃহীত

ইত্তেফাকে 'একাত্তরের বৈশাখ' শিরোনামে আনোয়ারা বেগমের লেখা কবিতা প্রকাশিত হয়।

স্বাধীন দেশে নববর্ষের প্রথম দিনে অসংখ্য মানুষ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে পুস্পার্ঘ অর্পণের মধ্য দিয়ে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।

নববর্ষের প্রথম দিনে প্রতিটি জাতীয় দৈনিকেই ছিল নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে বিজ্ঞাপন।

ইত্তেফাকে প্রকাশিত মোজাহের ঔষধালয়ের বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল, 'বাংলাদেশের প্রথম বাংলা নববর্ষ দিনে সকলকে জানাই আমাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা। জনতা ব্যাংকের বিজ্ঞাপনে লেখা হয়—'নবযাত্রায় নব সংকল্পে বরণ করি নববর্ষ'। উত্তরা ব্যাংকের বিজ্ঞাপনে লেখাছিল, 'নবরূপে নতুন দেশে'।

১৬ এপ্রিল দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকায় পহেলা বৈশাখ উদযাপন নিয়ে 'দেশ গড়ার শপথ নিয়ে নববর্ষ উদযাপন' শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়, 'বাংলাদেশের আপামর মানুষ পুরাতন বছরের বেদনাদায়ক স্মৃতি মুছে ফেলে, নতুন বছরে দেশ গড়ার শপথ নিয়ে নববর্ষ ১৩৭৯ সালকে বরণ করে নিয়েছে। এ বছর পহেলা বৈশাখ যে আবেদন বাংলার মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করেছিল, তা এর আগে কোনদিন হয়নি। পুরাতন বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে সোনার বাংলা গড়ার সঠিক পথের সন্ধান লাভ করাই ছিল এই বছর নববর্ষ উদযাপনের ব্যাপকতার মূল লক্ষ্য। এই প্রথম পহেলা বৈশাখ জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে পালিত হলো।'

নববর্ষের প্রথম দিনে সকাল থেকেই রাজধানীর মিষ্টির দোকানগুলোয় ভিড় দেখা গিয়েছিল। দুপুরের আগেই রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকার দোকানে মিষ্টি বিক্রি হয়ে যায়।

মুক্ত স্বদেশে নববর্ষের প্রথম দিনটি উৎসবমুখরভাবে উদযাপিত হয়েছিল। অগণিত আত্মত্যাগের বিনিময়ে সদ্য স্বাধীন দেশে নববর্ষ এসেছিল ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য আনন্দের বার্তা হয়ে।

তথ্যসূত্র:

দৈনিক ইত্তেফাক, ১৪ ও ১৬ এপ্রিল ১৯৭২

দৈনিক বাংলার বাণী, ১৪ ও ১৬ এপ্রিল ১৯৭২

দৈনিক বাংলা, ১৪ এপ্রিল ১৯৭২

ahmadistiak1952@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

4h ago