ফরাসি বিপ্লব ও পতাকা

ফ্রান্সের বিমান বাহিনীর বিশেষ প্রদর্শনীতে দেশটির পতাকা। ছবি: সংগৃহীত

একটি জাতির পরিচয় পাওয়া যায় নিজস্ব ভাষা, খাদ্য, পোশাক, সংস্কৃতি ইত্যাদির মাধ্যমে। তবে একটি জাতীয় পতাকাকে স্বাধীন দেশ ও জাতির প্রতিনিধিত্বের পূর্ণ প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই জাতীয় পতাকা পৃথিবীর সব দেশে সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শনের যোগ্য।

জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। পতাকা একটি প্রতীক, যা প্রতিটি রাষ্ট্রের জনগণের জন্য গৌরব, সম্মান ও আত্মমর্যাদার।

বিভিন্ন দেশের বিপ্লব, সংগ্রাম, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ভৌগলিক অবস্থানের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনা করে এই পতাকা তৈরি করা হয়। প্রথম কখন পতাকার ব্যবহার শুরু হয়েছিল তার দিনক্ষণ বলা না গেলেও চৈনিক ডাইনেস্টি, মিশর, গ্রিক, রোম, সুমেরীয়, সিন্ধু সভ্যতায় পতাকার ব্যবহার দেখা যায়।

কোনো সার্বভৌম জাতি, সম্প্রদায়, সশস্ত্রবাহিনী অথবা কোনো সংগঠনের পরিচয় চিহ্ন হিসেবে নকশা কিংবা সংকেত সম্বলিত কাপড়, নিশান, অনুরূপ কিছুর নামকে পতাকা বলা হয়। কাপড় ছাড়াও কাঠ ও ধাতুর পাত দিয়ে তৈরি করা হয় পতাকা।

স্বাধীনতা মানুষের মৌলিক অধিকার। ফরাসি সাধারণ জনগণ ১৭৮৯ থেকে ১৭৯৯ সাল পর্যন্ত প্রায় ১০ বছর শ্রেণী সংগ্রাম করেছিলেন। গির্জা, বুর্জোয়া শ্রেণী, বণিক শ্রেণী, রাজতন্ত্রের শোষণ, দুঃশাসন, নিপীড়ন, বঞ্চনার দুর্ভোগ থেকে মুক্তির সনদ নিয়ে বাস্তিল দুর্গ পতন করেন তারা। রাজপরিবারের বিলাসবহুল জীবনযাপন, কৃষকদের ওপর জুলুম, শ্রমিক-মেহনতি জনতার ওপর অত্যাচার, সাধারণ জনগণের ওপর করের বোঝা থেকে মুক্তির স্বাদ পেতে পুরো ফরাসি জাতি জেগে ওঠে কঠোর বিপ্লবে।

দার্শনিক, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সশস্ত্রবাহিনী, জনতা সম্মিলিতভাবে সামন্ততন্ত্র ও রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করেন এই বিপ্লবের মধ্যমে। জনগণের এই বিজয় ইতিহাসে ফরাসি বিপ্লব নামে খ্যাত।

ফরাসি বিপ্লব যে আদর্শের চেতনায় উজ্জীবিত হয়েছিল, তার মধ্যে ফরাসি দার্শনিকরা আধুনিক জীবনযাপনের জন্য বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির ভিত্তিকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। এই বিপ্লবের চিন্তাশক্তিকে শাণিত করেছিল মনীষীদের শাশ্বত ধারণাগুলো।

যেমন: জন লক (১৬৩২-১৭০৪) গির্জা ও সামন্তপ্রভুর শাসনভার যে ঐশ্বরিক প্রদত্ত, তা অস্বীকার করেন। জঁ-জাক রুশো (১৭১২-১৭৭৮) ব্যক্তি স্বাধীনতা ও অধিকার নিশ্চিতকরণ, সামাজিক মূল্যবোধ, আধুনিক রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কিত ধারণার প্রতি গুরুত্ব দেন। মন্তেস্কু (১৬৮৯-১৭৫৫) একটি জবাবদিহিতামূলক প্রশাসন ব্যবস্থার প্রতি গুরুত্ব, রাষ্ট্রের আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ওপর ক্ষমতার বিভাজনে বিশেষভাবে অবদান রাখেন। দার্শনিকদের চিন্তা-চেতনা ফরাসি সাধারণ জনগণের মাঝে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছিল।

ফরাসি বিপ্লবকে মানবজাতির অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর লড়াই হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রতি বছর ১৪ জুলাই ফরাসিরা এই দিনটিকে জাতীয় দিবস, জুলিয়ে ক্যাথোজ, ফতে ন্যশেওন্যল, বাস্তিল দিবস নামে অভিহিত করে থাকে।

এই বিপ্লবের মূল মন্ত্র ছিলো স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব বা মৃত্যু। যেখানে আধুনিক রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, জাতীয়তাবাদী চেতনা, ধর্মীয় ও ব্যক্তি স্বাধীনতা ও আইনের দৃষ্টিভঙ্গিতে সকল জনগণের সমান অধিকার প্রস্ফুটিত হয়েছিল।

ফরাসি সশস্ত্র বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট সব রাষ্ট্রীয় অতিথিদের নিয়ে প্যারিস শহরে উদযাপন করে থাকে এই মহান দিনটি। সেখানে জাতীয় পতাকা বিভিন্ন স্তরে মর্যাদাপূর্ণভাবে শোভা পায়। ফরাসি ফ্রেঞ্চ এয়ার অ্যান্ড স্পেস ফোর্সের পক্ষ থেকে প্যারিসের আকাশ বর্ণিল ধোঁয়ায় চিত্রিত করা হয়, তুলে ধরা হয় ফরাসি জাতীয় পতাকার নানান নান্দনিক রূপ।

প্রথমদিকে ফরাসি পতাকায় এক ধরনের ফুল লিলির চিহ্ন, ফ্লর দো-লিস ব্যবহার হতো। ইডেন থেকে ইভ চলে যাওয়ার সময় তার চোখের পানি থেকে এই লিলি সৃষ্টি হয়েছিল। এই ফুলের প্রতীক অতি পবিত্র, যা তিনটি পাপড়ি যুক্ত হয়। রোমান ক্যাথলিক চার্চ প্রতীকটি মেরির পবিত্রতার সঙ্গে সম্পর্কিত মনে করেন এবং রাজাদের মুকুটে এই প্রতীক ব্যবহার করা হয়।

ফরাসি বিপ্লবের আগ পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের পতাকা ফরাসিরা ব্যবহার করতো। দশম শতাব্দী থেকে বর্তমান সময় পতাকার বিবর্তন হয়। নীল রং (১০-১২ শতাব্দী), নীল রঙের ওপর লিলি (১৪-১৬ শতাব্দী), সাদার ওপর লিলি (কিংডম অব ফ্রান্স ১৩৬৫-১৭৯২ সাল), লাল সাদা নীল (প্রথম ফ্রান্স রিপাবলিক ১৭৯০-১৭৯৪ সাল), নীল সাদা লাল (১৭৯৪-১৮১৪ সাল), নীল লাল সাদা (১৮৮৪ সাল), নীল সাদা লাল (মাল্টিপল রিপাবলিক ১৮৯৪-১৯৫৮ সাল)।

প্রায় ১৭ বার রঙের হালকা গাড় অবস্থান ও প্রতীক পরিবর্তনের পর বর্তমানে গাড় নীল, সাদা এবং উলম্ব লাল পতাকা দেখা যায়। এই পতাকাকে ত্রিবর্ণ বা ট্রাইকালার বলা হয়। এই তিন রংয়ের পতাকাকে অতীতের নিপীড়ন, স্বৈরাচার, ধর্মীয় কুসংস্কার ও রাজতন্ত্রের বিরোধী প্রতীক হিসেবে ভাবা হয়।

শিল্পী জ্যাক-লুই ডেভিড (১৯৪৮-১৮২৫ সাল) এই পতাকার নকশা করেন, যার অনুপাত ২:৩ ধরা হয়। ২৩০ বছর পূর্বে ১৭৯০-৯৪ সালে এই নকশা গৃহীত হয়।

ডেভিড একজন সচেতন নিউক্যাসিকেল শৈলীধারার চিত্রশিল্পী, যিনি রাজনীতি ও বিপ্লবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। এই পতাকার বাম থেকে ডানে নীল রং, যা আভিজাত্যকে বুঝায়। আরও আছে সাদা ও লাল রং।

ফরাসি জেনারেল গিলবাড ডু মোটিয়ের ও মারকুইস দে লাফায়েত এর মতে 'সাদা' ছিল প্রাচীন ফরাসি রং, যা রাজতন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করে; লাল রং সংগ্রাম, বিপ্লব ভালোবাসার প্রতীক। নীল ও লাল রং প্যারিস শহরের কোড অব আর্মডের সঙ্গে যুক্ত। নীল সেন্টমার্টিন ও লাল সেন্ট ডেনিসের প্রতীক। বিপ্লবের সময়কালে মিলিশিয়ারা নীল ও লাল রঙের ককেড (ফিতা দিয়ে তৈরি বৃত্ত) যানবাহন, কোট, টুপি ইত্যাদিতে ব্যবহার করতেন।

ফরাসি জাতীয়তাবাদের এই প্রতীকটি ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনেও স্থানীয় পতাকার সঙ্গে ব্যবহার হতো। পাশাপাশি ২৮টি পতাকা বিভিন্ন ডিজাইনে নীল, সাদা ও লালকে রেখে ঔপনিবেশিক সীমানায় ব্যবহার করতে দেখা যায়।

২০২০ সালের জুলাই থেকে ফরাসি পতাকার গাড় নীল রং পরিবর্তন করে নেভি ব্লু ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত হয়—যা ফরাসি বিপ্লবকালীন সময়ে ব্যবহার হতো। বর্তমানে এলিস প্যালেসসহ জাতীয়ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে এই পতাকা।

ফরাসি দেশে বিভিন্ন সময়ে তাদের ল্যান্ডমার্কের ওপর আলোক প্রক্ষেপণ করে—যেমন: আইফেল টাওয়ার, আর্চ দো ট্রিইম্প, বিভিন্ন ভবন—জাতীয় পতাকাকে আকর্ষণীয়ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়। এই মনুমেন্টগুলো ঘিরে আলোর রোসনাইয়ে বা আতসবাজিতে ফুটিয়ে তুলতে দেখা যায়। ফ্রেঞ্চ সোসাইটি অব ভেক্সিকোলজি জাতীয় পতাকা ওড়ানো কর্তৃপক্ষ এবং দেশের জন্য পতাকার একমাত্র অফিসিয়াল রেজিস্টার বজায় রাখে।

লেখক: অধ্যাপক, চারুকলা ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Comments