৫২ বছর পর মিলল মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি

শহীদ সৈয়দ হাফিজুর রহমান
শহীদ সৈয়দ হাফিজুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

পেরিয়েছে স্বাধীনতার ৫২ বছর, গড়িয়েছে অজস্র জল। তার সঙ্গী প্রায় সব শহীদ সহযোদ্ধাই পেয়েছেন বীরত্বসূচক রাষ্ট্রীয় খেতাব। কিন্তু সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করার পরেও খেতাব পাননি তিনি। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, মুক্তিযুদ্ধের পর গত ৫২ বছরে তার পরিবার ৯ বার আবেদন করা সত্ত্বেও ন্যূনতম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতিটুকু পাননি ক্র্যাকপ্লাটুনের দুর্ধর্ষ গেরিলা শহীদ সৈয়দ হাফিজুর রহমান।

তবে অবশেষে তার পরিবারের দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ৫২ বছর পর অবশেষে 'মুক্তিযোদ্ধা' হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন শহীদ সৈয়দ হাফিজুর রহমান।

গত ১৩ জুলাই জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের যাচাই বাছাইকরণ কমিটিতে তার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে দ্য ডেইলি স্টারকে নিশ্চিত করেছেন জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের সদস্য মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক। সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বেসামরিক গেজেটে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সৈয়দ হাফিজুর রহমানের নাম প্রকাশিত হয়েছে। বেসামরিক গেজেটে তার গেজেট নম্বর ৪১৭১।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ১৯৭৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত নয় বার সৈয়দ হাফিজুর রহমানের 'শহীদ মুক্তিযোদ্ধা' হিসেবে স্বীকৃতির জন্য আবেদন করেছিল তার পরিবার। তবে অজানা কারণে প্রতিবারই সেই আবেদন ব্যর্থ হয়েছে।

গত বছরের ২৪ ও ৩১ অক্টোবর দ্য ডেইলি স্টারে 'Half a century gone chasing recognition' ও 'Denied again' পৃথক দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ হাফিজুর রহমানের পরিবারের পদে পদে বিড়ম্বনা ও অসহায়ত্বের করুণ চিত্র।

ডেইলি স্টারে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখে চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি স্বপ্রণোদিত হয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মোহাম্মদ বাকির হোসেন মৃধা।

পরবর্তীতে ২২ জানুয়ারি 'শহীদ সৈয়দ হাফিজুর রহমান কেন 'শহীদ মুক্তিযোদ্ধা' হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন না' এ নিয়ে প্রশ্ন তোলে হাইকোর্ট। এছাড়া গত বছরের ২৮ নভেম্বরে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ হাফিজুর রহমানের ভাইয়ের করা আবেদনের নিষ্পত্তি না করা কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না এই মর্মে রুল জারি করে হাইকোর্ট। একইসঙ্গে ৪ সপ্তাহের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের মহাপরিচালক (ডিজি), মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের মহাপরিচালক এবং ঢাকার জেলা প্রশাসককে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধে ঢাকায় আরবান গেরিলা দল ক্র্যাকপ্লাটুনের দুঃসাহসিক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন সৈয়দ হাফিজুর রহমান। ক্র্যাকপ্লাটুনে তিনি পরিচিত ছিলেন মাইন হাফিজ নামে। মুক্তিযুদ্ধকালীন ক্র্যাকপ্লাটুনের বেশ কয়েকটি চরম ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশনে অংশ নিয়ে অসীম বীরত্ব প্রদর্শন করেছিলেন হাফিজুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধে ঢাকায় কেবল এক রাতে সফলভাবে ছয়টি স্থানে মাইন বিস্ফোরণের অসামান্য কৃতিত্বও ছিল তার।

মুক্তিযুদ্ধের জুলাই মাসে সায়েন্স ল্যাবরেটরির রাস্তায় হাফিজুর রহমানের পেতে রাখা এম-কে ১৬ মাইনের বিস্ফোরণে উড়ে গিয়েছিল পাকিস্তানি সৈন্যবাহী ট্রাক। মুক্তিযুদ্ধের আগস্ট মাসের এক রাতে আসাদ গেটের কাছে হাফিজের পেতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল হানাদার বাহিনীর একটি কনভয়।

এছাড়া ক্র্যাকপ্লাটুনের দুর্ধর্ষ অপারেশন দাউদ পেট্রোল পাম্প অপারেশন, কমলাপুর স্টেশন অপারেশন, গ্যানিজ ও ভোগ ফ্যাশন বিপণীকেন্দ্রসহ বেশ কয়েকটি অপারেশনে অংশ নিয়ে দুঃসাহসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন হাফিজুর রহমান।

মুক্তিযুদ্ধের আগস্ট মাসে গাজী গোলাম দস্তগীর বীর প্রতীকের নেতৃত্বে অপারেশন উলন পাওয়ার স্টেশনে অংশ নিয়ে ৩০/৪০/৫০ এমভিএ ক্ষমতাসম্পন্ন ট্রান্সফারমার সফলভাবে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন সৈয়দ হাফিজুর রহমান। সেই বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল ঢাকার গোটা পূর্বাঞ্চল।

সুনিপুণ কায়দায় মাইন পেতে রাখা এবং অতর্কিত আক্রমণের জন্য ক্র্যাকপ্লাটুনে সৈয়দ হাফিজুর রহমান পরিচিত ছিলেন 'গেরিলা হাফিজ' ও 'মাইন হাফিজ' নামে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্রের নবম খণ্ডে ক্র্যাকপ্লাটুনের বেশ কয়েকটি অপারেশনের বর্ণনায় সৈয়দ হাফিজুর রহমানের বীরত্বগাঁথা বর্ণিত হয়েছিল। এছাড়া শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তার লেখা 'একাত্তরের দিনগুলি' গ্রন্থেও তুলে ধরেছিলেন হাফিজুর রহমানের বীরত্বগাঁথা।

মুক্তিযুদ্ধের ২৯ আগস্ট শেষ রাতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সৈয়দ হাফিজুর রহমানের ২০/ নিউ ইস্কাটনের বাড়িতে হানা দেয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। অভিযানে হানাদার সেনারা তার বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, বিস্ফোরক ও গোলাবারুদের সন্ধান পায়। এসময় অস্ত্র ও গোলাবারুদের উদ্ধারের পাশাপাশি হাফিজুর রহমানকে আটক করে তুলে নিয়ে যায় হানাদার বাহিনী।

ক্র্যাকপ্লাটুনের ধরা পড়া বাকি গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের মতো হাফিজুর রহমানকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তেজগাঁও নাখালপাড়ার ড্রাম ফ্যাক্টরি সংলগ্ন এমপি হোস্টেলের মিলিটারি টর্চার সেলে। সেখানে সহযোদ্ধাদের বিষয়ে তথ্য বের করতে তার উপর চালানো হয়েছিল চরম পৈশাচিক নির্যাতন। কিন্তু চরম নির্যাতন সয়েও সহযোদ্ধাদের নাম পরিচয় কিছুই প্রকাশ করেননি সৈয়দ হাফিজুর রহমান।

টর্চার সেলে তার উপর চালানো পৈশাচিক নির্যাতন স্বচক্ষে দেখেছিলেন ক্র্যাকপ্লাটুনের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা লিনু বিল্লাহ। ভাগ্যক্রমে টর্চার সেল থেকে ফিরে আসা লিনু বিল্লাহ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হাফিজ ভাইয়ের সঙ্গে আমার সর্বশেষ দেখা হয়েছিল টর্চার সেলে। তার উপর এতটাই টর্চার করা হয়েছে যে তার দুচোখ বেরিয়ে গেছে। সারা শরীরে পৈশাচিক নির্যাতন চিত্র। তিনি বারবার বলছিলেন তোমরা আমাকে গুলি করো তাহলে আমি বেঁচে যাই। এরপরেও তিনি কোনো তথ্য স্বীকার করেননি। আমার বোধহয় এরপর উনি আর আধা ঘণ্টা হয়তো বেঁচে ছিলেন।'

৩০ আগস্টের পর সৈয়দ হাফিজুর রহমানের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।

মুক্তিযুদ্ধের পর ক্র্যাকপ্লাটুনে শহীদ হাফিজের সঙ্গে শহীদ প্রায় সব মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রীয় খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি শহীদ হাফিজ।

স্বাধীনতার ৫২ বছর পর অবশেষে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় দারুণ উচ্ছ্বসিত শহীদ সৈয়দ হাফিজুর রহমানের পরিবারের সদস্যরা। বর্তমানে তার দুই ভাইবোনই কেবল জীবিত আছেন। শহীদ হাফিজের ছোটভাই সৈয়দ মুসাদ্দেকুর রহমান বর্তমানে সপরিবারে বেলজিয়ামে বসবাস করেন। টেলিফোনে ডেইলি স্টারের এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, 'এই অনুভূতি আসলে ভাষায় বর্ণনা করার মতো না। আমাদের কেবল একটি চাওয়াই ছিল, ভাইয়ের অবদানের অন্তত ন্যূনতম স্বীকৃতি। স্বাধীনতার পর গত অর্ধ শতক আমরা কেবল স্বীকৃতির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি। শেষ পর্যন্ত আমার ভাই তার বীরত্বের স্বীকৃতি পেলেন। ডেইলি স্টারকে ধন্যবাদ। নয়তো আমাদের জন্য এই যাত্রা আরও ভীষণ কঠিন হতো। তবে আমার প্রশ্ন, তার সহযোদ্ধারা বারবার তার বীরত্ব আর অবদানের কথা স্মরণ করা সত্ত্বেও কেন আমাদের ৫০ বছরেরও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হলো। এই প্রশ্নের জবাব হয়তো কখনোই মিলবে না! যেখানে তার সঙ্গে শহীদ সব সহযোদ্ধা রাষ্ট্রীয় খেতাব পেয়েছেন, সেখানে তার ন্যূনতম স্বীকৃতির জন্য আমাদের ৫০ বছরেরও বেশি সময় লড়াই করতে হয়েছে। এটি জাতি হিসেবেও আমাদের জন্য চূড়ান্ত লজ্জার।'

শহীদ সৈয়দ হাফিজুর রহমানের স্বীকৃতি পাওয়ায় দারুণ খুশি তার একমাত্র বোন সৈয়দা আনোয়ারা খাতুন। ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'আমরা সবসময় শুধু আমার ভাইয়ের বীরত্বের স্বীকৃতিটুকুই চেয়েছি। বারবার বলেছি, এখনো বলছি আমাদের কোনো টাকা পয়সার প্রয়োজন নেই। আমার ভাইয়ের সন্তান- সন্ততিও নেই যে তারা সামান্য ভাতার প্রত্যাশায় থাকবে। অথচ নয় নয়বার আবেদন করা সত্ত্বেও আমাদের আবেদন গ্রহণ করা হয়নি। কেন নেয়া হয়নি জানি না! অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে আমরা ভেবেছি হয়তো আমাদের জীবিতাবস্থায় ভাইয়ের বীরত্বের স্বীকৃতিটুকুও দেখে যেতে পারব না। ডেইলি স্টারে প্রতিবেদন না হলে হয়তো কখনোই এটি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হতো না। শেষপর্যন্ত যে আমার ভাই শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন এতেই আমরা পরিতৃপ্ত। আমাদের চাওয়া পূর্ণ হয়েছে।'

শহীদ হাফিজের সহযোদ্ধা ও ক্র্যাকপ্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধা লিনু বিল্লাহ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'স্বাধীনতার এত বছর পরে যে হাফিজ ভাই শেষপর্যন্ত স্বীকৃতি পেয়েছেন এটি আমার জন্য একইসঙ্গে ভীষণ আনন্দদায়ক এবং বেদনাদায়ক। আমিই সর্বশেষ হাফিজ ভাইকে টর্চার সেলে দেখেছিলাম। তাকে কতোখানি নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছে। অথচ তিনি ছিলেন নির্বিকার। শত নির্যাতন সয়েও সহযোদ্ধার বিষয়ে টুঁ শব্দটুকুও করেননি। তার স্বীকৃতি বহু আগেই পাওয়া উচিত ছিল।'

Comments

The Daily Star  | English

One killed in multi-vehicle crash on Dhaka-Mawa highway

The chain of crashes began when a lorry struck a private car from behind on the Mawa-bound lane

42m ago