নারী সাংবাদিকতার অগ্রদূত নূরজাহান বেগম
বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় নারীদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ থেকে সম্পাদনা সমস্ত যাত্রা শুরু হয়েছিল তার হাত ধরে। বাংলাদেশ তো বটেই, উপমহাদেশের নারী সাংবাদিকতারও পথিকৃৎ ছিলেন নূরজাহান বেগম।
১৮৭০ সালে প্রকাশিত বঙ্গমহিলা ছিল বাংলা ভাষায় প্রথম নারী সম্পাদিত পত্রিকা, যার সম্পাদক ছিলেন মোক্ষদায়িনী মুখোপাধ্যায়। নারী সম্পাদিত প্রথম মাসিক পত্রিকা ছিল 'অনাথিনী', যার সম্পাদক ছিলেন থাকমনি দেবী। অন্যদিকে উপমহাদেশের প্রথম সচিত্র নারী সাপ্তাহিক ছিল নূরজাহান বেগম সম্পাদিত 'বেগম' পত্রিকা।
যে সময়টির কথা বলছি সে সময়টিতে সমাজ ব্যবস্থায় নারীর ছবি তোলাও ছিল একরকম নিষিদ্ধ। আর সচিত্র সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ কতখানি দুরূহ ছিল তা সহজেই অনুমেয়। কেবল সচিত্র সাপ্তাহিক পত্রিকা বেগম সম্পাদনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি নূরজাহান বেগম, তিনি বেগম পত্রিকাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন নারীর একান্ত কণ্ঠস্বর হিসেবে।
নারী জাগরণ, নারী স্বাধীনতা, নারী অধিকার থেকে শুরু করে নারীর ভাবনাচিন্তা এবং সৃজনশীলতাও উঠে এসেছে বেগম পত্রিকায়। বেগমে উঠে আসত নারীর নানা সমস্যা, জন্মনিরোধ, পরিবার পরিকল্পনা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েদের জীবনবোধ নিয়ে লেখা চিঠিও। ফলে নারী প্রগতির বার্তা বহনকারী হয়ে উঠেছিল বেগম।
বেগম পত্রিকার মধ্য দিয়ে সব মহলে নারীর ভাষ্যকে উপস্থাপন করেছেন নূরজাহান বেগম। তার দেখানো পথে বাংলাদেশে নারী স্বাধীনতার পথ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নারীরা নিজেদের অধিকারের বিষয়ে হয়েছেন সচেতন। গোটা ২টি প্রজন্ম নূরজাহান বেগম সম্পাদিত বেগম পত্রিকার লেখনী ও পাঠের মধ্য দিয়ে হয়েছে সমৃদ্ধ।
বিগত শতাব্দীর প্রথম ভাগে কলকাতায় যখন নূরজাহান বেগম বেড়ে উঠছিলেন, তখন সময়টি ছিল ভীষণ অবরুদ্ধ ও উত্তাল। একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাল চলছে, অন্যদিকে দুর্ভিক্ষের হাহাকার। ২ এ মিলে চরম দুর্যোগকাল। উত্তাল সে সময়েই মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের হাত ধরে প্রথমে জন্ম নিয়েছিল সওগাত পত্রিকা। সওগাত ক্রমেই হয়ে উঠেছিল প্রগতিশীল সমাজের মুখপত্র।
সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন চিরকালই ছিলেন নারী শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী। উদারমনস্ক অসাম্প্রদায়িক এই মানুষটি সওগাতের মাধ্যমে নারী শিক্ষা ও নারীর অধিকারের ক্ষেত্রে প্রগতিশীল সমাজে একটি বিশেষ ধারা গড়ে তুলেছিলেন। যে কারণে তিনি সওগাতে মেয়েদের জন্য পৃথক বিভাগ তৈরি করেছিলেন। যেমন 'জেনানা মহফিল', 'মহিলা সংখ্যা', 'মহিলা সওগাত'।
১৯২৯ সাল থেকে ১৯৪৫; এই ১৬ বছরে সওগাত থেকে ৬টি মহিলা সংখ্যা বের করেছিলেন মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। এ সংখ্যাগুলো তুমুল আলোচিত হয়েছিল। তখন মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন পূর্ণমাত্রায় অনুধাবন করলেন, মেয়েদের জন্য একটি সাময়িকী প্রকাশ সময়ের দাবি। তাই কবি সুফিয়া কামালকে সম্পাদক করে প্রকাশিত হলো বেগম পত্রিকার প্রথম সংখ্যা। কলেজ পড়ুয়া নূরজাহান বেগম ছিলেন এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। প্রথম সংখ্যাতে বেগম ছাপা হয়েছিল ৫০০ কপি। মূল্য ধরা হয়েছিল ৪ আনা। প্রচ্ছদে রাখা হয়েছিল নারী অধিকারের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়ার ছবি।
কলকাতায় বেগমের দপ্তর ছিল ১২ নম্বর ওয়েলেসলি স্ট্রিটে। সে বাড়িতেই চলত লেখা সংগ্রহ থেকে লেখা বাছাই, সম্পাদনার কাজ। সুফিয়া কামাল আর মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকার কাছ থেকে দ্রুতই সম্পাদনা ও অন্যান্য কাজ রপ্ত করে নিয়েছিলেন নূরজাহান বেগম। বাবার পরামর্শে চলত ইংরেজি থেকে লেখা অনুবাদের কাজও। তবে একটি বিষয় লক্ষণীয়, বেগম পত্রিকার নামটা পছন্দ হয়নি রক্ষণশীল হিন্দুদের। কারণ শতাব্দীর এই দশকে কলকাতায় এমনভাবে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ও সাম্প্রদায়িক মনোভাব ছড়িয়েছিল যে, হিন্দু নারীরা বেগমে লেখা দিতে চাইতেন না।
একদিকে সাম্প্রদায়িকতা অন্যদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা ২ এ মিলে পরিস্থিতি ভীষণ জটিলাকার ধারণ করেছিল। অন্যদিকে সম্পাদক সুফিয়া কামালও কলকাতা ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন ঢাকায়। প্রকাশের ৪ মাসের মাথায় সেই কঠিন সময়েই বেগমের সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন নূরজাহান বেগম। কিন্তু তৎকালীন পরিস্থিতিতে বেগম অনেকটাই মূলধারার পাঠক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিল।
কিন্তু নূরজাহান বেগম ছিলেন অদম্য। তার সুদৃঢ় মনোভাব আর সম্পাদনাতে প্রকাশিত হলো বেগম। ১৯৪৮ সালে কলকাতায় বেগমের প্রথম ঈদ সংখ্যায় ঠাঁই পেয়েছিল ৬২ জন নারী লেখকের লেখা। তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় কেবল একটি সংখ্যাতেই ৬২ জন নারী লেখকের উপস্থিতি কেবল দুর্লভই নয়, বিস্ময়করও।
কিন্তু এক পর্যায়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও চরম অস্থিরতার মধ্যে বাধ্য হয়ে কলকাতা ছেড়ে পাকাপাকিভাবে ঢাকায় আসতে হয়েছিল নূরজাহান বেগমদের। ১১, ওয়েলেসলি স্ট্রিটের এক দোতলা বাড়ি ছেড়ে বেগমের নতুন ঠিকানা হলো পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলির ৬৬ লয়াল স্ট্রিট।
নূরজাহান বেগমের প্রচণ্ড আগ্রহে ঢাকায় বেগমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলেন কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক থেকে পত্রিকার সম্পাদকসহ ঢাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। কিন্তু তাতেও কিছু হয়নি। কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় আসায় বেগমের চাহিদা তলানিতে গিয়ে ঠেকল। কারণ বেগম কলকাতায় যতটা জনপ্রিয় ঢাকার তার লেশমাত্রও নেই। ফলে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে লেখা সংগ্রহ করতে হতো নূরজাহান বেগমকে। কেবল তাই নয়, হকারের ওপর নির্ভরশীল না থেকে পাঠকের বাড়িতেও কখনো কখনো বেগম পৌঁছে দিয়েছিলেন নূরজাহান বেগম।
ঈদ তখন চলে এসেছে প্রায়। নূরজাহান বেগম ভাবলেন, বেগম থেকে আবারও ঈদ সংখ্যা প্রকাশিত হবে। তৎকালে ঢাকায় পূজা সংখ্যা পরিচিত থাকলেও ঈদ সংখ্যা ছিল পুরোপুরি অপরিচিত। কিন্তু ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে সেই প্রতিকূল পরিবেশ ও চাহিদাবিহীন সমাজেই ঢাকায় আগমনের মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে ঈদ সংখ্যা বের করেছিলেন নূরজাহান বেগম।
বলে রাখা ভালো, বাংলাদেশের ঈদ সংখ্যার স্বর্ণযুগ বলা হয় ৯০ এর দশক থেকে পরবর্তী ২ দশককে। অথচ নূরজাহান বেগম তা শুরু করেছিলেন ৫০ এর দশকেই। সময় থেকে নূরজাহান বেগম কতখানি এগিয়ে ছিলেন তার একটি উদাহরণ এটি।
তৎকালীন পরিস্থিতিতে ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত সওগাত প্রকাশ বন্ধ রেখেছিলেন মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, কিন্তু প্রকাশ বন্ধ থাকেনি বেগম পত্রিকার। নূরজাহান বেগমের অদম্য চেতনা ও হার না মানা মানসিকতার কারণে বেগম দ্রুতই পাঠকের আগ্রহের শীর্ষে অবস্থান নিয়েছিল।
বেগমের মাধ্যমে সাংবাদিকতাকে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন নূরজাহান বেগম। তবে কেবল সাংবাদিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি তিনি। নারীদের মধ্যে সৃজনশীলতা, মননশীলতা, আত্মসচেতনা, সংগ্রামী মনোভাব জাগিয়ে তোলার জন্য বেগম পত্রিকার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বেগম ক্লাব। ক্লাবটি অবরুদ্ধ সেই সময়েই নারী লেখকদের একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত হতে ভীষণ সাহায্য করেছিল।
এক ভঙ্গুর সমাজের মাঝে নূরজাহান বেগম পত্রিকার মধ্য দিয়ে সমাজে উপস্থাপন করেছেন নারীর মত, নারীর নিজস্ব কথন, নারীর আত্মসচেতনতা। বেগম হয়ে উঠেছিল নারী সমাজের সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম।
বেঁচে থাকলে আজ ৯৯ বছরে পা দিতেন নূরজাহান বেগম। জন্মদিনে তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
তথ্যসূত্র:
বাংলা সাহিত্যে সওগাত যুগ/ পাক্ষিক পত্রিকা 'মাকু'।প্রকাশিত ৫ অক্টোবর, ১৯৯৭
'বেগম'- এর নূরজাহান/ নূরজাহান বেগমের সাক্ষাৎকার- সুমনা শারমিন
Comments