দেশের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন জগৎজ্যোতি দাস বীর বিক্রম
রণাঙ্গনে তিনি ছিলেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে সাক্ষাৎ যম। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে হাওর অঞ্চলে তার প্রতিষ্ঠিত দাসপার্টি হয়ে উঠেছিল হানাদার বাহিনীর কাছে ত্রাস। শত্রুশিবিরে রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছিল তার বাহিনীর সব অপারেশন। মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় সেই বীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি দাস বীর বিক্রম।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিতে ভারতের মেঘালয়ের ইকো-১ প্রশিক্ষণ শিবিরে যোগ দেন জগৎজ্যোতি দাস। একসময়ে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়ার জন্য ভারতের গৌহাটির নওপং কলেজে পড়া অবস্থায় নকশালপন্থীদের সঙ্গে জড়িত হয়েছিলেন জগৎজ্যোতি দাস। তাই -অস্ত্র গোলাবারুদ সম্পর্কে ধারণা ছিল তার। ইকো-১ প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রশিক্ষণের পর পরবর্তীতে গণযোদ্ধাদের নিয়ে জগৎজ্যোতি দাস গড়ে তোলেন 'দাস পার্টি' নামের দুর্ধর্ষ গণবাহিনী। জগৎজ্যোতি ইংরেজি, হিন্দি, গৌহাটির আঞ্চলিক ভাষা জানতেন বলে ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ ছিল তার। ভারতীয় বাহিনী থেকেও বহু অস্ত্র ও গোলাবারুদও সংগ্রহ করেন জগৎজ্যোতি দাস।
এরপর সুনামগঞ্জ-কিশোরগঞ্জ-নেত্রকোণা ও হবিগঞ্জের হাওর অঞ্চলে একের পর এক অপারেশন চালাতে শুরু করেন জগৎজ্যোতি দাস ও তার নেতৃত্বাধীন দাস পার্টির মুক্তিযোদ্ধারা।
মুক্তিযুদ্ধে টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের অধীনে বিস্তীর্ণ ভাটি অঞ্চল শত্রুমুক্ত রাখার দায়িত্ব পড়েছিল জগৎজ্যোতি দাসের ওপর। সুনামগঞ্জের দিরাই, শাল্লা, ছাতক, আজমিরিগঞ্জ, বানিয়াচং, জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোণার নৌপথ হানাদার দখলমুক্ত রাখার জন্য অসংখ্য অপারেশন চালিয়েছিলেন দাস পার্টির মুক্তিযোদ্ধারা।
ক্রমেই দাস পার্টি হয়ে উঠল পাকিস্তানি হানাদারদের কাছে আতঙ্কের নাম। একসময় বাধ্য হয়ে হানাদার বাহিনী রেডিওতে ঘোষণা দেয় 'এই রুট দিয়ে চলাচলকারী ব্যক্তিদের জানমালের দায়িত্ব সরকার নেবে না।'
মুক্তিযুদ্ধে টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের অধীনে বিস্তীর্ণ ভাটিঅঞ্চল শত্রু মক্ত রাখার দায়িত্ব পড়েছিল জগৎজ্যোতি দাস ও তার বাহিনীর ওপরে।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস দখল করে আছে ২৯ জুলাইয়ের জামালগঞ্জ রেইড। এই যুদ্ধে অসামান্য ভূমিকা রেখেছিলেন জগৎজ্যোতি দাস। অবস্থানগত কারণে জামালগঞ্জের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। যার ফলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শক্ত ঘাঁটি স্থাপন করেছিল জামালগঞ্জে। জামালগঞ্জের পাশ দিয়েই ছিল সুরমা নদী। নদীর এক পাড়ে জামালগঞ্জ থানা সদর অন্যদিকে গুরুত্বপূর্ণ সাচনাবাজার বন্দর।
জামালগঞ্জ থানা ও নৌ-বন্দর সাচনাবাজারকে হানাদারদের হাত থেকে শত্রুমুক্ত করার জন্য জামালগঞ্জে রেইড চালানোর সিদ্ধান্ত নেন ৫ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলী। সে অনুযায়ী ২৯ জুলাই অপারেশনের দিন ধার্য করে রেকি করা হয়। প্রায় ১৪০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে তিনটি দলে বিভক্ত করে ৬টি নৌকা করে অপারেশনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন জগৎজ্যোতি দাসসহ মুক্তিযোদ্ধারা। রাত ১২টায় নির্দিষ্ট স্থানে সমবেত হয়ে জগৎজ্যোতি দাসসহ মুক্তিযোদ্ধারা সমন্বিতভাবে অতর্কিত আক্রমণ চালান হানাদার বাহিনীর উপর। এসময় হানাদার সেনারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। তাদের ধারণাই ছিল না জগৎজ্যোতি দাসেরা এমন আক্রমণ চালাতে পারে। একপর্যায়ে হানাদারেরা ঘুরে দাঁড়ালেও জগৎজ্যোতি দাসের রণ কৌশলের কাছে হেরে যায় হানাদারেরা। শেষরাতের দিকে একপর্যায়ে হানাদার সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
এই রেইডেই জগৎজ্যোতি দাসের নির্দেশে সিলেট- সুনামগঞ্জের সড়কের বদলপুর ব্রিজ উড়িয়ে দিয়েছিলেন দাস পার্টির মুক্তিযোদ্ধারা। বদলপুরের যুদ্ধ এতটাই ভয়াবহ ছিল যে একপর্যায়ে দাস পার্টির মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে টিকতে না পেরে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর হামলা চালিয়েছিল হানাদারেরা।
মুক্তিযুদ্ধের আগস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহে জগৎজ্যোতির রণকৌশলের কারণে পাহাড়পুড়ে প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলেন অসংখ্য গ্রামবাসী। একই মাসে সুনামগঞ্জের দিরাই ও শাল্লায় রেইড চালিয়ে জগৎজ্যোতির দাসের নেতৃত্বে দাশ পার্টির মুক্তিযোদ্ধারা ফাঁদে ফেলে ১০ রাজাকারকে আটক করেন। একই সঙ্গে রানীগঞ্জ ও কাদিরীগঞ্জে অভিযান চালিয়েছিলেন দাস পার্টির মুক্তিযোদ্ধারা।
মুক্তিযুদ্ধের ১৬ অক্টোবর জগৎজ্যোতি দাসের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বার্জে আক্রমণ চালালে বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা নিহত হয়। এছাড়া পাহাড়পুর অপারেশন, বানিয়াচংয়ে কার্গো বিধ্বস্ত করেন দাস পার্টির মুক্তিযোদ্ধারা। দাস পার্টির একেরপর এক চোরাগুপ্তা হামলা ও সফল অপারেশনে হানাদারেরা ব্যাপক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয় জগৎজ্যোতি দাস ও তার প্রতিষ্ঠিত দাস পার্টির বীরত্ব-গাঁথা ও অবিস্মরণীয় সব কীর্তি।
এরপরই পাকিস্তানি হানাদার সেনারা জগৎজ্যোতি দাসকে ধরার জন্য ওৎ পেতে থাকতে শুরু করে। একই সঙ্গে রাজাকারদের মাধ্যমে জগৎজ্যোতি দাসের অবস্থান নির্ণয় করার চেষ্টা করে।
দিনটি ছিল ১৬ নভেম্বর ১৯৭১
সবে ভোর হয়েছে। সূর্য উঠেনি তখনও। ভোরের সূর্য উঠার আগেই ৪২ জন সহযোদ্ধাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন জগৎজ্যোতি দাস। আস্তে আস্তে ভোরের আলো ফুটলো। অগ্রহায়ণের ঘাসে ভেজা শিশির মাড়িয়ে চলছে মুক্তিযোদ্ধারা। গন্তব্য বানিয়াচংয়ের বাহুবল। কিন্তু পথে বদলপুরে পরিস্থিতি না বুঝতে পেরেই হানাদার বাহিনীর ফাঁদে পা দেন দাসপার্টির মুক্তিযোদ্ধারা। মূলত বদলপুরে পৌঁছালে তাকে দেখে চিনতে পারে রাজাকারেরা। তাই কয়েকজন রাজাকার ব্যবসায়ীরা নৌকা আটকিয়ে চাঁদা আদায় করতে গেলে, দাস পার্টির কমান্ডার জগৎজ্যোতি দাস রাজাকারদের ধরে আনার নির্দেশ দেন। এদিকে অবস্থা বুঝতে পেরে সময়ক্ষেপণের জন্য রাজাকারেরা পিছু হটে। কিন্তু বুঝতে না পেরে এই ফাঁদেই পা দেন জগৎজ্যোতি দাস। তিনি বুঝতেই পারেননি কোনো ফাঁদে পা দিতে চলেছেন তিনি। এসময় রাজাকারদের পিছু হটতে দেখে তিনি ও তার সহযোদ্ধাদের রাজাকারদের তাড়া করতে শুরু করেন। এদিকে তখন দূরে গোয়েন্দা মারফতে খবর পেয়ে জগৎজ্যোতি দাসের জন্যই অপেক্ষা করছিল হানাদার বাহিনী। একসময় জগৎজ্যোতি দাস বুঝতে পারেন তিনি হানাদারদের তৈরি গোলকধাঁধার ব্যূহে ঢুকে পড়েছেন।
হানাদারদের বিশাল বহর চারপাশে ঘিরে ফেলেছে তার বাহিনীকে। কিন্তু এর মধ্যেও দমে যাননি জগৎজ্যোতি। তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন সহযোদ্ধাদের। কিন্তু একটা সময় তিনি দেখলেন আসলে এভাবে সম্ভব না। এভাবে যুদ্ধ চালিয়ে গেলে সবাই শহীদ হবেন। তখন জগৎজ্যোতি সহযোদ্ধাদের সরে যাওয়ার সুযোগ দিয়ে সহযোদ্ধা ইলিয়াসকে দিয়ে একটানা গুলি বিনিময় চালিয়ে যান।
কিন্তু হঠাৎ একটি গুলি এসে লাগে সহযোদ্ধা ইলিয়াসের গায়ে। তখন জগৎজ্যোতি নিজের গামছা খুলে বাঁধেন সহযোদ্ধা ইলিয়াসের ক্ষতস্থান। এসময় ইলিয়াস জগৎজ্যোতিকে সরে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু যাননি জগৎজ্যোতি। তিনি এরপর একাই যুদ্ধ চালিয়ে যান। তার সঙ্গে গুলিবিনিময়ে ততক্ষণে ১২ জন হানাদার সেনা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। বিকেলের আলো মরে এসেছে। সূর্য ঢলে পড়বে আরেকটু পরে, ঠিক তখনই জগৎজ্যোতি দেখতে পেলেন গুলি ফুরিয়ে এসেছে প্রায়। এমন সময় গুলির ম্যাগাজিন লোড করে শত্রুর অবস্থান দেখতে মাথা উঁচু করাতে ১টি গুলি এসে বিদ্ধ হয় জগৎজ্যোতির চোখে। লুটিয়ে পড়েন জগৎজ্যোতি দাস। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় জগৎজ্যোতি দাসকে ধরে নিয়ে যায় হানাদার বাহিনী। এরপর গুরুতর আহত জগৎজ্যোতি দাসের উপর পাশবিক নির্যাতন চালায় হানাদার ও রাজাকারেরা। তার সমস্ত শরীরে বিদ্ধ করা হয় পেরেক। একপর্যায়ে শহীদ হন জগৎজ্যোতি দাস।
পরদিন আজমিরীগঞ্জ বাজারে নিয়ে যাওয়া হয় তার লাশ। সেদিন ছিল ঈদের বাজার। বাজার ভর্তি হাজারের উপর মানুষ। সেই হাজারো মানুষের সামনে তার লাশে পেরেক দিয়ে পিটিয়ে ক্ষতবিক্ষত করা হয়। এসময় রাজাকারেরা থুতু নিক্ষেপ করে তার শরীরে। এদিকে তার পরিবারকে আনা হয় আজমিরীগঞ্জ বাজারে তার লাশ দেখতে। তার লাশের চেহারা তারা বিকৃত করে ফেলেছে। জগৎজ্যোতির পরিবার যখন জগৎজ্যোতিকে পাশবিক হত্যার কারণে শোকে কাতর তখন গান পাউডার দিয়ে রাজাকারেরা জ্বালিয়ে দেয় তার বাড়ি। শেষপর্যন্ত জগৎজ্যোতি দাসের লাশ ভাসিয়ে দেয়া হয় পার্শ্ববর্তী কুশিয়ারা নদীতে।
তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশ সরকার রেডিওতে তাকে সর্বোচ্চ সম্মান 'বীরশ্রেষ্ঠ' খেতাব দেয়ার ঘোষণা দেয়। প্রথম যোদ্ধা হিসেবে জগৎজ্যোতি দাসকে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব দেয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, অল ইন্ডিয়া রেডিও, আকাশবাণীসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে। একই সঙ্গে প্রচারিত হয়েছিল তার বীরত্বগাঁথা।
কিন্তু স্বাধীনতার পরে পূর্ব প্রতিশ্রুতি থেকে ফিরে আসেন সরকার। ১৯৭৩ সালে জগৎজ্যোতিকে 'বীরশ্রেষ্ঠ' খেতাব না দিয়ে ভূষিত করা হয় 'বীরবিক্রম' খেতাবে।
আপন মাতৃভূমির জন্য জগৎজ্যোতি উৎসর্গ করেছিলেন নিজেকে। মুক্তিযুদ্ধের আজকের দিনে মাতৃভূমির জন্য জগৎজ্যাতি নির্দ্বিধায় বিলিয়েছিলেন আপন প্রাণ। জগৎজ্যাতি দাস থাকবেন বাংলার বুকে সূর্যের মতো চির অম্লান হয়ে।
সূত্র:
দাস পার্টির খোঁজে/ হাসান মোরশেদ
সিলেটের যুদ্ধকথা/ তাজুল মোহাম্মদ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: সেক্টর ভিত্তিক ইতিহাস সেক্টর ৫
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র ১০ম খণ্ড
ahmadistiak1952@gmail.com
Comments