পর্যালোচনা

রক্তের অক্ষর : এক যুদ্ধকন্যার পরিণতি

কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমানের বিচরণ সব শাখায়। তার "ঘর ভাঙা ঘর "সূর্য সবুজ রক্ত","শিলায় শিলায় আগুন", "বং থেকে বাংলা" এবং "রক্তের অক্ষর" পাঠকমহলে বেশ সমাদৃত। অরুণাভ সিং এর অনুবাদে "রক্তের অক্ষর" "লেটার্স অব ব্লাড" নামে প্রকাশিত হয়েছে ভারত, আমেরিকা ও বাংলাদেশ থেকে। এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু প্রাসঙ্গিক। 

সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায়  বিশাল সংখ্যক ভুয়া লোক বাদ দেওয়ার সংবাদ চোখে পড়ছে। প্রসঙ্গে "রক্তের অক্ষর"- এ আবার চোখ বুলানোর লোভ সামলাতে পারিনি। এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু কেন এখন আলোচনা করা জরুরি সেটা তুলে ধরব।

'সতী', 'অসতী', 'জারজ'- সংবেদনশীল এই তিনটি ইস্যুতে জাতীয় কবি কাজী নজরুল লিখেছেন 'বারাঙ্গনা' নামক কবিতাটি। বলেছেন, 'অসতী মাতার পুত্র সে যদি জারজ-পুত্র হয়,/অসৎ পিতার সন্তানও তবে জারজ সুনিশ্চয়!' কবির প্রশ্ন আমার—আপনার বাবা, ভাই, চাচা, শিক্ষক, দাদা, নানা  না গেলে পতিতালয়ে যায় কারা আসলে। 'কামজ' আর 'জারজ' এই দুইয়ের মধ্যে প্রভেদ নেই সেই কথাটাই বলেছেন কবি। আর রিজিয়া রহমান "রক্তের অক্ষর" এর মাধ্যমে বিষয়টা আরও গুরুত্বের সাথে তুলে এনেছেন।     

বাংলাদেশের যৌনকর্মীদের জীবন যাপন এবং সামাজিক বাস্তবতা নিয়ে বনানী বিশ্বাস লিখেছেন "যৌনকর্মীর জীবন" একটা গবেষণামূলক গ্রন্থ। তাদের চোখের জল, শরীরের খেদ, বঞ্চনা, সুখ-দুঃখ, স্বপ্ন-বাস্তবতা নিয়ে এই বই। রিজিয়া রহমান সাহিত্যের আশ্রয়ে "রক্তের অক্ষর" উপন্যাসে তুলে ধরেছেন ইয়াসমিন নামের এক বীরাঙ্গনার জীবন কাহিনী। স্বাধীন দেশে এক প্রকার বাধ্য হয়ে, পতিতা বৃত্তিতে জড়িয়ে পড়েন সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে 'রক্তের অক্ষর' পড়া জরুরি। পতিতালয়ের মেয়েদের  মানবেতর জীবন ও তাঁদের বাঁচার আকুতিভরা দীর্ঘশ্বাসও ফুটে উঠেছে।

এর  মূল চরিত্র কে সেটা শেষ পর্যন্ত না পড়লে বলা বা সিদ্ধান্ত নেওয়া মুশকিল। ইয়াসমিনকে মূল চরিত্র ধরে আলাপ এগোনোর চেষ্টা করব। ইয়াসমিন শিক্ষিত। যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা যুবক কামালকে তাদের বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে হানাদার বাহিনী তাকে তুলে নিয়ে যায়। যুদ্ধ শেষে ক্যাম্প থেকে ফিরে সে দেখতে পায় চারদিকের পৃথিবী বদলে গেছে। মামা-চাচা নিরাপদ দূরত্ব রেখে চলছেন।

যুদ্ধপরবর্তী সময়ের বর্ণনা পাই আমরা এভাবে, 'মায়ের বুকে যোদ্ধা সন্তান ফিরে এলো। মানুষের জীবনযাত্রার চাকা আবার স্বাভাবিক গতিতে ঘুরল। খবরের কাগজে নাম গোপন করে অনেক মর্মস্পর্শী রিপোর্ট ছাপা হয়েছে তাদের সম্পর্কে। লোকে সাগ্রহে পড়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভাবছে—'খুব বেঁচে গেছি, আমার স্ত্রী-কন্যা-বোনের এই দশা হয়নি।'     

যুদ্ধ শেষে ক্যাম্প ফেরত ইয়াসমিনকে কেউ আশ্রয় দেয়নি। ফিরে এসে ইয়াসমিন তার চাচাকে প্রশ্ন করে কেন তারা তার খবর নেয়নি বা খোঁজ করেনি। তখন তার চাচা উত্তর দিয়েছিল, 'কোথায় খুঁজব? আমি কি ভেবেছি যে তুই বেঁচে আছিস?' ইয়াসমিনের তীক্ষ্ম জবাব শুনে চমকিত হয় চাচা। 'মরে গেলে বোধহয় খুশি হতে। শোনো চাচা! সবাই মরে না। যন্ত্রণার সাক্ষী হয়ে অনেককে বেঁচে যেতে হয়।' এটাই মানুষের নিয়তি। অনেক সময় দুঃখী মানুষের বেঁচে থাকাটা  হয়ে উঠে অন্য মানুষদের জন্য একটা জীবনমুখী শিক্ষা। 

পরিবার, প্রেমিক এবং সমাজের চোখে পরিত্যক্ত ইয়াসমিন যুদ্ধের পর হন্য হয়ে চাকরি খুঁজেছে। চাকরির ভাইবাতে গিয়ে ক্যাম্পে ঘটা দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাওয়া হলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে সে। বিয়েও করেছিল। স্বামী ছিল পাষণ্ড। ইয়াসমিনকে সম্মান করতে পারেনি সেই স্বামী। স্বামীর হাতে বীভৎস অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছিল। এক পর্যায়ে পতিতাপল্লীতে গিয়ে ওঠে ইয়াসমিন। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় এটা অনেক নারীর নিয়তি। ভাত কাপড়ের বিনিময়ে অনেক মেয়েকে সহ্য করতে হয় সংসার নামক হাবিয়ার অকথ্য ও অসহ্য নির্যাতন। 

রিজিয়া রহমান পাঠককে জানাচ্ছেন স্বাধীনতার অল্প ক'দিনের মধ্যে কীভাবে একটা দেশ হায়েনা-দুর্বৃত্তের লোলুপতার শিকার হয়। বীরাঙ্গনা ইয়াসমিন সবকিছু হারিয়ে পতিতালয়ে আশ্রয় নেন৷ সে আরেক জগত। মেয়েদেরকে বিভিন্ন জায়গা থেকে ফাঁদে ফেলে আনা হয়। প্রথম দিকে কান্নাকাটি করলেও পরে বাস্তবতার নিকট হার মানতে হয় তাদের সবাইকে। কারো সৎ মা'র অত্যাচারে ঘর ছাড়তে হয়, কেউ গুণ্ডার হাতে পড়ে, কেউ অভাবে পড়ে, আবার কেউ ভাই বউয়ের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পল্লীতে আসে। কি দুর্বিষহ, মানবেতর জীবন তাদের। হিরু, কালু প্রমুখ দালালের হাতে ওরা বিক্রি হয়ে পল্লীতে আসে। নিয়মিত খেতে পায় না, কিন্তু খদ্দেরের চাহিদা মেটাতে হয় নিয়মিত। নিয়তির হাতে তারা পুতুল যেন। মানুষের এই দুর্বিষহ পরিস্থিতির জন্য দায়ী মানুষের লোভ ও ক্ষমতার প্রতি লালসা।

মার্ক্সের এলিয়েনেশন তত্ত্বের আলোকে বিচার করলে এরা আসলে চরমভাবে বঞ্চিত। মার্ক্সের মতে একজন শ্রমিক চার ধাপে বিচ্ছিন্ন। প্রথমত, তার শ্রম দ্বারা উৎপাদিত পণ্য হতে সে বিচ্ছিন্ন। দ্বিতীয়ত, নিজের কর্মক্ষমতা থেকে বিচ্ছিন্ন। তৃতীয়ত, মানুষ হিসেবে বিচ্ছিন্ন। এবং, অন্যান্য কর্মী বা সহকর্মীদের থেকে বিচ্ছিন্ন। "রক্তের অক্ষর"- এ  উল্লিখিত গোলাপিপট্টির মেয়েরা যৌবনের দাস। অনিচ্ছাসত্ত্বেও দিনরাত শরীর বিক্রি করতে হয় তাদের৷ বিকৃতকাম পুরুষের দাবি মেটাতে গিয়ে তারা ভুলে যায় নিজের কথা। দার্শনিক এমারসনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তারা নিজের আবেগকে পশ্রয় দিতে পারে না। নিজের আত্মার অস্তিত্বের কথা তাদের ভুলে যেতে হয়। 

কথায় আছে বিপদে বন্ধুর পরিচয়। ইয়াসমিন যাকে বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে পাকিস্থানিদের লোলুপতার শিকার হয়েছিল সেই কামাল একদিন আসে তার কাছে খদ্দের হয়ে। মুক্তিযোদ্ধা কামাল স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিপথে চলে যায়। জুয়া,মদ ও নারী শরীর হয়ে উঠে কামালের ভোগপিপাসা।

স্বাভাবিকভাবে দুজন নারী-পুরুষের মিলনের অন্যতম লক্ষ্য হলো পরবর্তী প্রজন্মের মুখ দেখা। কিন্তু পট্টির মেয়েরা উভয় দিক থেকে বঞ্চিত। তারা না পারে যৌবন উপভোগ করতে, না পায় মাতৃত্ব। নানারকম জন্মনিরোধক ওষুধ খাওয়ার পরও কেউ গর্ভবতী হয়ে গেলে নিজেকে ধিক্কার দেয় এরা। একে তো নিজে চলতে পারে না, সন্তানকে কি খাওয়াবে? যাদের ছেলেমেয়ে হয়ে যায় তারা মায়ের কাছে বাচ্চা রেখে পাশের ঘরে দেহ বিক্রি করে। এক কথায় তারা সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের অধিকার বঞ্চিত যা মানবাধিকারের চূড়ান্ত লঙ্ঘন।  

রোগ, শোক, বালাই সবকিছু উপেক্ষা করে খদ্দেরের খোঁজে নামতে হয় এমন মেয়েদের । এই কাজ করতে গিয়ে  তারা বিরোধে জড়িয়ে পড়ে নিজেদের মধ্যে। মারামারি, ঝগড়াঝাঁটি তো নিয়মিত ঘটনা তাদের। এদের কেউ কেউ মারা যায় নানারকম প্রাণঘাতী বালাইয়ের শিকার হয়ে। সহকর্মীর মৃত্যুতে এদের কারো ভ্রুক্ষেপ নেই। কারণ তারা অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধে লড়তে লড়তে  ক্লান্ত। গোলাপিপট্টিতে এ-ও দেখা যায় যে ঘর তুলে মেয়েকে দেহব্যবসা করতে দিচ্ছেন মা। এ যেন চিনুয়া আচেবের "সবকিছু ভেঙে পড়ে" বা হুমায়ুন আজাদের 'সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে' আশংকার প্রতিফলন। 

কথায় আছে বিপদে বন্ধুর পরিচয়। ইয়াসমিন যাকে বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে পাকিস্থানিদের লোলুপতার শিকার হয়েছিল সেই কামাল একদিন আসে তার কাছে খদ্দের হয়ে। মুক্তিযোদ্ধা কামাল স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিপথে চলে যায়। জুয়া,মদ ও নারী শরীর হয়ে উঠে কামালের ভোগপিপাসা। কামালের সঙ্গে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে  কামালের মাথা ফাটিয়ে দেয় ইয়াসমিন। ক্ষিপ্ত ইয়াসমিন বলেন, 'আমার যা হয়েছে তা নিয়ে তোমার আর মাথা না ঘামালেও চলবে। আজকের যে তোমাকে দেখছি সেই তোমাকে আমরা বাড়িতে আশ্রয় দেইনি। আশ্রয় দিয়েছিলাম একজন মুক্তিযোদ্ধাকে। যে দেশের জন্য, সবার জন্য যুদ্ধে গিয়েছিল। যার জন্য সেদিন আমি বাবা-মা, ভাইবোন সবাইকে হারিয়েছি। আর আমি হয়েছি বেশ্যা।' 

রক্তের অক্ষর উপন্যাসে বিপথে যাওয়া কামালের সাথে সৈয়দ হকের দি ড্রিম ইটার উপন্যাসের মুশতাকের মিল দেখতে পাই আমরা। দু'জনই নিয়তি ও পরিস্থিতির অসহায় শিকার। 'দীর্ঘদিনের পচন কি একদিনে সারা যায়?'-- পট্টির মাসী যে নিজেও একদিন মালিকের বাঁধা সেবিকা ছিল তার হয়ে অন্য মেয়েদেরকে শাসায় প্রতিবাদ না করতে। মুখ বুজে শরীর বিক্রি করে তিলে তিলে নিজেকে শেষ করার প্ররোচনা দেয়। 

উপন্যাসের শেষের দিকে বেশ্যার দালাল হিরু গোলাপি নামের এক যুবতী মেয়ে এনে চার পাঁচ জন মিলে ধর্ষণ শুরু করলে ইয়াসমিন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেননি। অন্য মেয়েদের সমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হয়ে সে নিজে এগিয়ে যায় উন্মত্ততা থামাতে। নিজের প্রাণ হারায় দালাল হীরুর হাতে। তার হাতে থাকা বইয়ের ছেঁড়া পাতা  রক্তে ভিজে যায়। রক্তের দাগ লেগে থাকে বইয়ের পাতায়। যেখানে লেখা, 'Man is born free, but everywhere is in chain'।  

রাতের আঁধারে পুরুষ পট্টির মেয়েদের বুকে স্থান দিলেও, সমাজ সংসারের বুকে ঠাই হয় না তাদের। সমাজে তাঁরা অচ্ছুত। দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে আমাদের বিজয় আসলেও উপাক্তেয় থেকে সেসব বীরাঙ্গনা মা বোন যাদের সম্ভ্রম ও স্বাভাবিক জীবন বিসর্জনের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি লাল সবুজের পতাকা। রিজিয়া রহমানের স্বচ্ছন্দ বাস্তবিক বয়ান এবং ইয়াসমিন চরিত্রের চিত্রায়ন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় 'স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন'।

Comments

The Daily Star  | English

Why gold costs more in Bangladesh than in India, Dubai

Gold prices in Bangladesh continue to soar, leaving many to wonder why the precious metal costs more here than in neighbouring India or the global trading hub Dubai.. According to market data, gold now sells for $1,414 per bhori (11.664 grammes) in Bangladesh, compared to $1,189 in India a

25m ago