এস এম সুলতান: বাংলার মাটি ও মানুষের শিল্পী
চিত্রা নদীর পাড়ে ঝাঁকড়া চুলের এক নিবিষ্ট মানব এঁকেই চলেছেন বাংলার গ্রামীণ জীবন, কৃষক, আবহমান বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য, দ্রোহ-প্রতিবাদ এবং প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে থাকার অনন্ত সংগ্রাম। চোখের পুরু লেন্সের চশমা হেলে পড়ছে, তবুও থামছে না হাত। সেই চোখে কী অদ্ভুত এক জ্যোতির ছাপ। সচরাচর আমরা দেখি কৃষকের রুগ্ন চেহারা, মেদহীন এক শীর্ণকায় প্রতিকৃতি, কৃশ। আর সেই পুরু লেন্সের মধ্য দিয়ে সে চোখ দেখে বলিষ্ঠ, পেশিবহুল কৃষকের ছবি। আঁকতে থাকেন বিদ্রোহ, চিরন্তন অন্নদাতার প্রকৃষ্ট ছবি।
চিত্রা নদীর তীর ঘেঁষা পৈতৃক ভিটে পুরুলিয়া গ্রাম ছেড়ে তিনি কখনো আলোচনায় আসতে চাননি, চাননি তাকে নিয়ে মাতামাতি হোক। আর তাই একটা সময় তাকে ঢাকায় আনার পর স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না করায় ফিরে গিয়েছিলে নিজের গ্রামেই। নিজের আপন জগতে বুঁদ হয়ে থাকতেন তিনি। কাটিয়েছেন এক অনন্য জীবন।
অপূর্ব বাঁশি বাজাতেন। বাজাতেন তবলা। শাড়ি পরে পায়ে ঘুঙুর পায়ে নাচতেন আপন খেয়ালে। বিশ্বখ্যাত কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় যখন তাকে 'ম্যান অব অ্যাচিভমেন্ট' সম্মাননা প্রদান করল তখনো তিনি বললেন, 'শিল্পের কখনো পুরস্কার হয় না। শিল্পের ভার তো প্রকৃতি স্বীয় হাতে প্রদান করে।'
তিনি এস এম সুলতান।
আহমদ ছফা লিখেছিলেন, 'কোনো কোনো মানুষ জন্মায়, জন্মের সীমানা যাদের ধরে রাখতে পারে না। অথচ যাদের সবাইকে ক্ষণজন্মাও বলা যাবে না। এরকম অদ্ভুত প্রকৃতির শিশু অনেক জন্মগ্রহণ করে জগতে, জন্মের বন্ধন ছিন্ন করার জন্য যাদের রয়েছে এক স্বভাবিক আকুতি। শেখ মুহাম্মদ সুলতান সে সৌভাগ্যের বরে ভাগ্যবান, আবার সে দুর্ভাগ্যের অভিশাপে অভিশপ্ত।'
সুলতানের ডাক নাম ছিল লাল মিয়া। তার বাবা শেখ মোহাম্মদ মেসের আলী মূলত কৃষক হলেও রাজমিস্ত্রীর কাজও করতে হতো তাকে। সুলতানকে স্কুলে পড়ানোর মতো সামর্থ্য ছিল না পরিবারের। তাই পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া অবস্থাতেই তাকে স্কুলের পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয়েছিল।
সালটা ১৯৩৩। সে বছরই বিখ্যাত রাজনীতিবিদ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী এসেছিলেন নড়াইলের ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুল পরিদর্শনে। সুলতান তার একটি পেন্সিল স্কেচ এঁকেছিলেন। শ্যামাপ্রসাদ মাত্র ১০ বছর বয়সি এক বালকের আঁকা স্কেচ দেখে ভীষণ মুগ্ধ হয়েছিলেন। সেই পেন্সিল স্কেচের মাধ্যমেই শিল্পী হিসেবে সুলতানের প্রথম আত্মপ্রকাশ।
শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর মুগ্ধতা প্রকাশের কারণ এবং সুলতানের প্রতিভা দেখে এগিয়ে এলেন জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায়। ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের ভাইপো অরুণ রায় তখন কলকাতা আর্ট স্কুলের ছাত্র। জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ ভাইপোকে বলতেই অরুণ রায়ই সাগ্রহে সুলতানকে ছবি আঁকা শেখাতে রাজি হয়ে গেলেন। ছুটিতে যখনই অরুণ রায় বাড়িতে আসতেন, সর্বসঙ্গী হিসেবে থাকতেন সুলতান।
গতানুগতিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কখনোই টানেনি সুলতানকে। তাই অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থাতেই তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি। এক পর্যায়ে কলকাতা যাত্রা। উদ্দেশ্য আর্ট স্কুলে ভর্তি। কিন্তু বিধিবাম হয়ে দাঁড়ালো তার কম বয়স এবং এন্ট্রান্স পাশ না হওয়া। তাই কখনো ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের বাড়ি, কখনো তার ভাই সত্যেন রায়ের বাড়ি, আবার কখনো অন্য ভাইদের বাড়িতে থেকে সুলতান ছবি আঁকা শিখেছিলেন।
আর্ট স্কুলে তার ভর্তির পেছনে ছিলেন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ স্যার হাসান সোহরাওয়ার্দী। কলকাতা আর্ট স্কুলের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য তখন তিনি। ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের কাছে জানতে পেরে তিনিই এগিয়ে এসেছিলেন সুলতানের সাহায্যে।
চল্লিশের দশকের প্রথমভাগে আর্ট স্কুলের সেই ভর্তি পরীক্ষায় ৪০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রথম হয়েছিলেন সুলতান। পরীক্ষায় ১৫ মিনিট সময়ে আঁকতে দেয়া হয়েছিল ভেনাস ডি মিলোর ছবি।
হাসান সোহরাওয়ার্দীর বাড়ির সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার ছিল সুলতানের জন্য উন্মুক্ত। এসময় আর্ট স্কুলে কামরুল হাসান, সফিউদ্দিন আহমেদের মতো কিংবদন্তি শিল্পিদের সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলেন সুলতান। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সেখানেও টানেনি সুলতানকে। তাই আর্ট স্কুলের তৃতীয় বর্ষে সেই যাত্রারও ইতি।
১৯৪৩ এ আর্ট স্কুল ছাড়লেন সুলতান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাঁধাধরা জীবন এবং প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার কঠোর রীতিনীতি সুলতানের জীবনের সাথে কখনোই সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। এসময় সুলতান খাকসার আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। তখন ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। অনেক মার্কিন ও ব্রিটিশ সেনা ছিল ভারতে। সুলতান ছোট-বড় বিভিন্ন শহরে ঘুরে ঘুরে ছবি এঁকে তা সেনাদের কাছেই বিক্রি করতেন। বেশ কয়েকটি শহরে প্রদর্শনী হয়েছিল তার আঁকা চিত্রকর্মের। সুলতানের প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিল ১৯৪৭ সালে শিমলায়। সেই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেছিলেন কাপুরতলার মহারাজা।
দ্বিতীয় প্রদর্শনী হয়েছিল লাহোরে। সালটা ছিল ১৯৫০। উদ্বোধন করেছিলেন মালিক ফিরোজ খান নূন। একই বছরে করাচিতে হওয়া তার আরেক প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেছিলেন ফাতেমা জিন্নাহ। এসময় সুলতান মার্কিন সরকারের আমন্ত্রণে মার্কিন মুলুক ঘুরে এলেন। বিলেতের লেইস্টার গ্যালারিতে তার ছবি প্রদর্শিত হয়েছিল পিকাসো, সালভেদর দালির চিত্রকর্মের সঙ্গে। সুলতানের জীবনমুখী ও বাংলার মায়াবি রূপের সেসব চিত্রকর্ম তুমুল আলোড়িত এবং প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু সুলতানের সেসব ছবি পরে আর পাওয়া যায়নি। এক সাক্ষাৎকারে সুলতান বলেছিলেন সেই সময়ে তার জীবন নিয়ে, 'একেক জায়গায় এভাবে পড়ে আছে সব। শ্রীনগরে গেলাম। সেখানকার কাজও নেই। শ্রীনগরে থাকাকালীন পাকিস্তান হয়ে গেল। '৪৮-এ সেখান থেকে ফিরে এলাম। কোনো জিনিসই তো সেখান থেকে আনতে পারিনি। একটা কনভয় এনে বর্ডারে ছেড়ে দিয়ে গেলো। পাকিস্তান বর্ডারে। আমার সমস্ত কাজগুলোই সেখানে রয়ে গেলো। দেশে দেশে ঘুরেছি। সেখানে এঁকেছি। আর সেখানেই রেখে চলে এসেছি।'
১৯৫৩ সালে করাচি থেকে ঢাকায় ফেরেন সুলতান। সেখান থেকেও সবকিছু ছেড়ে চলে গেলেন সকলের অজ্ঞাতে নড়াইলের পুরুলিয়া গ্রামে। তখন তিনি ছবি আঁকা প্রায় ছেড়েই দিলেন। সত্তরের দশকের মাঝামাঝিতে কয়েকজন শুভানুধ্যায়ীর আকুল প্রচেষ্টায় তাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হলো।
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত আমরা সুলতানকে মূল্যায়নই করতে পারিনি। অথচ ঠিক তখনই আমাদের দেশের আধুনিক চিত্রশিল্পের বিকাশ হয়েছিল।
১৯৭৫ সালে শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় প্রদর্শনীতে তিনি ছবি পাঠালেন। তার ১৭টি তৈলচিত্র, জলরং, কালি কলমের স্কেচ ও চারকোলের চিত্রকর্ম নিয়ে ১৯৭৬ সালে শিল্পকলা একাডেমীতে বিশাল প্রদর্শনী হয়েছিল। সুলতান তখন নতুন এক রূপে আমাদের সামনে উন্মোচিত হলেন। ২২ বছর পর সুলতান জানালেন চিত্রশিল্পী হিসেবে তার মৃত্যু হয়নি।
বাংলাদেশে আধুনিক ইতিহাস গবেষণার পথিকৃৎ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম প্রদর্শনী দেখে লিখেছিলেন, 'Here is a display with difference in the sense that never before had any artist dared to wield masterly strokes on such a large canvas and in such a large scale. … S M Sultan provides a moral and spiritual touch in his exceptionally powerful paintings.'
পুরুলিয়ায় সুলতানের অসংখ্য ছবি নষ্ট হয়েছে, সংরক্ষিত হয়নি। অসংখ্য ছবি বৃষ্টিতে ভিজে ও রোদে পুড়ে নষ্ট হয়েছে। অন্যদিকে অনেক ছবি দেশে বিদেশে ফেলে এসেছিলেন। যার প্রতিটিই ছিল আমাদের চিত্রকর্মের ইতিহাসে অমূল্য সম্পদ।
সুলতানের ছবিতে আমরা দেখি গ্রামবাংলার নতুন এক প্রতিচ্ছবি। একই সাথে তার এ ছবিগুলোতে গ্রামীণ প্রেক্ষাপটের শ্রেণি-দ্বন্দ্ব এবং গ্রামীণ অর্থনীতির ক্রূর বাস্তবতাও উঠে এসেছে। সুলতানের ছবিতে আমরা দেখতে পাই পেশিবহুল কৃষকের ছবি, দেখতে পাই বলিষ্ঠ আকার। এই নিয়ে জবাবটা সুলতান নিজেও দিয়েছিলেন।
সুলতান বলেছিলেন, 'আমাদের দেশের মানুষ তো অনেক রুগ্ন, কৃষকায়। একেবারে কৃষক যে সেও খুব রোগা, তার গরু দুটো, বলদ দুটো -সেটাও রোগা। আমার ছবিতে তাদের বলিষ্ঠ হওয়াটা মনের ব্যাপার। মন থেকে ওদের যেমনভাবে আমি ভালোবাসি যে আমাদের দেশের কৃষক সম্প্রদায়ইতো ব্রিটিশ সাম্রাজ্য গড়েছিলো। অর্থবিত্ত ওরাই তো যোগান দেয়। ...আর এই যত জমিদার রাজা মজারাজা আমাদের দেশের কম কেউ না। সবাই তো কৃষিনির্ভর একই জাতির ছেলে। আমার অতিকায় ছবিগুলোর কৃষকের অতিকায় অতিকায় দেহটা এই প্রশ্নই জাগায় যে, ওরা কৃশ কেন? ওরা রুগ্ন কেন- যারা আমাদের অন্ন যোগায়। ফসল ফলায়।'
সুলতান আধুনিকতার একটি নিজস্ব সংজ্ঞা গ্রহণ করেছিলেন।
শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সুলতান সম্পর্কে এক লেখায় বলেছিলেন, 'তিনি ফর্মের নিরীক্ষাকে গুরুত্ব দেননি, দিয়েছেন মানুষের ভেতরের শক্তির উত্থানকে, ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই এবং ঔপনিবেশিক সংগ্রামের নানা প্রকাশকে তিনি সময়ের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থাপন করেছেন। এটাই তাঁর কাছে ছিল "আধুনিকতা", অর্থাৎ তিনি ইউরো-কেন্দ্রিক, নগর নির্ভর, যান্ত্রিকতা-আবদ্ধ আধুনিকতার পরিবর্তে অন্বেষণ করেছেন অনেকটা ইউরোপের রেনেসাঁর শিল্পীদের মতো মানবের কর্মবিশ্বকে।'
এস এম সুলতানের পোষা বেশ কয়েকটি বিড়াল ছিল। তার কাছে যেসব মানুষ এবং শিশু আশ্রয় নিয়েছিল তাদের জন্য তিনি নিজের ঘর ছেড়ে দিয়েছিলেন। একসময় সুলতান শিশুদের জন্য একটি বড় কাঠের নৌকাও তৈরি করেছিলেন। তার ইচ্ছা ছিল শিশুরা সেই নৌকায় চড়ে সমুদ্র পরিভ্রমণে বের হবে আর শিল্পচর্চার উপকরণ খুঁজে পাবে। সুলতান বলতেন, 'যে শিশু সুন্দর ছবি আঁকে, তার গ্রামের ছবি আঁকে, সে সুন্দর ফুলের ছবি আঁকে, তার জীবজন্তুর ছবি আঁকে, গাছপালার ছবি আঁকে, সে কোনোদিন অপরাধ করতে পারে না, সে কোনোদিন কাউকে ব্যথা দিতে পারে না।'
সুলতান দ্বিধাহীনভাবে অকপটে বলতেন, 'আমি সুখী। আমার কোনো অভাব নেই। সকল দিক দিয়েই আমি প্রশান্তির মধ্যে দিন কাটাই। আমার সব অভাবেরই পরিসমাপ্তি ঘটেছে।'
বেঁচে থাকলে আজ শতবর্ষ পূর্ণ হতো বাংলার মাটি ও মানুষের শিল্পী শেখ মোহাম্মদ সুলতানের। জন্মশত বার্ষিকীতে এস এম সুলতানের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
তথ্য সূত্র-
বাংলার চিত্র-ঐতিহ্য: সুলতানের সাধনা: আহমদ ছফা
বাঙালি মুসলমানের মন: আহমদ ছফা
সুলতান: হাসনাত আবদুল হাই
এস এম সুলতান বৈচিত্র্যময় শিল্পজীবন: সুভাষ বিশ্বাস
Comments