জুমঘর আর ঝর্ণা বিলাস

আমতলী ঘাট। ছবি: তানজিনা আলম

অলিখিত একটি প্রবাদ আছে, ভ্রমণপ্রেমী মানুষ কখনো খারাপ হয় না। আক্ষরিক অর্থে, প্রকৃতির বিশালতা যারা দেখতে থাকেন, তারা সংকীর্ণ চিন্তা করতে পারেন না বলেই উদার এবং বিনয়ী মানসিকতার হন।

স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা একজন অফিসে, তো আরেকজন ঘরবন্দী। কেউ হয়ত আরামপ্রিয়, কেউ পাহাড় থেকে সমুদ্র হয়ত বেশি পছন্দ। তাই ভরসা, ট্যুর গ্রুপ আর নতুন নতুন উদ্যমী ভ্রমণসঙ্গী, একজন হোঁচট খেলে অবচেতনভাবেই ধরে ফেলতে গিয়ে চেনা হয়ে যায় একেকজনকে। আলাপ হতে হতে তারা হয়ে যেন যায় বহুলগ্নের পরিচিত।

ঢাকা থেকে বাসে চকরিয়া পৌঁছাতে বাজে সকাল ৮টা। নাস্তা করে সেখান থেকে চাঁদের গাড়িতে আলীকদম নেমে পানবাজারে। তবে মাঝে ২ বার ফোন নম্বরসহ এনআইডির ফটোকপি জমা দিতে হয় সেনাবাহিনীর কাছে। পানবাজার থেকে প্রয়োজনীয় রসদ কিনে যেতে হয় আমতলী ঘাট। এই ঘাট থেকে ইঞ্জিন চালিত নৌকা নিয়ে তৈনখাল ধরে এগিয়ে দুছরিবাজার যেতে সময় লাগে ২ ঘণ্টার মতো। নৌকার ভাড়া ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা। ৭ থেকে ৮ জন যাওয়া যায়।

'দুছড়ি' ও 'তৈন' খালের (তৈনখাল খরস্রোতা মাতামুহুরীর একটি উপনদী) মিলনস্থলে অবস্থিত ছোট একটি বাজার। আশেপাশের আদিবাসী চাকমা, মুরং, ত্রিপুরা পাড়ার প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। জুমের উৎপাদিত ফসল তারা এখানে বিক্রি করে এবং কিনে নিয়ে যায় নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী। পর্যটকদের জন্যও দুছড়িবাজার গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখান থেকেই দুছড়ি খাল ধরে কির্সতং, রুংরাং ট্রেকিং শুরু করতে হয় এবং তৈন খাল হয়ে থানকোয়াইন, পালংখিয়াং ঝর্ণার ট্রেকিং শুরু করতে হয়। এখানেও আর্মিকে আবার সবার কাগজ জমা দিতে হয়। ম্রো পাড়ার এই বাজারের অলস দুপুরেই নামল ঝুম বৃষ্টি। তাদের কেউ থামি বুনছে, গল্পে হাসিতে ঢলে পড়ছে। ভ্রমণপিপাসু সমতলবাসীদের দেখে অভ্যস্ত তারা।

যেহেতু গন্তব্য ঝর্ণা, তাই দুছড়িবাজার থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে থানকোয়াইন ঝর্ণার উদ্দেশ্যে তৈন খাল ধরে হেঁটে প্রায় দেড়-২ ঘণ্টার মধ্যে দেখা যাবে এই ঝর্ণা (হাঁটার গতির তারতম্যের উপর সময় নির্ভর করে) ।

দুছরিবাজার থেকে নেমে নৌকার পথে। ছবি: সংগৃহীত

প্রথমে পাহাড়ে ওঠা আবার নিচে নামা, এরপরেই দেখা মিলে নৈসর্গিক থানকোয়াইন ঝর্ণার যা মিলে তৈন খালে আর উৎপত্তি থানকোয়াইন ঝিরি থেকে। ঝর্ণায় পৌঁছে কেউ গা এলিয়ে, কেউ প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য দেখে কাটায় খানিকক্ষণ। আবার যাত্রা, হাঁটতে হবে।

এমন অনেক নাম না জানা ঝিরিতে অলেখা চিঠিগুলো ভাসিয়ে দেয়া যায়। প্রাপক পাহাড়। ছবি: সংগৃহীত

একজন পিছিয়ে গেলে আরেকজন সাহায্য করে, সাহস দিয়ে, কখনো হাত বাড়িয়ে দিয়ে। এই বন্ধুর পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দলকে। নিচে খুম থাকায় সহজে পার হওয়া যায়না বলে অনেকে সুবিধার জন্য হাজিরাম পাড়ায় রাত্রিযাপন করেন। এই পাড়াতে ৮টি পরিবারের বাস।

আমাদের ঠাঁই একজন আদিবাসী স্কুল শিক্ষক দাদার ঘরে। ভীষণ অমায়িক। মারফা, শসা কেটে দিয়ে আতিথেয়তা শুরু করেন। ভুট্টা পুড়িয়ে, আঁখের গিট ভেঙে দিয়ে দিদিও করেন আপ্যায়ন। রাতে এবারে রান্নার প্রস্তুতি। সুজন ভাই নিজ গৃহে অলস হলেও, অন্যদের পেটপূজোর ব্যবস্থায় পটু। সহকারী হিসেবে নিজের সামান্য প্রতিভা নিয়ে বীরদর্পে ছিলাম আমিও। খেয়ে ৩ জন নারী সদস্য ঘুমিয়ে যাই। দিদি আর পাঁচ বছর বয়সী জ্যাকলির সঙ্গে।

সকালে থালাভর্তি নুডুলস কেবল মশলা দিয়ে সেদ্ধ করা, উপরে মিনিপ্যাক সস দিয়ে এতই অমৃত লাগছিল মনে হলো এতদিন নুডুলস রান্নায় শ্রম আর সময় দেওয়া বিলাসিতা ছিল।

নামতে নামতে দূর থেকে দেখা হয়ে গেলো বেশ বড় একটা পাহাড় রুংরাং। ছবি: তানজিনা আলম

পালং খিয়ং

আবার হাটা শুরু ছোট ব্যাগে কেবল গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিয়ে। কারণ যেতে হবে আরও উজানে। ৩ ঘণ্টা হাঁটার পর পাওয়া যাবে আরেক রূপসী ঝর্ণা পালংখিয়াং। যার দুর্গমতার কারণে খুব বেশে পর্যটক সেখানে পৌঁছায়নি। তৈনখালের পাথুরে আর শেওলা পিচ্ছিল রাস্তা, কখনো উঁচু পাহাড় ডিঙ্গানো। তবে ঝর্ণায় যাওয়ার পথে তৈন খালের যে নৈসর্গিক রূপ তা বলে বোঝানো মুশকিল।

সবুজের বিশাল সমারোহ। ছবি: তানজিনা আলম

তৈনখালের আকেবাঁকে নাতিদীর্ঘ পাহাড় চূঁড়ায় মারমা, মুরং, ত্রিপুরাদের বাঁশের ঘর। ঘর থেকে আবার কোনো দেবশিশু উকি দিয়ে দেখে আমাদের। না বোঝে আমাদের ভাষা,না বুঝি আমরা ওদের ভাষা।

ছায়াভরা শান্ত পথ, ক্ষুদ্র ঝিরি-ঝর্ণা, পরিচিত পাখির কল- কাকলী, এসব যেন মর্তের পৃথিবীতে এক স্বর্গরাজ্য। কখনো কখনো হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেলে দলের সদস্যদের জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে পা ভিজিয়ে রাখা যায় ঝিরিপথে। তখন যেন-'দুপায়ে এসে ঢেউ দেয় ইশারা, হাজারো ইচ্ছে দিচ্ছে তাড়া।'

দূর থেকে পালং খিয়ংয়ের পেছনের অংশ। ছবি: তানজিনা আলম

কখনো কখনো একঝাঁক রঙিন প্রজাপতি, কখনো একটানা ঝিঝির শব্দ। এর মধ্যেই বৃষ্টি প্রায় খাড়া পথ দুরূহ করে দিলেও অসম্ভব নয় কেবল ইচ্ছা থাকলে। শহুরে রঙিন জনপদের চেয়ে সাদামাটা কিন্তু ভীষণ আবেদনময়ী। পালং খিয়াং দুর্ধর্ষ রূপ দেখতে যাওয়ার আগে পাড়ি দিতে হয় তৈনখালের পাথুরে দীর্ঘপথ। মনোহর এ পথ পার হওয়ার সময় মনে হয় এখানে বাস করে প্রজাপতি আর পরী। খালের দু'পাশজুড়ে ঘন নাম না জানা লতাপাতা সারা বছরজুড়েই বন্যপুষ্পের পসর সাজিয়ে রাখে। সব শব্দকে ছাপিয়ে নিজের অস্তিত্বকে ৩টি পানি স্রোতের ধ্বনিতে জানান দেয় পালং খিয়াং। এ ভীষণ বুনো ঝর্ণার আগ্রাসী রূপে যে কেউ মুগ্ধ হবেন এই বাজি ধরা যায়।

পালং খিয়ং এর পাশে তাঁবুতে রাত্রি যাপনে পর্যটকেরা। ছবি: সংগৃহীত

এই জায়গায় নিজেকে মনে হয় সুখী মানুষ। না মনে পরে কোনো অতীত, না মনে আসে কোনো ভবিষ্যৎ। তখন মনে হয় এ যুগে রাজার অসুখ হলে সুখী মানুষের কাপড় চাইলে এই ৮জনের একটা কাপড় নিলেই গল্পের মতো রাজার অসুখ সারবে।

পালং খিয়ং ঝর্ণার পাশেই উঁচুতে একটা ঘর। পা এলিয়ে সেখানে বসেই কাটিয়ে দেয়া যায় এক দীর্ঘ দিবস-রজনী। ব্যাগ রেখে আমরা নামলাম। গন্তব্য সামনে লাদমেরাগ।

লাদমেরাগ

বনের ঘনছায়ায় নিভৃত সবুজাভ লতাপাতা আর মিশ্র শব্দে বয়ে চলা ঝর্ণা লাদমেরাগ। এর অবিশ্রান্ত ঝর্ণাধারা ঘন অরণ্যানী ভেদ করে সবটুকু পানি ঢেলে দিচ্ছে তৈনখালের বুকে যেন নিজেকে বিকিয়ে রিক্ত হচ্ছে। প্রায় ২০০ ফুট উঁচু পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ছে পানি। এর চারপাশের নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখেনি আর গহীন নিস্তব্ধতা অনুভব করেনি খুব বেশি মানুষ। জনমানবহীন নিবিড় পাহাড়ের বুকে লাদমেরাগ ঝর্ণা পর্যটকদের নজরে এসেছে অল্প কিছুদিন আগে। তবে দুর্গমতা আর দূরত্ব লাদমেরাগ পৌঁছানোর পথে বড় বাধা। তবুও এ বাধাকে জয় করে চলছে দেশের উদ্যমী তরুণ পর্যটকরা। প্রকৃতিও হতাশ করেনি। অথৈ পানির চোখজুড়ানো জলস্রোত,পিচ্ছিল হয়ে যাওয়া খুম, কাদা পেরিয়ে এক ঘণ্টায় লাদমেরাগ পৌঁছেছি আমরা।

বৃষ্টির তীব্রতা আর ঝর্ণার বিশালতা। ছবি: সংগৃহীত

চামরুম ঝর্ণা

এবারে গন্তব্য ৩০ মিনিটের দূরত্বে চামরুম ঝর্ণা। বিশালতার কোনো উপমাই এই ঝর্ণার জন্য যথেষ্ট নয়। দৃষ্টি যতদূর যায়, ঝর্ণাই চোখে পড়ে।

এবার ফিরতে হবে রাত্রি যাপনের জন্য পালং খিয়ং এর সেই ঘরে। ঝর্ণার কাছে গিয়েই সবাই পানিতে নামলেও সুজন ভাইয়ের কাছে এটা নতুন নয়। তিনি ব্যস্ত ছিলেন ঝালমুড়ি আর চা আয়োজনে। খেতে খেতে গানের ঝড় ওঠে। প্রবল বর্ষণ সঙ্গে সুর দিল একটানা। স্বাধীন ভাইয়ের বাঁশিতে তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা আর শো শো শব্দও যেন ফিসফিস করে গলা মেলায়, আমি তোমাকে গড়ি ভেঙেচুরে শতবার। হয়ত পালং খিয়ং জানে আগন্তুকরা কী চায়। নিজেকে গড়ে নিতেই তো আবার পাহাড়ে ছোটে মানুষ।

বাহা ভাই এর ছড়া কানের তৃপ্তি হলে, প্রবাল ভাইয়ের হাসি চোখের তৃপ্তি।কখনো আকাশ ভাই পছন্দের গানে গলা মেলান। একসময় খিচুড়ি ডিম আর আচার খেয়ে কেও আড্ডায়,কেও ঘুমে। সকালে থালাভর্তি নুডুলস নিয়ে সুজন ভাই পেটের আনন্দের ব্যবস্থা করেন সবার।

ফিরতে হবে, পাহাড়ে উঠতে হবে আবার, হাজিরাম পাড়ায় গেলে দাদা দিলেন পাহাড়ি পেয়ারা, কলা। দিদি ব্যস্ত জুমঘরে। সবাই ব্যাগ নিয়ে বিদায় নিলাম। আরও ঘণ্টা দুয়েক হেঁটে নৌকা। তৈনখাল বয়ে নিয়ে যাবে আমতলী ঘাট। তবে মাঝে দুছরিবাজার নেমে দুপুরের খাবারের বিরতি।

একটা বয়সে সুযোগ থাকলেও শরীর চলবে না, একসময় খরচের হাত থাকবে বাধা। তাই সময় থাকতেই সাধন হোক। শুধু পাহাড় কিংবা ঝর্ণা নয়, ঘুরতে থাকুন যেখানে চোখ আটকে যায়। এই ঐশ্বর্যময় বিপুলা পৃথিবী আপনারও।

Comments