৩০ বছর পর যেভাবে নিজেদের খুঁজে পেলেন

চার বন্ধু লিপি, টুটু, সীমা ও সানী। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

তারা চারজনই ছিলেন রাজধানীর তেজগাঁও কলেজের শিক্ষার্থী। শেষবারের মতো আড্ডায় বসেছিলেন ১৯৯১ সালে এক বন্ধুর বিয়েতে। এরপর থেকে ধীরে ধীরে দুরত্ব বাড়ে, এক পর্যায়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।

সেই চার বন্ধুর একজন লিপিকা ইকবাল লিপি। সম্প্রতি বন্ধুদের খোঁজে এক ফেসবুক গ্রুপে নিজেদের একটি ছবি পোস্ট করেন তিনি। "বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবি সমগ্র" গ্রুপের ১১ লাখ সদস্য অবাক হয়ে দেখলেন ৩০ বছর পর চার বন্ধুর সাক্ষাতের গল্প।

সোমবার বাংলাদেশ সময় রাত ৩টায় দ্য ডেইলি স্টারকে সেই গল্প শোনালেন লিপিকা ইকবাল।

কলেজ জীবনের স্মৃতিচারণ করে লিপি বলেন, 'আমাদের অনেক বন্ধুবান্ধব ছিল ঠিকই, কিন্তু আমাদের চারজনের বন্ধুত্বটা ছিল অন্যরকম। বোটানিক্যাল গার্ডেনে পিকনিকে গিয়ে ছবি তোলা থেকে শুরু করে, একসঙ্গে আড্ডা দেওয়া, খাওয়া-দাওয়া, ঘুরে বেড়ানো। ক্লাসেও আমরা চারজন একসঙ্গে বসতাম।'

তিনি বলেন, '১৯৯২ সালে আমার বিয়ে হয়। বিয়ের পর উত্তরার দিকে চলে আসি। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন ভালো না থাকায়, ঢাকায় কম আসা হতো। বান্ধবীদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়াও হতো না। মাস্টার্স পরীক্ষার সময়ই শেষ চোখের দেখা।'

পড়াশোনা, সংসার, যৌথ পরিবারের দায়িত্ব, সন্তানদের দেখভাল নিয়ে একসময় ব্যস্ত হয়ে যান লিপি। বান্ধবীদের সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখা হয়ে ওঠেনি। এরই মধ্যে ২০০৯ সালে পরিবারসহ পাড়ি জমালেন আমেরিকা।

'৩০ বছর ধরেই আমার তিন বান্ধবীকে খুঁজছি। একসময়ের হাসি আড্ডার সঙ্গী সেই প্রাণের বান্ধবীদের খোঁজ জানতে "বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবিসমগ্র" নামে পাবলিক ফেসবুক গ্রুপে পোস্ট দিয়েছিলাম,' লিপি বলেন।

ওই ফেসবুক পোস্টে লিপি লেখেন, 'গত ৩০ বছর ধরেই খুঁজে চলেছি আমার এই তিন বান্ধবীকে। ছবির সবচেয়ে বামে বসে আছি আমি (লিপি)। আমার পাশে টুটু, তার পরে সীমা, আর সবার শেষে সানী। আমরা ১৯৯০ সালে তেজগাঁও কলেজে বিএ পাস কোর্সে ভর্তি হই। ওরা সবাই মগবাজারে থাকতো। আমি থাকতাম শেওড়াপাড়া। যতদুর জানি-বিয়ের পর সানী এলিফ্যান্ট রোডে ওর শ্বশুর বাড়িতে থাকত। আর কোনো সূত্র আমার হাতে নেই। দেশ থেকে বহুদূরে নিউইয়র্কে থাকি। ইচ্ছে হলেও সন্ধান নেওয়ার উপায় নেই ভেবে ভেবে যখন বিষন্ন ভগ্নহৃদয় হয়ে গিয়েছিলাম, আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম- তখনই এই পেজের কথা মনে হলো। আমার বন্ধবীদের কেউ, তাদের পরিচিতদের কেউ আছেন এখানে? আমাকে দিতে পারেন এদের কারো একজনের সন্ধান?'

পোস্ট দেওয়ার ১০ মিনিটের মধ্যেই টেক্সট পান লিপি। টুটু তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। ৩০ মিনিটের মধ্যে বান্ধবীর সঙ্গে কথাও হয় তার।

'যাকে আমি ৩০ বছর ধরে খুঁজছি। তার সঙ্গে ১০ মিনিটের মধ্যে যোগাযোগ হয়েছে। আমি তো অবাক!,' লিপি বলেন।

টুটুর সঙ্গে কথা বলার কয়েক ঘণ্টা পর আরেকটি টেক্সট পান লিপি। তাতে লেখা ছিল, 'আন্টি, আমার আম্মু আপনার সাথে কথা বলার জন্য বসে আছে।'

'আমার আরেক বান্ধবী সানীর মেয়ে আমাকে মেসেজটি পাঠায়। তখন আমেরিকাতে দুপুর, বাংলাদেশে প্রায় মাঝরাত। সে সারারাত ঘুমায়নি আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য,' লিপি বলেন।

সেই সময়কার কথা স্মরণ করে লিপি বলেন, 'কলেজে থাকতে সানী সবসময় সিরিয়াস ভাব নিয়ে থাকত। আর আমাদেরকে হাসাতো। ও নিজে হাসতো না। কিন্তু এমন এমন কথা বলতো, আমরা না হেসে পারতাম না। স্যারদের কাছেও বকা খেতাম আমরা।'

'সানীর সাথে কথা বলার সময় প্রথমে আমি ভিডিও অন করিনি। নিজেকে শক্ত করেছি, হার্ট বিট বেড়ে গেছিল। কারণ আমি কী দেখবো, কেমন দেখবো, এত বছর পর। গলার ভয়েসটা শুনে মনে হলো আসলে ৩০ বছর যায়নি। আমরা একই আছি, তেমন পরিবর্তন হয়নি।'

'ও শুধু আমাকে বলল, "বনলতা সেন?" কারণ ক্লাসে আমায় সবাই "বনলতা সেন" বলে ডাকতো,' লিপি বলেন।

সানী, টুটুকে পেলেও আরেক বান্ধবী সীমার সঙ্গে তখনো যোগাযোগ হয়নি।

'হঠাৎ একজন জানায় সীমা নামের একজন প্রায় ১০ বছর আগে ক্যানসারে মারা গেছেন। কিন্তু সানী আমাকে বলে, সীমার সঙ্গে বছর পাঁচেক আগে একবার দেখা হয়েছিল তার। যেহেতু পাঁচ বছর আগে সানী আর সীমার দেখা হয়েছে সেহেতু ১০ বছর আগে হয়ত সীমা নামে অন্য কেউ মারা গিয়েছেন,' লিপি বলেন।

এক পর্যায়ে সীমার সঙ্গেও যোগাযোগ হয় লিপির।

'আমি একটা মেসেজ পাই। "আন্টি, আম্মু আপনার সাথে কথা বলবেন," সীমার ছেলে আমাকে মেসেজটি দিয়েছিল।'

'আমাদের বান্ধবী সীমা খুব হাসতো, ওর কাজই ছিল হাসা। তখন সকাল হয়ে গেছে আমেরিকায়। সকালবেলায় ওর হাসি দিয়েই আমার দিন শুরু হলো,' লিপি বলেন।

একে একে চারজনের সঙ্গে কথা হলেও একসঙ্গে সবার কথা বলা হয়ে ওঠেনি তখনো। ঠিক করলেন, চার বান্ধবী মিলে একসঙ্গে ভিডিওকলে দেখা করবেন।

অবশেষে ৩০ বছর পর দেখা হলো চার বান্ধবীর।

'একসঙ্গে সবার দেখা হলেও এখনও টাচ করতে পারি নাই কাউকে। জানুয়ারিতে আমি দেশে আসবো। তখন দেখা হবে আমাদের,' হাস্যজ্বল কণ্ঠে লিপি বলেন।

'আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই "বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবি সমগ্র" গ্রুপকে এবং গ্রপের অন্যতম সদস্য গিরিধরকে। আমার বোনের ছেলে তাইফুর রহমানকেও ধন্যবাদ জানাতে চাই কারণ ওর মাধ্যমেই আমি গিরিধরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি। আমি কৃতজ্ঞ সব মানুষের প্রতি যারা আমার ওই পোস্টে কমেন্ট করেছেন, শেয়ার করেছেন, শুভকামনা জানিয়েছেন,' লিপি বলেন।

Comments

The Daily Star  | English

No justifiable reason to delay nat'l polls beyond Dec: Salahuddin

We have been able to make it clear that there is not even a single mentionable reason to hold the election after December, says the BNP leader

3h ago