ঢাকার নাচের জগতে নতুন নাম সালসা

সালসা

আপনি যদি ঢাকার নাচের সংস্কৃতির কথা ভাবেন, তাহলে সাধারণত সেই তালিকায় সালসা থাকবে না। আপনি ভাববেন কত্থকের মতো ধ্রুপদী ধরন অথবা সমসাময়িক নাচের কথা। কিংবা ভাবতে পারেন ইউটিউব রিলসে দেখা কে-পপ নাচের কথাও। কিন্তু এই শহরের বুকেই খুব নীরবে বেড়ে উঠছে নতুন এক নাচের ধরন। এক পা এগিয়ে, এক পা ঘুরিয়ে, ল্যাটিন সংগীতের তালে তালে তৈরি হচ্ছে সালসা নাচ।

রাতারাতি পরিবর্তন আসেনি

হাভানা সালসার প্রতিষ্ঠাতা আকস বড় হয়েছেন দেশের বাইরে। যেখানে সালসা ক্লাবে যাওয়া এবং সামাজিক নানা অনুষ্ঠানে সালসায় অংশগ্রহণ করা রীতিমতো জীবনযাপনের অংশ ছিল।

সালসা

এরপর যখন দেশে ফিরলেন তখন তিনি এক ধরনের শূন্যতা দেখতে পেলেন।

তিনি বলেন, `সালসার জন্য কোনো উপযুক্ত জায়গা ছিল না। আপনি শিখতে পারবেন না, অনুশীলনও করতে পারবেন না।'

আর তখনই সিদ্ধান্ত নিলেন, বাংলাদেশে সালসা নাচ শুরু করলে কেমন প্রতিক্রিয়া পান, সেটা পরীক্ষা করে দেখবেন।

২০১৯ সালে ঢাকায় প্রথমবারের মতো হাভানা সালসা আয়োজন করে সোশ্যাল ড্যান্স নাইট। খুব অল্প সংখ্যক মানুষ এসেছিলেন। কেউ কেউ এসেছিলেন স্রেফ কৌতূহলবশত, কেউ এসেছিলেন একঘেয়েমি কাটাতে। তবে যারাই এসেছিলেন, তারা শেষ পর্যন্ত ছিলেন।

এখন হাভানা সালসা বেশ পরিণত হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি তার পথচলার বিষয়েও বেশ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। প্রতি সপ্তাহান্তে নাচের আয়োজন থাকে, নতুনদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তবে তারা মূলত যেটা করে সেটা হলো, মানুষকে এমন একটি উপায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যেখানে তার শারীরিক কসরত যেমন হবে, তেমনি সামাজিক বন্ধনও শক্ত হবে।

সালসা কেন

সালসা কেবল একটি নাচের ধরন নয়। এটি এক ধরনের কথোপকোথন, যেখানে আসলে কথা বলার বা ভাষার প্রয়োজন হয় না। আপনি কত দ্রুত ঘুরে ঘুরে নাচতে পারেন সেটি এখানে বিবেচ্য নয়। এখানে বিবেচ্য হলো, নাচের সঙ্গীর সঙ্গে আপনি কত ভালোভাবে সংযোগ স্থাপন করতে পারছেন সেটি।

সালসা

আকস বলেন, 'আপনি ভিন্নভাবে শুনতে শেখেন, আর সেটি কান দিয়ে নয় বরং শরীর দিয়ে।'

হাভানা সালসার লক্ষ্য কখনোই নিখুঁত কৌশল বা দক্ষতা প্রদর্শন নয়। তাদের লক্ষ্য অংশগ্রহণ।

হাভানা সালসার প্রশিক্ষক নুজহাত সোম বলেন, `সালসার মধ্যে একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে। মানুষ খুব কঠোরভাবে, সতর্কতার সঙ্গে এখানে শিখতে আসেন। ক্লাস শেষে দেখা যায় তারা নিজেদের নিয়েই হাসাহাসি করছেন এবং অপরিচিতদের কাজের প্রশংসা করছেন।'

যারা এখানে যোগ দেন তাদের বড় অংশই নৃত্যশিল্পী নন। তাদের বয়স ২০ বছর বা এর আশপাশে। সম্পূর্ণ নতুন একটি কলা শিখতে তারা পা বাড়িয়ে দেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো নানা কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগছেন, আবার কেউ কেউ চান গৎবাঁধা জীবন থেকে কিছু সময়ের জন্য মুক্তি। শুরুতে পরীক্ষামূলকভাবে যোগ দিলেও এক পর্যায়ে দেখা যায় এটি তাদের সাপ্তাহিক রীতিতে পরিণত হয়েছে।

দ্বিধা ভেঙে এগিয়ে চলা

শুরুতে নুজহাত সোমের এমন পরিকল্পনা ছিল না যে তিনি অন্যদের শেখাবেন। গ্রুপের অন্য প্রশিক্ষকদের মতো তিনিও এসেছিলেন শিখতে।

নুজহাত বলেন, 'আমি নিজেই নিশ্চিত ছিলাম যে এটা শিখতে পারব কি না। নাচের ভঙ্গি-মুদ্রা সবই আমার কাছে অন্য রকম লাগছিল।`

কিন্তু যখন বিষয়টা বুঝে গেলাম, সব ভালো লাগল। তার মতে, সালসা নাচটি এমন যেখানে আপনার প্রতিটি পদক্ষেপ সঠিক হতে হবে, তেমন কোনো কথা নেই। বরং এটা হলো অংশগ্রহণের বিষয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না গানের তালটির সঙ্গে আপনি শতভাগ পরিচিত হয়ে উঠছেন।'

আমাদের সংস্কৃতিতে সালসার মতো সোস্যাল ড্যান্স বা সামাজিক নাচের বিষয়টি খুব স্বাভাবিক নয়। সেখানে সালসা শেখানো বেশ কঠিনই বলতে হবে। নুজহাত সোম বলেন, `বেশিরভাগ মানুষ তাৎক্ষণিক ফলাফল আশা করেন। তারা মনে করেন যে, একটি মাত্র ক্লাসেই সবকিছু শিখে যাবেন। আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে, এটা ধীরে ধীরে মন দিয়ে শেখার বিষয়।'

যে রাতে ঢাকা নেচে উঠেছিল

গত ২৬ জুন হাভানা সালসা আয়োজন করেছিল স্প্যাগেটি জ্যাজের সঙ্গে একটি অনুষ্ঠান। গুলশান ২ নম্বর এলাকায় আয়োজিত এই অনুষ্ঠান ছিল থিমপার্টির চেয়ে বেশি কিছু, ছিল সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সন্ধ্যা। আয়োজনটি শুরু হয়েছিল একটি কর্মশালার মধ্য দিয়ে, যেখানে সবাই অংশ নিতে পেরেছেন। কোনো অভিজ্ঞতার প্রয়োজন ছিল না। এরপর ছিল লাইভ পারফরম্যান্স, সোশ্যাল ড্যান্সিং এবং ফ্ল্যামেনকো অনুপ্রাণিত একটি অনুষ্ঠান। অতিথিদের স্টাইলিশ পোশাক পরে আসতে অনুরোধ করা হয়েছিল। সব মিলিয়ে পুরো আয়োজনটিই ছিল দারুণ উৎসবমুখর।

সালসা নাইটে স্প্যাগেটি জাজের কিউরেটর জাফরিন খান বলেন,`আমি জ্যাজ নাইট ও বলিউড সন্ধ্যার দায়িত্বে ছিলাম। পুরো আয়োজনটি দারুণ ছিল। এটা কেবল পরিবেশনার ব্যাপার নয়। এটা ছিল অংশগ্রহণের ব্যাপার। সবাই খুব স্বতস্ফূর্ততার সঙ্গে অংশ নিয়েছিলেন।'

বৈশ্বিক সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ থেকেই হাভানা সালসার সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রপাত জাফরিন খানের।

তিনি বলেন, `মেক্সিকো সীমান্তে বেড়াতে গিয়ে এই চিন্তাটি আমার মাথায় আসে। তখনই ভাবি, ঢাকায় কি আমরা এই দুটোর সম্মিলন ঘটাতে পারি না? আমরা মেক্সিকান প্রপস, খাবার এবং সাজসজ্জা যুক্ত করেছিলাম। প্রথমবারের মতো আমরা এই আয়োজন করেছি। অংশগ্রহণকারীরাও ফেরার পথে বলছিলেন যে, এমন আয়োজন তারা আগে কখনও দেখেননি। এজন্যই তারা বারবার ফিরে আসেন।'

নাচের চেয়েও বেশি কিছু

সোশ্যাল ড্যান্স বা সামাজিক নাচকে এককালীন অনুষ্ঠান হিসেবে সহজেই খারিজ করে দেওয়া যায়। কিন্তু হাভানা সালসা যে আবেশ তৈরি করে, তা দীর্ঘস্থায়ী। এটা এক ধরনের সম্প্রীতির অনুভূতি। শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়। তারা নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হন। তারা শেখেন যে কীভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে হয়। প্রশিক্ষকরা কেউ তাৎক্ষণিক ফলাফলের প্রতিশ্রুতি দেন না। তারা বলেন, শেখার সময় ভুল হতে পারে। তাতে দোষের কিছু নেই। ধীরে ধীরে পুরো প্রক্রিয়াটির উপভোগ করতে হবে এবং শিখতে হবে।

বাংলাদেশে সালসা এখনও মূলধারায় যুক্ত হয়নি, হয়তো কখনো হবেও না। কিন্তু এটি সত্যি যে, সালসার যাত্রা শুরু হয়েছে। এটাও সত্যি যে, নাচের সংজ্ঞা নতুন করে লিখতে শেখাচ্ছে সালসা। আর সেটি পরিবেশনা হিসেবে নয়, বরং অংশগ্রহণকে গুরুত্ব দিয়ে।

জাফরিন খান যেমন বলছিলেন, 'আপনি সালসা কেবল দেখেন না। আপনি এর প্রতিটি ধাপকে অনুভব করেন।'

ছবি: সৌজন্যে পাওয়া

অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ

 

Comments

The Daily Star  | English

Sinner dethrones Alcaraz to capture maiden Wimbledon crown

Jannik Sinner downed Carlos Alcaraz 4-6, 6-4, 6-4, 6-4 on Sunday to win his first Wimbledon title, gaining sweet revenge for his painful defeat in the French Open final.

4h ago