গরমে ছাদ ঠান্ডা রাখার যত উপায়

অতিরিক্ত গরমে ছাদ ঠান্ডা রাখার উপায়
ছবি: ইউএনবি

গ্রীষ্মকালসহ অন্যান্য উষ্ণ ঋতুগুলোতে বহুতল আবাসিক এলাকায় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকেন একদম ওপরের তলার বাসিন্দারা। রোদের প্রখর তাপ সরাসরি ঘরের ছাদে পড়ায় তাপ জমে ঘরের ভেতরের তাপমাত্রা অস্বস্তিকরভাবে বেড়ে যায়।

চলুন তীব্র গরম আবহাওয়াতে ঘরের ছাদ ঠান্ডা রাখার উপায়গুলো জেনে নেওয়া যাক।

ছায়াদানকারী উঁচু দেয়াল বা নেট স্থাপন

খুব ঘন উপাদান সম্পন্ন কংক্রিটে তৈরি হওয়ায় ছাদের স্ল্যাবগুলো খুব দীর্ঘ সময়ের জন্য তাপ ধরে রাখে। এই তাপ পরিবাহিত হয় নিচের ফ্ল্যাটগুলোর প্রতিটি কক্ষে। তাই স্ল্যাব পর্যন্ত যেন সূর্যালোক পৌঁছাতে না পারে, তার জন্য উৎকৃষ্ট উপায় হচ্ছে ছাদে ছায়ার ব্যবস্থা করা। এর ফলে নিদেনপক্ষে ছায়াযুক্ত জায়গাগুলো আশপাশের স্ল্যাবগুলো থেকে অনেক কম গরম থাকে।

এই ছায়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে ছাদের সীমানার ধার ঘেষে উঁচু দেয়াল বা নেটের মাধ্যমে। এই নেট বা দেয়াল বিভিন্ন নকশা দিয়ে আকর্ষণীয় করা যায়। সুতরাং ছায়াদানকারী এই স্থাপনা শুধু তাপ নিয়ন্ত্রণই করে না, সেইসঙ্গে দালানের সৌন্দর্যও বাড়ায়। তবে এখানে দেয়াল বা নেটে হালকা রং দেওয়া হচ্ছে কি না সেদিকে দৃষ্টি রাখা উচিত।

 

ছাদে বাগান করা

বিভিন্ন ধরনের ফুল-ফল ও শাক-সবজির গাছ দিয়ে সাজানো বাগানে তৈরি হয় সবুজ ছাদ। এই সবুজ ছাদ নিচের ফ্ল্যাটকে সরাসরি সূর্যের আলো থেকে ছায়া দেয়। উদ্ভিদগুলো নিজেদের খাবার প্রক্রিয়ার কাজে সূর্যের আলো শুষে নেওয়ার কারণে ছাদের পৃষ্ঠসহ আশেপাশের বায়ুর তাপমাত্রা উভয়ই হ্রাস পায়।

এতে করে ছাদের আর্দ্রতা অপসারিত হয়ে ছাদ ও নিজের ঘরের পরিবেশ সহনীয় অবস্থায় থাকে। ঘরের ছাদ ঠান্ডা রাখা ছাদবাগান সবুজ ছাদ শুধু পরিবেশগতভাবেই স্বস্তিদায়ক নয়, এটি দালানের সৌন্দর্যায়নেও অপরিসীম ভূমিকা রাখে। এভাবে মহল্লার সবগুলো ছাদ সবুজায়ন করা হলে পুরো এলাকায় কাঙ্ক্ষিত শীতল পরিবেশ বিরাজ করে। এ ছাড়া বাগানহীন ছাদের তুলনায় সবুজ ছাদগুলো ১০ থেকে ১৫ বছর বেশি স্থায়ী হয়।

ছাদে হালকা রঙের প্রলেপ

নানা ধরনের রঙের ভিত্তিতে এর ওপর সূর্যের রশ্মির প্রভাব পরিবর্তিত হয়। এক রঙের হাল্কা রঙগুলো সূর্যালোককে প্রতিফলিত করে। সবচেয়ে বেশি অতিবেগুনি রশ্মি প্রতিফলিত করতে পারে সাদা রং। এই রঙের প্রলেপ ছাদের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা গাঢ় রঙের ছাদের তুলনায় ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমাতে পারে। এতে করে ছাদের দেয়ালের মধ্য দিয়ে কম তাপ ঘরে প্রবেশ করবে।

শীতল ছাদ বাতাসের গুণমান উন্নত করে ছাদের স্থায়ীত্ব বাড়াতে পারে। সাদা রং করা ছাদ তাপ প্রতিফলন বৈশিষ্ট্যের কারণে কালো রং করা ছাদের চেয়ে দ্বিগুণ স্থায়ী হয়।

তাপপ্রতিরোধী মেঝে স্থাপন

এটি বেশ খরচ ও সময় সাপেক্ষ কাজ। কারণ এর সঙ্গে ফ্লোরের পুনর্নির্মাণের বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হয়। টাইলস, কংক্রিট এবং পাথরের মতো তাপ-প্রতিরোধী বস্তুগুলো ছাদের মেঝেতে ব্যবহার করা যেতে পারে। গাঢ় রঙের মেঝে সূর্যের আলো শোষণ করে নিচের ফ্লোরে তাপ পরিবাহিত করে কক্ষগুলোকে উত্তপ্ত করে দেয়। অন্যদিকে হালকা রঙের তাপ অপরিবাহী মেঝে সূর্যের রশ্মি প্রতিফলিত করে তাপকে দূরে রাখে।

এই কার্যক্রমটি দীর্ঘমেয়াদে বেশ ফলপ্রসূ হয়। কারণ সঠিক উপাদান ব্যবহার করা হলে তা দীর্ঘদিন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে না।

ছাদে নিয়মমাফিক পানি ছিটানো

যে কোনো জায়গা শীতলীকরণের জন্য খুব সাধারণ উপায় হচ্ছে পানি ছিটানো। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে মিস্টিং সিস্টেমের মাধ্যমে এই কাজটি করা হয়ে থাকে। এই সিস্টেমের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে ছাদের আর্দ্রতা এবং তাপমাত্রা নিরীক্ষণকারী সেন্সর।

সেই সঙ্গে টাইমারের সংযোগ থাকায় দিনের উত্তপ্ত সময়গুলোতে তা সক্রিয় হয়ে গিয়ে পুরো ছাদে পানি ছিটিয়ে দেয়। ফলে ছাদের তাপমাত্রা খুব গরম হয়ে গেলে মিস্টিং ছাদকে পুনরায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসে। এটি ছাদের মেঝে প্রতিস্থাপন করে নতুন তাপ-প্রতিরোধী মেঝ বসানোর সেরা বিকল্প।

বাংলাদেশে এই প্রযুক্তি নেই, তবে এই ব্যবস্থা যে করা যাবে না তা নয়। ম্যানুয়ালি কাজটি করার জন্য সার্বক্ষণিক একজন কর্মচারীকে রাখা যেতে পারে। তিনি দিনের উষ্ণ সময়গুলোতে হোস পাইপের সাহায্যে সারা ছাদে পানি ছিটিয়ে দিবেন।

সোলার প্যানেল বসানো

বিশ্বব্যাপী গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনে বিজ্ঞানের অনন্য অবদান সোলার প্যানেল। এই প্যানেল সূর্যের শক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরিত করে। ছাদে স্থাপন করা গ্রিড থেকে এই বিদ্যুৎ বাসাবাড়ির বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে ব্যবহৃত হয়। সোলার প্যানেল ব্যবহার করা হলে বিদ্যুৎ খরচ অনেকাংশে কমে আসে।

সোলার প্যানেল

বিশেষ করে উষ্ণ মৌসুমগুলোতে উত্তাপ যত সময় ধরে থাকবে, এর গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে তত বেশি। এমনকি অল্প তাপেই দীর্ঘক্ষণ যাবত বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিগুলো চালানো যায়। ফলে মাস শেষে বিদ্যুৎ বিলও অনেক কম আসে।

তাছাড়া এই পাওয়ার ডিভাইসগুলো ছাদের জন্য বেশ উপযোগী ছায়া তৈরি করে। এতে করে বাড়ির ভেতরেও তাপ কম পরিমাণে প্রবেশ করে।

বায়ু চলাচলের যথেষ্ট জায়গাসহ চিলেকোঠা বানানো

অনেকেই ছাদে বা ছাদ সংলগ্ন সিঁড়ি ঘরে চিলেকোঠা ব্যবহার করে থাকেন। অধিকাংশ ক্ষেতেই জঞ্জালে পরিপূর্ণ থাকলেও এই চিলেকোঠাই হতে পারে ছাদ ঠান্ডা রাখার মাধ্যম। সাধারণত ছাদ বেশি গরম থাকলে এর সঙ্গে চিলেকোঠাও গরম থাকে। তাই এই কক্ষটিতে যথেষ্ট পরিমাণে বায়ু চলাচলের জন্য ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

এই পাওয়ার ভেন্টগুলো তাপ নিরোধক হিসেবে কাজ করে। এই নিরোধকগুলো চিলেকোঠার দেয়াল ও সিলিংয়ে স্থাপন করলে নির্বিঘ্নে বাতাস আসা-যাওয়ার রাস্তা তৈরি হবে। এর পাশাপাশি জানালাগুলোও খোলা রাখলে শীতল প্রক্রিয়াটি আরও বেগবান হবে।

পাওয়ার ভেন্ট স্থাপন করা পর্যন্তই কাজ শেষ নয়। এখানে বাতাস ঠিকমতো চলাচল করছে কি না তা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। অনেক সময় ভেন্টগুলোতে ময়লা জমে চলাচলের পথ বন্ধ হয়ে যায়। তাই এগুলো রুটিন করে ভালো মতো পরিষ্কার করে নিতে হবে।

ছাদে ভেজা খড় ছড়িয়ে রাখা

এক তলা বাড়ির ছাদে এরকম খড়ের চালা বেশির ভাগ দেখা যায় গ্রাম দেশে। খড় সূর্যের তাপ শোষণ করে ফেলে বিধায় ঘরের ভেতরে স্বস্তিদায়ক ঠান্ডা বিরাজ করে। ব্যাপারটি অদ্ভুত হলেও মফস্বল ও শহরগুলোতে এই কৌশলটি প্রয়োগ করা যায়।

খড়ের চালা ছাদে বেশ কিছু জায়গা নিয়ে একটি প্লাস্টিকের শিটে পাশাপাশি বিছিয়ে রাখা যায়। ছাদকে আর্দ্র ও ঠাণ্ডা রাখতে খড়গুলো পানিতে ভিজিয়ে নেওয়া যেতে পারে। শহরে বিষয়টি বেশ অসঙ্গতিপূর্ণ হলেও পরিবেশের স্বার্থে ব্যবস্থাটি নেওয়া যায়। এর ফলে অনেক সময় ধরে ছাদ ঠান্ডা থাকবে।

ছাদ পরিষ্কার রাখা

যাবতীয় কৌশলই পণ্ডশ্রম হবে যদি সেগুলোর মধ্যে যত্ন না থাকে। সবুজ ছাদের প্রতিটি উদ্ভিদের জন্য সময়মতো পরিচর্যা প্রয়োজন। সীমানা ঘেষে উঁচু দেয়াল বা নেট, সোলার প্যানেল এবং শিঙ্গলগুলো নোংরা থাকলে সকল চেষ্টা বৃথা হবে। তাই সেগুলো নিয়মিত পরিষ্কার রাখা আবশ্যক।

প্রায় সময় দেখা যায় চিলেকোঠায় বা ছাদের এক পাশে অনেক জঞ্জাল স্তুপ করে রাখা। বিশৃঙ্খল জিনিস যত বেশি থাকবে, সেখানে উত্তাপ বাড়ার ঝুঁকিও ততটাই বেশি। এমনকি হোস পাইপ দিয়ে পানি ছিটানোর আগে সারা ছাদ ঝাড়ু দিয়ে নেওয়াটা ভালো।

প্রতিফলক শিঙ্গলস বা টালি বসানো

উন্নত দেশগুলোর মতো এখন বাংলাদেশেও ত্রিভুজাকৃতির টালি ঘর দেখা যায়। অনেকে ছাদে লিফট ঘর বা ভয়েডের শীর্ষে ত্রিভুজাকার আবরণ দিয়ে ঢেকে দেন। সোলার প্যানেলগুলো প্রায় ক্ষেত্রে ছাদে আড়াআড়ি করে বসানো থাকে। সৌর প্রতিফলক শিঙ্গলগুলো সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির বিকিরণকে প্রতিফলিত করতে পারে। ফলে তাপ প্রশমিত হয়ে ঘরে প্রবেশ করে বিধায় ঘরের ভেতরটা উত্তপ্ত হয় না। ঘরে ঠান্ডা পরিবেশ বিরাজ করায় হাই ভোল্টেজ বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির ওপর চাপ কম পড়ে।

এই শিঙ্গলগুলোর বিকল্প হিসেবে কংক্রিট টাইলসও বসানো যায়। এগুলো তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বাড়ির নান্দনিকতাকেও উন্নত করে।

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

7h ago