শিল্পকলায় জামদানি উৎসব: দেখে আসুন তাঁতিদের শাড়ি বোনা, জামদানির সম্ভার

প্রাকৃতিক রঙের মিশেলে জামদানি তৈরির উপকরণ হিসেবে মাটির পাত্রে সাজিয়ে রাখা হয়েছে হরীতকী, খয়ের, ডালিমের খোসাসহ বিভিন্ন পণ্য। ছবি: আসরিফা সুলতানা রিয়া

শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালায় চলছে ১১ দিনব্যাপী 'অনন্য বয়নে জামদানি উৎসব'। যেখানে দেখার সুযোগ মিলছে নানা ধরনের জামদানি শাড়ি, জামদানি দিয়ে তৈরি বাহারি পণ্য এবং চরকা, মাকু, টানায় তাঁতিদের সরাসরি শাড়ি বোনাসহ অনেক কিছু। এসব উপভোগ করতে প্রতিদিনই ভিড় করছেন দর্শনার্থীরা।

২৯ জুলাই পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল সাড়ে ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চলবে প্রদর্শনী।

সেবা নারী ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র (সেবা) আয়োজিত প্রদর্শনীটির কিউরেট করেছেন বাংলাদেশ কারুশিল্প পরিষদের সভাপতি চন্দ্রশেখর সাহা। সাসটেইনেবল এন্টারপ্রাইজ প্রজেক্টের অধীন এ উৎসবে অর্থায়ন করেছে পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন। সহযোগিতা করেছে জাতীয় কারুশিল্প পরিষদ।

প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত আদি জামদানি নকশায় বোনা ২৫টি উন্নতমানের শাড়ি ৩ মাস নিরলস পরিশ্রম করে তৈরি করেছেন ২ জন তাঁতি। যেখানে তারা ফুটিয়ে তুলেছেন বট পাতা, আঙুর লতা, বাঘের পাড়, গোলাপ ছড়সহ নানা রকমের নকশা। ২০০-৩৫০ কাউন্টের সুতায় তৈরি হয়েছে শাড়িগুলো। সব মিলিয়ে ৪০০ জামদানি শাড়ির সম্ভারে সজ্জিত হয়েছে এ উৎসব।

এ ছাড়া প্রদর্শনী থেকে মিহি সুতোর বুননে জামদানি দিয়ে তৈরি পাঞ্জাবি, ব্যাগ, কটি, বাতি, জুতা, ফটোফ্রেম, ওড়না, কটি দেখার পাশাপাশি কেনার সুযোগও রয়েছে। শাড়ির দাম পড়বে ৫ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা, পাঞ্জাবি ৬ হাজার টাকা, টু পিস ৫ হাজার টাকা, ওড়না ২ হাজার টাকা, বাতি সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা এবং জুতা পাওয়া যাবে ১ হাজার টাকার মধ্যে।

ছবি: আসরিফা সুলতানা রিয়া

সেবা নারী ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে কর্মরত এবং জামদানি উৎসব আয়োজনে দায়িত্বপ্রাপ্ত মনিরুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেশের জামদানি শিল্পের ঐতিহ্য ধরে রাখা এবং তাঁতিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, তাঁতঘরগুলোকে পরিবেশবান্ধব করে তোলা ইত্যাদি নানাবিধ কাজের মাধ্যমে দীর্ঘদিন যাবত কাজ করে আসছে সেবা নারী ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র। পিকেএসএফের সহযোগী সংস্থা হিসেবে বিশ্বব্যাংকের সাসটেইনেবল এন্টারপ্রাইজ প্রকল্পের (এসইপি) আওতায় কাজ করছি আমরা। এ কার্যক্রমে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ১০০ জন দক্ষ তাঁতি জড়িত।'

তিনি আরও বলেন, 'জামদানি বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে রং-বেরঙের নকশায় তৈরি নানা ধরনের শাড়ি। তবে জামদানি দিয়ে শুধু শাড়ি নয়, তৈরি করা যায় পাঞ্জাবি, সালোয়ার কামিজ, ওড়না, বাতি, জুতা, টাইসহ নানা পণ্য। তরুণ উদ্যোক্তাদের এই ধারণা বাস্তবায়নের চিত্র দেখা যাবে এই জামদানি উৎসবে। মূলত এই আয়োজনের মাধ্যমে ক্রেতাদের আকর্ষণ করা ছাড়াও নতুন তাঁতি তৈরি করা, জামদানি পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ করার পথ আরও সুগম হবে বলে আশা করা যায়।' 

তবে প্রদর্শনীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো কুঁড়েঘরের আদলে গড়া বসে মাকু, চরকি, টানা, পোড়েনসহ নানা অনুষঙ্গ দিয়ে ২ তাঁতির শাড়ি বোনার দৃশ্য। প্রাকৃতিক রঙের মিশেলে জামদানি তৈরির উপকরণ হিসেবে মাটির পাত্রে সাজিয়ে রাখা হয়েছে হরীতকী, খয়ের, ডালিমের খোসাসহ বিভিন্ন পণ্য।

ছবি : আসরিফা সুলতানা রিয়া

তাঁতি আনোয়ার হোসেন বলেন, 'প্রায় ৪০ বছর ধরে জামদানি শাড়ি বুনছি। বাবার কাছ থেকেই শাড়ি বোনার হাতেখড়ি। প্রতিটি জামিদানি শাড়ির নকশা দেখে নির্ধারণ হয় মজুরি। অনেক সময় মহাজনের সঙ্গে দরকষাকষি চলে। মাসব্যাপী অক্লান্ত পরিশ্রম করে মাসে যে আয় হয় তাই দিয়ে সংসার চলে। জামদানি উৎসবে আসা দর্শনার্থীদের ভিড় দেখে মনে হয়েছে দেশীয় শিল্পের কদর এখনো ম্লান হয়ে যায়নি। তবে নতুন শিল্পীরা খুব একটা আগ্রহী হয় না বিধায় শঙ্কা থেকেই যায়।'

গতকাল রোববার (২৩ জুলাই) জামদানি উৎসব উপলক্ষে রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালায় অনুষ্ঠিত ‌হয় 'বর্তমানের সচেতন প্রয়াসই সুনিশ্চিত করবে জামদানির ভবিষ্যৎ' শীর্ষক সেমিনার। সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন মানবাধিকারকর্মী ও শিক্ষাবিদ হামিদা হোসেন। এ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন সেবা নারী ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সাইদা রোকসানা খান, জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের সভাপতি শিল্পী চন্দ্রশেখর দে ও সাধারণ সম্পাদক শেখ সাইফুর রহমান এবং কেন্দ্রের কর্মকর্তা আফরোজা বিনতে ইলিয়াস।

আলোচনা সভার মূল প্রবন্ধ পড়ে শোনান সাংবাদিক ও জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শেখ সাইফুর রহমান। মোগল আমলে ভারতবর্ষে জামদানি শিল্পের আগমনের ইতিহাস থেকে বর্তমান সময়ের তথ্য তুলে ধরেন তিনি।

সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'সময়, বৈশিষ্ট্য, বয়নসংস্কৃতি, ধারাবাহিকতা, স্থান মাহাত্ম্য মিলিয়ে জামদানি শুধু তাঁতে বোনা কাপড় নয়। জামদানি বাংলাদেশের মর্যাদার প্রতীক।'

ছবি : আসরিফা সুলতানা রিয়া

৪০০ বছর ধরে নানা প্রতিকূলতার পরও টিকে আছে জামদানি শিল্প। কিন্তু ভুল নকশা, ভিন্ন সুতা বা মেশিনে তৈরি কাপড় নষ্ট করছে জামদানির আদি ঐতিহ্য। এ জন্য শুদ্ধতা রক্ষা, বুননশিল্পীর মর্যাদা, ন্যায্য পারিশ্রমিক ও সংরক্ষণের উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন বক্তারা।

শেখ সাইফুর রহমান আরও বলেন, 'জামদানির শুদ্ধতা বজায় রাখার পূর্বশর্ত হলো এর উপকরণ, নকশা ও বয়নপদ্ধতির যথাযথ ব্যবহার। যার সব কটিই অনেকভাবে নষ্ট হচ্ছে। খাঁটি জামদানির প্রতিপক্ষ হিসেবে মেশিনে তৈরি বিদেশি জামদানি বা হ্যান্ডলুম জামদানিকে দাঁড় করানো হচ্ছে, যা আদি জামদানির ঐতিহ্য নষ্ট করছে।

শুধু জামদানি নয়, সব রকম তাঁতির কাজেই পরিবর্তন এসেছে নানা পর্বে। জামদানি নকশার বর্ণনা বুননের সময় দেওয়া হয় মুখে মুখে। কোথাও লেখা থাকে না। ফলে এ শিল্পের নকশায় নতুন অনেক কিছু সংযুক্ত করে দেওয়া সহজ, যা আদি জামদানির ঐতিহ্য নষ্ট করে। তাই জামদানির ঐতিহ্য রক্ষা করতে হলে এ শিল্প খাত থেকে সস্তা শ্রম বাদ দিতে হবে।'

হামিদা হোসেন বলেন, 'স্বীকৃতি আসতে হবে শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সব নারীর কাজের।'  

বেঙ্গল ফাউন্ডশেনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী বলেন, 'কারুশিল্প বা বুননশিল্প ২টিই বুননকারীর সহজাত জ্ঞান থেকে আসে, যা তৈরি হয় প্রজন্মের পর প্রজন্মের হাত ধরে। সেখানে নানা রকম বাণিজ্যিক প্রলোভনে শুদ্ধতা নষ্ট হতে পারে, এ জন্য প্রয়োজন তথ্য-চিত্র সংরক্ষণ করা।'

একইসঙ্গে জামদানি ও টেক্সটাইল নিয়ে পৃথক জাদুঘর হতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

একটি প্রদর্শনী কীভাবে জামদানিশিল্পকে আবার সামনে নিয়ে আসতে পারে তার উদাহরণ পাওয়া যায় জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের প্রেসিডেন্ট এবং প্রদর্শনীর কিউরেটর চন্দ্র শেখর সাহার বক্তব্যে।

এ ছাড়া জামদানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মসলিন এবং বর্তমান বাণিজ্যব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করেন সেবার নির্বাহী পরিচালক সাইদা রোকসানা খান এবং তাঁত বোর্ডের মসলিন প্রকল্প পরিচালক মো. আইয়ুব আলী।

প্রদর্শনীতে ঘুরতে আসা সুরাইয়া নাজনিন বলেন, 'আগে বহু জায়গায় জামদানির পসরা দেখার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু সরাসরি চরকা, মাকু, টানায় তাঁতিদের শাড়ি বুনতে দেখার অভিজ্ঞতা একেবারেই নতুন। জামদানি দিয়ে যে কত সুন্দর বাতি, ব্যাগ, জুতা তৈরি করা যায় তা নিজ চোখে না দেখে বোঝা যাবে না। দেশীয় শিল্পের চমৎকার প্রদর্শনী এই জামদানি উৎসব মনে গেঁথে থাকবে।'

 

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

7h ago