মহাকাশ অভিযানে নতুন দিগন্ত: বেসরকারি উদ্যোগে ২ নভোচারীর ‘স্পেসওয়াক’
মহাকাশ পাড়ি দিতে চেয়েছিলেন পপ তারকা মাইকেল জ্যাকসন। জীবদ্দশায় সে স্বপ্ন হয়নি তার। এমন কী, কোনো মহাশূন্যযানেও উঠতে পারেননি তিনি। তবে তার রেখে যাওয়া স্বপ্ন এখন অন্যরা পূরণ করছেন।
মানব ইতিহাসের বড় সময়জুড়ে নাসা বা রসকসমসের মতো সরকারি সংস্থাগুলোই মহাকাশে নভোচারী ও মহাকাশযান পাঠিয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ধনকুবের ইলন মাস্কের স্পেস এক্সের মতো কিছু বেসরকারি উদ্যোগ বেসামরিক মানুষদের মহাকাশ যাত্রার স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে এসেছে।
যেভাবে স্পেসওয়াক করলেন
এই ধারায় গতকাল বৃহস্পতিবার বেসরকারি উদ্যোগে প্রথমবারের মতো দুই নভোচারী একটি স্পেস এক্স ক্যাপসুলের বাইরে বের হয়ে 'স্পেসওয়াক' করে আসেন। 'স্কাইওয়াকার' নামে আখ্যায়িত হ্যাচ খুলে পোলারিস ক্যাপসুল থেকে বের হয়ে আসেন তারা।
তাদের একজন ধনকুবের ও অপরজন প্রকৌশলী। 'মহাকাশ-হন্টনের' মাধ্যমে তারা তাদের নাম মানব ইতিহাসে চিরস্মরণীয় করে রাখলেন।
এতদিন পর্যন্ত জাতীয় পর্যায়ের মহাকাশ প্রকল্পেই সীমাবদ্ধ ছিল স্পেসওয়াক।
এই প্রথম, বেসরকারি উদ্যোগে সূক্ষ্ম ও কারিগরি দিক দিয়ে উন্নত স্পেসস্যুট পরে এই ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানে অংশ নেন দুই নভোচারী।
অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছে 'পোলারিস ডন (পোলারিসের সূর্যোদয়)'। দুই নভোচারী এক সঙ্গে বের হননি। একজনের পর অপরজন বের হয়েছেন। তারা দুইজনই গামড্রপ নামক চকলেটের (গামি বিয়ার নামেও পরিচিত) মতো দেখতে ক্রু ড্রাগন ক্যাপসুল থেকে বের হয়ে এসে মহাকাশে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বিহীন অবস্থায় খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে ইতিহাস সৃষ্টি করেন।
সঙ্গে জড়িয়ে যায় আলোচিত-বিতর্কিত-সমালোচিত ইলন মাস্কের নামও। বাণিজ্যিক মহাকাশ অভিযানকে বাস্তবতা দিয়েছেন এই স্বপ্নদ্রষ্টা প্রযুক্তি বিশারদ ও উদ্যোক্তা।
নভোচারীদের বৃত্তান্ত
জ্যারেড আইজ্যাকম্যান (৪১) একজন প্রশিক্ষিত পাইলট। একইসঙ্গে, তিনি শিফটফোর নামে একটি ইলেকট্রনিক পেমেন্ট প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী।
তিনিই প্রথম ক্যাপসুল থেকে বের হয়ে আসেন। এরপর বের হন স্পেস এক্সের প্রকৌশলী ও মার্কিন নাগরিক সারা গিলিস (৩০)।
স্পেস ক্যাপসুলের ভেতর থেকে তাদের এই কার্যক্রম তদারকি করেন সারাহর সহকর্মী স্কট পোটিট ও আন্না মেনন (৩৮)।
সারাহ গিলিস স্পেস এক্সের নভোচারীদের প্রশিক্ষণের দায়িত্বে আছেন। জ্যারেডকেও তিনিই প্রশিক্ষণ দেন।
তার স্বামীও ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। পোলারিস ডন অভিযানে ব্যবহৃত মহাকাশযানের প্রপালশান সিস্টেমটি তিনি তৈরি করেছেন।
আন্না মেনন স্পেস এক্সে যোগ দেওয়ার আগে নাসায় কাজ করেছেন। স্পেস এক্সে তিনি লিড স্পেস অপারেশন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত।
তিনি শিশুদের জন্য 'কিসেস ফ্রম স্পেস' নামে একটি বই লিখেছেন। এই বইয়ের একটি অংশ তিনি অভিযান চলাকালে পড়ে শোনাবেন। বই থেকে অর্জিত আয় তিনি শিশুদের হাসপাতালে বিলিয়ে দেন।
পোলারিস ডনের অপর নভোচারী স্কট পোটিট (৫০) মার্কিন বিমানবাহিনীর অভিজ্ঞ পাইলট। তিনি অবসর সময়ে ট্রায়াথলনে অংশ নেন। ২০ বছর যুদ্ধবিমান চালানোর অভিজ্ঞতা থাকায় তাকেই এই ফ্লাইটের মূল পাইলট হিসেবে নিযুক্ত করেন মাস্ক।
জ্যারেড আইজাকম্যানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তিনি।
অভিযানের বিস্তারিত
ভূপৃষ্ঠ থেকে ৭৩০ কিলোমিটার উচ্চতায় (৪৫০ মাইল) এই অভিযানের স্থায়িত্ব ছিল প্রায় ৪৬ মিনিট।
মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্য থেকে মহাকাশযানে চেপে রওনা হন এই চার নভোচারী। তারপর থেকেই পৃথিবীর কক্ষপথে রয়েছেন তারা।
পোলারিস অভিযানের অর্থায়ন করছেন জ্যারেড। ২০২১ সালে স্পেস এক্সের ইনস্পিরেশনফোর ফ্লাইটেরও অর্থায়ন তিনিই করেছিলেন।
এই অভিযানে প্রথমবারের মতো যুগান্তকারী কিছু মহাকাশ প্রযুক্তি পরীক্ষা করার সুযোগ পেয়েছেন ইলন মাস্ক, যার মধ্যে আছে অপেক্ষাকৃত কম ওজনের 'স্লিম' স্পেস স্যুট।
এছাড়া, ক্রুদের ব্যবহৃত ড্রাগন কেবিনকে পুরোপুরি চাপমুক্ত রাখার নতুন প্রযুক্তিটিও সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করেছেন মাস্ক। তিনি আশা করছেন, ভবিষ্যতে মঙ্গল গ্রহে বাণিজ্যিক ফ্লাইটের উচ্চাভিলাষী প্রকল্পে এই প্রযুক্তি কাজে আসবে।
'পৃথিবীতে ফেরার পর আমাদের জন্য অনেক কাজ অপেক্ষা করবে। কিন্তু আপাতত, এখান থেকে আমরা একটি "নিখুঁত পৃথিবী" দেখতে পাচ্ছি', স্পেসওয়াক শেষে বলেন জ্যারেড।
ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান
এটা ছিল স্পেস এক্সের সবচেয়ে বিপজ্জনক অভিযানের মধ্যে একটি। এখন পর্যন্ত বেসরকারি মহাকাশ সংস্থার মধ্যে একমাত্র তারাই নিয়মিত পৃথিবীর কক্ষপথে নিরাপদে মানুষদের আনা-নেওয়া করতে সফল হয়েছে।
গতকাল বাংলাদেশ সময় বিকাল চারটা বেজে ৫২ মিনিটে স্পেসওয়াক শুরু করেন নভোচারীরা। এর আগে, ক্যাপসুলটিকে পুরোপুরি ডিপ্রেশারাইজ (চাপমুক্ত) করা হয়। সে সময় অক্সিজেনের জন্য শুধু স্পেস এক্সের নির্মাণ করা স্পেস স্যুটের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হন চার নভোচারী। ক্রু ড্রাগনের সঙ্গে তার ও পাইপ সংযোগের মাধ্যমে নভোচারীদের স্পেস স্যুটে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়।
জ্যারেড ও সারাহ স্কাইওয়াকার হ্যাচ খুলে মহাকাশে বের হয়ে আসেন। শুরুতে তারা স্যুটের বেশ কয়েক ধরনের নড়াচড়ার ভঙ্গিমা পরীক্ষা করেন। এ সময় তারা গ্রাউন্ড কন্ট্রোলকে তাদের অভিজ্ঞতার কথা জানায়, যাতে ভবিষ্যতের অভিযানে তা কাজে লাগানো যায়। তারা খুব সহজে হাত, কনুই ও পিঠ নাড়াতে পারছিলেন। তবে কোমর, দেহের পেছনের অংশ ও গলা নাড়াতে সমস্যায় ভোগেন তারা।
এই অভিযানে স্পেসস্যুটের ডিজাইন ও ক্যাপসুলের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল কক্ষপথে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উপযোগিতার সর্বোচ্চ সীমা পরীক্ষা করে দেখা।
নতুন যুগের সূচনা
নাসার প্রশাসক বিল নেলসন বৃহস্পতিবারের অভিযানের সাফল্যে অভিনন্দন জানান।
'আজকের এই সাফল্য বাণিজ্যিক মহাকাশ শিল্প ও একটি গতিশীল মার্কিন মহাকাশ অর্থনীতি তৈরিতে নাসার দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে একটি বড় মাইলফলক', বলেন নেলসন।
এখন পর্যন্ত শুধু বহু বছরের প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পেশাদার সরকারি নভোচারীরা স্পেসওয়াক মিশনে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। ২০০০ সালে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন (আইএসএস) চালু হবার পর প্রায় ২৭০টি স্পেসওয়াকের নজির রয়েছে। পাশাপাশি চীনের টিয়াংগং স্পেস স্টেশন থেকেও ১৬ বার চীনা নভোচারীরা মহাকাশ হন্টনে অংশ নেন।
পোলারিসের ক্রুরা আড়াই বছর স্পেস এক্সে প্রশিক্ষণ নেন বলে জানান পোটিট।
এ মুহূর্তে পৃথিবীর কক্ষপথে ১৯ জন নভোচারী অবস্থান করছেন, যা একটি নতুন রেকর্ড।
সর্বশেষ বুধবার রাশিয়ার সোইউজ এমএস-২৬ মিশন দুই কসমোনট ও একজন মার্কিন নভোচারীকে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে নিয়ে যায়। সেখানে মোট নভোচারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১২তে। ইতোমধ্যে টিয়াংগংয়ে তিন নভোচারী অবস্থান করছে।
লাইভ স্ট্রিমিং
স্পেস এক্সের ওয়েবসাইটে এই অভিযানের লাইভ স্ট্রিমিং দেখানো হয়।
এখনো এই লিংকে ক্লিক করে এটি দেখা যাবে।
এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত ওয়েবসাইট থেকে ৭০ লাখ মানুষ এই স্ট্রিমিং দেখেছেন। এক্সে পোস্ট করা ভিডিওটি পেয়েছে এক লাখেরও বেশি ভিউ।
— SpaceX (@SpaceX) September 12, 2024
Comments