ইসরায়েলের অভিযোগ ও ৯ দেশের তহবিল বন্ধ নিয়ে যা বলছে জাতিসংঘ

দক্ষিণ গাজায় ইউএনআরডব্লিউএ'র কার্যালয়
দক্ষিণ গাজায় ইউএনআরডব্লিউএ'র কার্যালয়। ছবি: সংগৃহীত

ফিলিস্তিনে জাতিসংঘের ত্রাণ ও শরণার্থী সংস্থার (ইউএনআরডব্লিউএ) কয়েকজন কর্মীর বিরুদ্ধে গত বছর ৭ অক্টোবর হামাসের অতর্কিত হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ তুলেছে ইসরায়েল।

গত শুক্রবার জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত (আইসিজে) গাজায় হত্যা ও ধ্বংস বন্ধের জন্য ইসরায়েলকে সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন। সেদিনই জাতিসংঘের সংস্থার কর্মীদের বিরুদ্ধে হামাসের সঙ্গে হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ তোলে ইসরায়েল।

এ অভিযোগ আমলে নিয়ে ইতোমধ্যেই কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছে ইউনাইটেড নেশনস রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্কস এজেন্সি (ইউএনআরডব্লিউএ)। তবে ওই কর্মীদের নাম এখনো প্রকাশ্যে আনা হয়নি।

এদিকে ইসরায়েল অভিযোগ তোলার পর জাতিসংঘের সংস্থাটিকে নতুন করে তহবিল দেওয়া সাময়িকভাবে বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে নয় দেশ—যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি, স্কটল্যান্ড, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া, ফিনল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস ও সুইজারল্যান্ড।

ইউএনআরডব্লিউএ'র বিরুদ্ধে অভিযোগ, ইসরায়েলের সঙ্গে জাতিসংঘের সম্পর্ক ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত থাকছে এই লেখায়।

ইউএনআরডব্লিউএ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস ও তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ

১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য ইউনাইটেড নেশনস রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্কস এজেন্সি (ইউএনআরডব্লিউএ) প্রতিষ্ঠিত হয়।

সংস্থাটি ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু বলতে এমন ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে, যাদের ১ জুন ১৯৪৬ সাল থেকে ১৫ মে ১৯৪৮ সালের মধ্যে ফিলিস্তিনে বাসস্থান ছিল কিন্তু ১৯৪৮ সালে যুদ্ধের পর তারা বাসস্থান ও জীবিকা হারিয়েছে। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী, প্রায় ৫ দশমিক ৯ মিলিয়ন মানুষকে উদ্বাস্তু ধরা হয়।

ছবি: সংগৃহীত

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে (যেখানে সব রাষ্ট্রের ভোটপ্রদানের সক্ষমতা রয়েছে) নিয়মিতভাবে সংস্থাটির ম্যান্ডেট পুনর্নবীকরণ করা হয়। ইউএনআরডব্লিউএ চার প্রজন্মের ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের সহায়তা দিয়ে আসছে। তাদের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, সংস্থাটি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, ক্যাম্পের অবকাঠামো, সামাজিক পরিষেবা এবং জরুরি সহায়তা দিয়ে থাকে।

ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে গাজায় কমপক্ষে ১৫২ ইউএনআরডব্লিউএ কর্মী নিহত হয়েছে বলে সংস্থাটি জানায়।

গত শুক্রবার এই সংস্থার কর্মীদের বিরুদ্ধে ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের অতর্কিত হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ তোলে ইসরায়েল। এক ইসরায়েলি কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান, ইসরায়েল ১২ জন কর্মী সম্পর্কে ইউএনআরডব্লিউএ এবং যুক্তরাষ্ট্রকে তথ্য দিয়েছে, যারা ৭ অক্টোবরের হামলায় জড়িত ছিল।

গতকাল শনিবার ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানায়, সংস্থাটির কর্মীরা জাতিসংঘের সুযোগ সুবিধাগুলো 'সন্ত্রাসবাদী উদ্দেশ্যে' ব্যবহার করেছে।

আইডিএফ এর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গোয়েন্দা বিভাগ এসব ঘটনা যাচাই করেছে। তারা ইউএনআরডব্লিউএ কর্মীদের "গণহত্যায়" জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রমের উদ্দেশ্যে ইউএনআরডব্লিউএ সুযোগ-সুবিধা ব্যবহারের প্রমাণ পেয়েছে।

তবে এ বিষয়ে তারা বিস্তারিত কিছু জানাননি। এক প্রশ্নের উত্তরে আইডিএফ কর্মকর্তা বলেন, 'এই পর্যায়ে আমাদের কাছে এর বেশি তথ্য নেই। ইন্টারনাল ওভারসাইট সার্ভিসেস অফিস (জাতিসংঘের অভ্যন্তরীণ তদারকি সংস্থা) এই অভিযোগ খতিয়ে দেখবে, যেমনটা ইউএনআরডব্লিউএ'র কমিশনার জেনারেল তাদের অনুরোধ করেছেন।'

জাতিসংঘ কী বলছে

অভিযোগ ওঠার পর ইউএনআরডব্লিউএ কমিশনার-জেনারেল ফিলিপ লাজারিনি এক বিবৃতিতে জানান, তিনি কয়েকজন কর্মচারীর বিরুদ্ধে হামলায় জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছেন। তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল হয়েছে ও এসব ঘটনা খতিয়ে দেখতে তদন্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।  

জেনারেল ফিলিপ লাজারিনি
ইউএনআরডব্লিউএ কমিশনার-জেনারেল ফিলিপ লাজারিনি। ছবি: এএফপি ফাইল ফটো

ইউএনআরডব্লিউএ কর্মীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দিয়ে জবাবদিহি করা হবে বলে জানান তিনি। এ ঘটনায় বিভিন্ন দেশের অর্থায়ন বন্ধের ঘোষণাকে তিনি 'অদায়িত্বশীল' আচরণ বলে উল্লেখ করেছেন।

বর্তমানে গাজায় জাতিসংঘের প্রায় ১৩ হাজার কর্মী রয়েছে।

আজ রোববার এক বিবৃতিতে মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, যে ১২ কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তাদের মধ্যে নয় জনকে বরখাস্ত করা হয়েছে, একজন মারা গেছেন এবং অন্য দুজনের পরিচয় এখনও যাচাই করা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, 'সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত জাতিসংঘের যে কোনো কর্মীকে অপরাধমূলক বিচারিক প্রক্রিয়ায় জবাবদিহি করা হবে। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে একটি স্বাধীন পর্যালোচনা করা হচ্ছে।'

সব দেশের প্রতি ইউএনআরডব্লিউএ-তে আর্থিক সহায়তা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, 'জঘন্য কাজের জন্য এই কর্মীদের পরিণতি ভোগ করতে হবে। কিন্তু হাজার হাজার নারী ও পুরুষ যারা ইউএনআরডব্লিউএ-র জন্য কাজ করে, তার মধ্যে অনেক কর্মী বিপজ্জনক পরিস্থিতিতেও রয়েছেন, এই শাস্তি তাদের প্রাপ্য নয়।'

ইসরায়েল ও জাতিসংঘের বর্তমান সম্পর্ক

গত কয়েকমাসে জাতিসংঘের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গাজায় ইসরায়েলের সংঘাতপূর্ণ আচরণের কঠোর সমালোচনা করেছেন। হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের মতে, ওই অঞ্চলের ২৬ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েল।

বারবার জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির বিষয়েও আলোচনা উঠেছে।

গত শুক্রবার জাতিসংঘের শীর্ষ আদালত ইসরায়েলকে গাজায় হত্যা ও ধ্বংস বন্ধের জন্য ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। হামাসের সঙ্গে যুদ্ধে ইসরায়েলের সামরিক পদক্ষেপকে 'গণহত্যা' বলে উল্লেখ করে দক্ষিণ আফ্রিকার করা একটি মামলার অংশ হিসেবে অন্তবর্তীকালীন এ নির্দেশ দেওয়া হয়।

তবে আদালত গাজায় যুদ্ধবিরতির বিষয়ে কোনো আদেশ দেননি। যদিও দক্ষিণ আফ্রিকা এ ব্যাপারে অনুরোধ করেছিল।

এ আদেশের পর, সেইদিনই জাতিসংঘের সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে ইসরায়েল।

তবে এর আগে থেকেই, দীর্ঘদিন ধরে ইউএনআরডব্লিউএ'র বিরুদ্ধে একই ধরনের সমালোচনা করছে ইসরায়েল। জাতিসংঘের এই সংস্থাটি ইসরায়েল-বিরোধী উসকানি দেয় বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। ২০১৭ সালে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সংস্থাটি ভেঙে দেওয়ার কথাও বলেছিলেন। সেসময় তিনি বলেন, 'ইউএনআরডব্লিউএ'কে জাতিসংঘের প্রধান শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) সাথে একীভূত করা উচিত।'

তবে এসব অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করেছে ইউএনআরডব্লিউএ।

বিশ্ব কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে

ইউএনআরডব্লিউএ'তে সবচেয়ে বেশি অর্থায়ন দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েল সংস্থাটির বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার পর এর নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (স্টেট ডিপার্টমেন্ট)। সংস্থাটিকে অস্থায়ীভাবে অতিরিক্ত তহবিল দেওয়া স্থগিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর পরপরই যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি, স্কটল্যান্ড, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া, ফিনল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস ও সুইজারল্যান্ড একই ঘোষণা দেয়।

এর আগে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও এই সংস্থায় অর্থায়ন পুরোপুরি বন্ধ করেছিল।

এদিকে এখনো পর্যন্ত ইউএনআরডব্লিউএ-র তহবিল বন্ধের কোনো পরিকল্পনা নেই বলে জানিয়েছে ইউরোপের দুই দেশ— আয়ারল্যান্ড ও নরওয়ে।

এ বিষয়ে আইরিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইকেল মার্টিন জানান, জাতিসংঘের পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করার সিদ্ধান্তের প্রতি তার পূর্ণ আস্থা রয়েছে। অন্যদিকে নরওয়ে সরকার জানিয়েছে, তারা ইউএনআরডব্লিউএর জন্য আর্থিক সহায়তা বন্ধ করবে না তবে তারা জাতিসংঘের তদন্তের ফলাফলের অপেক্ষায় রয়েছে।

সংস্থায় তহবিল স্থগিত করার সিদ্ধান্তকে 'লজ্জাজনক' বলে উল্লেখ করেছেন ফিলিস্তিনি জাতীয় উদ্যোগের মহাসচিব মুস্তাফা বারগৌথি। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, আইসিজে'র রায়ের পরপরই এই ধরনের অভিযোগ তোলা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

অর্থায়ন বন্ধ করে দেওয়া দেশগুলোকে 'অবিলম্বে তাদের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার' আহ্বান জানিয়েছে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)।

অন্যদিকে, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট এই অর্থায়ন বন্ধের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। অন্যান্য দেশকেও তহবিল বন্ধের জন্য আহ্বান জানিয়েছে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ।

Comments

The Daily Star  | English

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

1h ago