ইরান-পাকিস্তানের পাল্টাপাল্টি হামলার সম্ভাব্য অভিঘাত

ইরান-পাকিস্তানের পাল্টাপাল্টি হামলার সম্ভাব্য অভিঘাত
পাকিস্তান সীমান্তে ইরানের হামলা। ছবি: রয়টার্স

আকাশসীমা লঙ্ঘন করে পাকিস্তানে ইরানের বিমান হামলা চালানো নিয়ে উত্তেজনার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই গতকাল বৃহস্পতিবার ইরানে 'প্রতিশোধমূলক' পাল্টা হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান।

ইরানের সিস্তান ও বেলুচিস্তান প্রদেশে 'সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আস্তানা' লক্ষ্য করে চালানো এ ক্ষেপনাস্ত্র হামলায় চার শিশুসহ অন্তত নয়জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

এর আগে মঙ্গলবার পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের পঞ্জগুর শহরে ইরানি হামলায় দুই শিশু নিহত হওয়ার পাশাপাশি আরও তিনজন আহত হওয়ার কথা জানায় ইসলামাবাদ।

গাজায় ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাসের মধ্যে যুদ্ধের সময়ে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার সময়ে ইরান ও পাকিস্তান পরস্পরের ভূ-খণ্ডে এই হামলা চালালো।

বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খানঅধ্যাপক আমেনা মহসিনের সঙ্গে। তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল—দুই দেশের পাল্টাপাল্টি এ হামলায় মধ্যপ্রাচ্যে চলমান আঞ্চলিক সংঘাত আরও বিস্তৃত হওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি হলো কি না? আর এই সংঘাত দীর্ঘমেয়াদে চলতে থাকলে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এর কেমন প্রভাব পড়তে পারে?

অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান মনে করেন, পাল্টাপাল্টি এ হামলায় নিশ্চিতভাবেই মধ্যপ্রাচ্যে চলমান আঞ্চলিক সংঘাত আরও বিস্তৃত হওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়ে গেছে। তিনি বলেন, 'বিশেষ করে হুতি, হিজবুল্লাহ ও হামাসের তৎপরতার মধ্যে এখন এই বেলুচিস্তান ঘিরে যে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে, তা শেষ পর্যন্ত একটা বড় ধরনের রিজিওনাল ওয়ারফেয়ারের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

'কারণ ওখানে যে অ্যালায়েন্স ও কাউন্টার অ্যালায়েন্সগুলো বিরাজ করছে, তাতে এক পক্ষের আরেক পক্ষের বিপক্ষে শক্তি প্রদর্শন করার বিষয়টি জরুরি। বিশেষ করে প্যালেস্টাইন ইস্যুটা যেখানে এর কেন্দ্রে আছে। সুতরাং এটা এখন কেবল ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ইস্যুতে আটকে নেই, এটা বড় ধরনের একটা সংঘাতের দিকে নিয়ে যেতে পারে।'

মঙ্গলবারের হামলার ব্যাপারে ইরান দাবি করেছিল, তারা পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কিত জঙ্গি গোষ্ঠী জইশ আল-আদলের দুটি ঘাঁটিকে লক্ষ্যস্থল করেছে।

কিন্তু পাকিস্তান তা প্রত্যাখ্যান করে এটিকে 'আকাশসীমা লঙ্ঘন' ও 'অবৈধ কাজ' বলে অভিহিত করে। সেইসঙ্গে এ ধরনের পদক্ষেপ 'গুরুতর পরিণতি ডেকে আনতে পারে' বলেও ইরানকে সতর্ক করে ইসলামাবাদ।

এর পরিপ্রেক্ষিতে তেহরানের বক্তব্য ছিল, বৃহত্তর কোনো সংঘাতে তারা জড়াতে চায় না।

কিন্তু তেহরানের কথিত 'অ্যাক্সিস অব রেসিসট্যান্স' গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত ইয়েমেনে হুতি, লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং সিরিয়া ও ইরাকের বিভিন্ন গ্রুপ ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে ইসরায়েল ও তার মিত্রদের ওপর হামলা চালিয়ে আসছে।

সুতরাং ইরান-পাকিস্তানের পাল্টাপাল্টি এই হামলাকে খুব সাদা চোখে দেখতে রাজি নান অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান। তার ভাষ্য, 'ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে ইসরায়েলের পক্ষ নিয়েছে, এর বিপরীতে চীন-রাশিয়া আবার তাদের বিপরীতে অবস্থান নিচ্ছে। তাতে এক ধরনের রিজিওনাল প্রক্সি ওয়ারও কিন্তু হতে পারে। এদের প্যাট্রোনাইজেসনেই আঞ্চলিক সংঘাতটা আরও বিস্তৃত হতে পারে।'

এ ছাড়া ইরান-পাকিস্তানের এই সংঘাত দীর্ঘমেয়াদে গড়ালে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও তার একটা প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। বলেন, 'এর অর্থনৈতিক প্রভাবটা অনেক বেশি পড়বে। বিশেষ করে আমাদের প্রবাসী কর্মী যারা আছেন, তাদের কাজের ক্ষেত্রটা বিঘ্নিত হবে। নতুন করে মানুষ যাওয়ার প্রক্রিয়াটাও বিঘ্নিত হবে। এরসঙ্গে আমাদের জ্বালানি সংকট তো এখন এমনিতেই আছে, জ্বালানি তেলের দাম আবারও বাড়তে পারে—সবকিছু মিলিয়ে একটা নতুন জটিলতা তৈরি হতে পারে।'

এর পাশাপাশি বাংলাদেশের উগ্রপন্থী ইসলামিক দলগুলো এ ঘটনায় উৎসাহিত হতে পারে বলেও মন্তব্য করেন অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান। বলেন, 'আমাদের যে ইসলামিক উগ্রপন্থী গ্রুপগুলো আছে তারাও এগুলো থেকে উৎসাহিত হতে পারে। এতে নতুন করে কোনো দুর্ঘটনার সম্মুখীন হতে পারি। দক্ষিণ এশিয়াজুড়েই এই প্রবণতাটা দেখা দিতে পারে। যদি সংঘাতটা দীর্ঘমেয়াদে চলতে থাকে। কারণ এই গোষ্ঠীগুলো কারও না কারও দ্বারা প্যাট্রোনাইজড। যার ফলে তাদের জন্যও একটা ক্ষেত্র তৈরি হবে সংঘাতে জড়ানোর।'

ইরান-পাকিস্তান উভয়েই একে অপরের বিরুদ্ধে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ এনেছে বিভিন্ন সময়; যারা বছরের পর বছর ধরে তাদের সীমান্ত এলাকায় হামলা চালিয়ে আসছে।

এই দুই দেশের সীমান্ত এলাকার বিস্তৃতি প্রায় ৯০০ কিলোমিটার। তাই এর দুই পাড়ের নিরাপত্তার বিষয়টি দুই দেশের জন্যই দীর্ঘকাল ধরে উদ্বেগের বিষয় হয়ে আছে।

ফলে চলমান এ উত্তেজনা দীর্ঘ সংঘাতের দিকে মোড় নেবে কি না, এমন আশঙ্কাও করা হচ্ছে।

বিষয়টি নিয়ে অধ্যাপক আমেনা মহসিনের অভিমত, 'এটা অবশ্যই পুরো অঞ্চলের অস্থিরতাটা আরও বাড়িয়ে দেবে। কারণ ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে যে এক ধরনের টানাপোড়েন আছে, সেটা আমরা জানি।

'মধ্যপ্রাচ্যে হুতিদের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের একটা রিজার্ভেশন আছে। বিপরীতে হুতিদের প্রতি ইরানের একটা সমর্থন আছে। তাতে ইরান-পাকিস্তানের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনায় নতুন একটা কনফিগারেশন, ডাইনামিক্সের ব্যালেন্স তৈরি হতে পারে।'

এ ছাড়া এই মুহূর্তে বিশ্বজুড়ে যে সংঘাতগুলো চলছে, তা পুরো পৃথিবীতেই একটি অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করছে মন্তব্য করে আমেনা মহসিন আরও বলেন, 'এর একটা প্রভাব বাংলাদেশেও আছে। মধ্যপ্রাচ্যে যে সংঘাত চলছে, সেটাও আমাদের ওপর এক ধরনের প্রভাব ফেলছে। এখানে সেটা একটা পলিটিক্যাল ইস্যু হিসেবেও দাঁড়াচ্ছে। এটা ভালো কোনো লক্ষণ না। বিশ্বরাজনীতির জন্যও ভালো কোনো সংকেত না।'

 

Comments