অপারেশন ব্লু স্টার ও স্বর্ণমন্দিরের সেই শিখ নেতা ভিন্দ্রানওয়ালে

পাঞ্জাবের অমৃতসরে স্বর্ণমন্দিরে অনুসারীদের সঙ্গে ভিন্দ্রানওয়ালে। ছবি: সংগৃহীত

'খালিস্তান' শব্দের অর্থ বিশুদ্ধ ভূমি। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় পাঞ্জাব প্রদেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। তবে সেখানকার শিখ ধর্মাবলম্বীদের দাবি ছিল নিজেদের স্বাধীন ভূখণ্ড।

পাঞ্জাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও ভারতে সামগ্রিকভাবে শিখরা মাত্র দুই শতাংশ। তারা চেয়েছিলেন ভারতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া পাঞ্জাবের অংশটিতে স্বাধীন ও সার্বভৌম খালিস্তান রাষ্ট্র। এই দাবিতে গত শতকের সত্তর ও আশির দশকে পাঞ্জাবে সহিংস আন্দোলন হয়।

পাঞ্জাবে অনেকের দৃষ্টিতে এটি স্বাধীনতা আন্দোলন হলেও ভারত সরকারের কাছে এটি ছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতা। ভারতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে নানা সময়ে সংঘাতে জড়িয়েছেন খালিস্তানপন্থীরা। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছিল অমৃতসরে স্বর্ণমন্দির অভিযান যা 'অপারেশন ব্লু স্টার' নামে পরিচিত।

স্বর্ণমন্দিরে অবস্থান নিয়ে থাকা খালিস্তান আন্দোলনের নেতা জারনাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে ১৯৮৪ সালে সেনা অভিযান চালায় ভারত সরকার৷

১৯৮৪ সালের ৩১ মে ভারতীয় সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশন কমান্ডার মেজর জেনারেল কুলদীপ বুলবুল বরাড় সস্ত্রীক ম্যানিলা ভ্রমণে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু তাকে পরদিন সকালে চণ্ডীগড়ে একটি জরুরি বৈঠকে উপস্থিত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়।

বরাড় তাই করেন। সড়কপথে দিল্লি গিয়ে বিমানে পৌঁছান চণ্ডীগড়। পাঞ্জাবে স্বাধীনতা আন্দোলন তখন তুঙ্গে। শিখদের উপাসনালয় গুরুদুয়ারাগুলোতে স্বাধীন খালিস্তানের পক্ষে চলছিল জোর প্রচারণা। প্রয়োজনে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হয় শিখদেরকে।

এর প্রতিক্রিয়ায় ভারত সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় অমৃতসরে স্বর্ণমন্দিরে সামরিক অভিযান চালানো হবে। অভিযানের নাম দেওয়া হয় 'অপারেশন ব্লু স্টার।' এর দায়িত্ব দেওয়া হয় মেজর জেনারেল বরাড়কে।

পাঞ্জাবের পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তপ্ত হতে থাকে। ১৯৮৪ সাল নাগাদ তা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার উপক্রম হয়। ওই বছর ৪ জুন ভিন্দ্রানওয়ালের লোকেরা কে কোথায় আছে, তা জানার জন্য একজন অফিসারকে সাদা পোশাকে স্বর্ণমন্দিরের ভেতরে পাঠান মেজর জেনারেল বরাড়। পরদিন সকালে সেনাসদস্যদের অভিযান নিয়ে ব্রিফ করেন বরাড়। প্রত্যেক ব্যাটালিয়নকে আধাঘণ্টা ধরে ব্রিফ করেন তিনি। কারো স্বর্ণমন্দিরে যেতে আপত্তি থাকলে নির্দ্বিধায় তা জানাতে বলেন তিনি।

অপারেশন ব্লু স্টারের পর বিধ্বস্ত স্বর্ণমন্দিরের একাংশ। ছবি: সংগৃহীত

রাত ১০টায় শুরু হয় অভিযান।

সেনা কমান্ডোরা স্বর্ণমন্দিরের চত্বরে ঢুকতেই স্বয়ংক্রিয় রাইফেল থেকে তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়। মন্দিরের সরোবরের বিপরীত দিক থেকে প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ চলতে থাকে। কমান্ডোদের ধারণাও ছিল না এমন প্রতিরোধের মুখে পড়তে হবে।

প্রাক্তন সেনা জেনারেল শাহবেগ সিং প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন বিদ্রোহী ভিন্দ্রানওয়ালের বাহিনীকে। তারা সেনা সদস্যদের গুলি করে, রকেট লঞ্চার দিয়ে সাঁজোয়া যান উড়িয়ে দেন। নয় দিন ধরে চলা সংঘর্ষে শেষ পর্যন্ত অভিযানে হার মানতে হয় খালিস্তানপন্থীদের। নিহত হন ভিন্দ্রানওয়ালে। সরকারি হিসাবে নিহতের সংখ্যা চার শতাধিক বলা হলেও খালিস্তানপন্থীদের দাবি, নিহতের সংখ্যা কয়েক হাজার হবে।

অপারেশন ব্লু স্টারের প্রতিশোধ নিতে ওই বছরের ৩১ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে গুলি করে হত্যা করেন তারই শিখ দেহরক্ষীরা। এর প্রতিক্রিয়ায় ভারতে শিখবিরোধী দাঙ্গা শুরু হয়। সরকারের হিসাব অনুযায়ী দাঙ্গায় দিল্লিতে প্রায় ২,৮০০ শিখ এবং দেশব্যাপী ৩,৩৫০ জন শিখকে হত্যা করা হয়।

এই ঘটনার পরের বছর ১৯৮৫ সালে কানাডা থেকে ভারতের উদ্দেশে ছেড়ে আসা এয়ার ইন্ডিয়ার বোয়িং ৭৪৭ বিমানে বোমা হামলার জন্য শিখ বিদ্রোহীদের দায়ী করা হয়। আয়ারল্যান্ডের উপকূলে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে ৩২৯ যাত্রীর সবাই নিহত হন।

১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালেও পাঞ্জাবে খালিস্তানপন্থীদের নির্মূল করতে ভারত সরকার অভিযান চালায়। এরপর ধীরে ধীরে খালিস্তান আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। তবে ভারতে জনসমর্থন কমলেও কানাডায় অভিবাসী শিখদের ভেতর এখনো খালিস্তান আন্দোলনের প্রতি শক্ত জনসমর্থন আছে।

গত ১৯ জুন কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় একটি গুরুদুয়ারার বাইরে শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জারকে আততায়ীরা হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডে ভারত সরকারকে দায়ী করে হাউস অব কমন্সে বক্তব্য রাখেন জাস্টিন ট্রুডো। খালিস্তান আন্দোলনের নেতা নিজ্জার ও ভারতের 'মোস্ট ওয়ান্টেড' অপরাধীর তালিকায় ছিলেন। কয়েক বছর আগে পাঞ্জাবের জলন্ধরে থাকা তার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ভারত।

এ বছরের এপ্রিলে শিখ নেতা অমৃত পাল সিংকে 'বিচ্ছিন্নতাবাদী' আখ্যায়িত করে গ্রেপ্তার করে ভার‍ত। এর ফলে পাঞ্জাবে নতুন করে সহিংসতার আশঙ্কা তৈরি হয়। অমৃত খালিস্তানের দাবিকে পুনর্জীবন দিয়েছেন। জ্বালাময়ী বক্তৃতার মাধ্যমে তরুণদের দেখাচ্ছেন স্বাধীন খালিস্তানের স্বপ্ন। তিনি ভিন্দ্রানওয়ালের জীবন থেকে অণুপ্রাণিত বলেও গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন।

স্বর্ণমন্দির। ছবি: স্টার

উল্লেখ্য, কানাডায় জাস্টিন ট্রুডোর সরকার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির সমর্থন নিয়ে সরকার গড়েছেন ট্রুডো। নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা জগমিত সিং খালিস্তানপন্থীদের ঘনিষ্ঠ বলে ধরা হয়। অমৃত পালকে গ্রেপ্তারের পর শিখ বিক্ষোভকারীরা লন্ডনে ভারতীয় হাইকমিশন থেকে দেশের পতাকা টেনে নামিয়ে ফেলেন।

ভারতের বাইরে কানাডাতেই শিখদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। প্রায় ৭ লাখ ৭০ হাজার শিখ থাকেন দেশটিতে। কানাডার পার্লামেন্টে ৩৩৮ জন এমপির মধ্যে শিখ ১৮ জন। কানাডা সরকার শিখদের স্বাধীন খালিস্তানের দাবির ব্যাপারে কোনো পক্ষ না নিলেও তাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিপক্ষে নয়। হরদীপ সিং নিজ্জার ইস্যুতে তাই ভারত-কানাডা সম্পর্ক এখন তলানিতে।

এছাড়া, গত বছর পাকিস্তানে খালিস্তান কমান্ডো ফোর্সেসের প্রধান পরমজিত সিং পঞ্জয়ারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। প্রায় একই কায়দায় কানাডার নিজ্জরকে হত্যা করা হয়েছে, যা কানাডা নিজেদের সার্বভৌমত্বের ওপর হস্তক্ষেপ হিসেবেই দেখছে।

তবে ভারতের তরফ থেকে খালিস্তানিদের বিরুদ্ধে কানাডায় হিন্দু মন্দির ভাঙচুরের অভিযোগ তোলা হয়েছে। দেয়ালচিত্র এঁকে ভার‍তবিরোধী স্লোগান দিয়েছে শিখরা- এমনই অভিযোগ ভারতের। মার্চে অটোয়ায় ভারতীয় দূতাবাসে হামলার অভিযোগও করেছে নয়াদিল্লি। এ ব্যাপারে কানাডা সরকার যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে তাতে মোটেই সন্তুষ্ট নয় ভারত।

ট্রুডো ইতোমধ্যে ভার‍তকে জানিয়েছেন, খালিস্তানের পক্ষে কোনো সহায়তা দেবে না কানাডা। তবে অভিবাসী শিখদের মতপ্রকাশ এবং সমাবেশের অধিকারেও হস্তক্ষেপ করা হবে না।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শ্রুতি কপিলার মতে, 'এখন স্বাধীনতা আন্দোলন আর সংখ্যাগরিষ্ঠ শিখদের অবস্থান নয়। তবে বিদেশে অভিবাসী শিখদের একটি অংশ পৃথক রাষ্ট্রের দাবিতে তাদের প্রচারণা অব্যাহত রেখেছে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এটি কিছুটা জোরালো হয়েছে।'

Comments