কিমের উত্তরাধিকারী ‘রাজকন্যা’ জু আই?

কিম জু আই
বাবা কিম জং উনের সঙ্গে মেয়ে কিম জু আই। ছবি: কেসিএনএ

বহু বছর ধরেই উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র, পরমাণু অস্ত্র বা পশ্চিমের নিষেধাজ্ঞাই মূলত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়ে আসছে। এসবের বাইরে যে বিষয়টি বিশ্লেষকদের মনে প্রশ্ন জাগিয়েছে তা হলো—কে হতে যাচ্ছেন কিম জং উনের উত্তরাধিকারী?

গতকাল কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের শেষের দিকে 'পরমাণু'র বাইরে নতুন প্রসঙ্গ হিসেবে আলোচনা সৃষ্টি করেছে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের মেয়ে কিম জু আই।

ধারণা করা হচ্ছে, জু আইয়ের বয়স ১০ বছর।

সংবাদ প্রতিবেদনে জানা যায়, উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা কোরিয়া সেন্ট্রাল নিউজ এজেন্সি (কেসিএনএ) বেশ কয়েক মাস ধরে বাবা কিম জং উনের সঙ্গে মেয়ে জু আইয়ের ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করে যাচ্ছে।

কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করছেন, কিমের সম্ভাব্য উত্তরাধিকার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এমনটি করা হয়ে থাকতে পারে।

কিম জু আই
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের সামনে বাবার হাত ধরে কিম জু আই। ছবি: কেসিএনএ/রয়টার্স

আবার অনেকের মতে, এর মাধ্যমে কিম হয়তো নিজেকে 'ফ্যামিলি ম্যান' হিসেবে বহির্বিশ্বে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন, অথবা তিনি দেশটির অর্থনৈতিক দুরবস্থা বা ক্ষেপণাস্ত্র ও পরমাণু কর্মসূচিতে অত্যধিক খরচের বিষয়টি আড়ালের চেষ্টা করছেন।

জনসম্মুখে কিম জু আইয়ের ব্যাপক উপস্থিতির কারণ নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে তবে এই শিশুকে কিমের উত্তরাধিকারী হিসেবে মনে করেছেন কেউ কেউ।

উত্তর কোরিয়ার 'রাজকন্যা'

'উত্তর কোরিয়া বিফোর কিম ইল সুং' বইয়ে লেখক সিউলভিত্তিক ঐতিহাসিক ও প্রখ্যাত উত্তর কোরিয়া বিশেষজ্ঞ ফিওদর তেরতিতস্কি মনে করেন, জনসম্মুখে জু আইয়ের উপস্থিতি অন্য বার্তা দিতে পারে।

তার মতে, এ ঘটনা দেশবাসীর জন্য এক বার্তা ও বিদেশিদের জন্য ভিন্ন বার্তা বহন করছে।

এমন সময় জু আইকে জনসম্মুখে নিয়ে আসা হয়েছে বা যেসব স্থানে তাকে দেখা যাচ্ছে তা বেশ গুরুত্ব বহন করে। গত নভেম্বরে উত্তর কোরিয়ার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার সময় তাকে বাবার হাতে হাত রেখে চলতে দেখা গেছে।

কিম জু আই
পিয়ংইয়ংয়ে কোরিয়ান পিপলস আর্মির ৭৫ বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে বাবা কিম জং উন ও মা রি সল জুর সঙ্গে কিম জু আই (মাঝে)। ছবি: কেসিএনএ/রয়টার্স

তেরতিতস্কি আল জাজিরাকে বলেন, 'আসল বার্তা হচ্ছে এই শিশু ক্ষমতার প্রতীক। কারণ, তাকে একটি ক্ষেপণাস্ত্রের সামনে দেখা গেছে। আর সম্ভবত ক্ষেপণাস্ত্র হচ্ছে উত্তর কোরিয়ার সামরিক শক্তির সবচেয়ে বড় প্রতীক।'

'এছাড়াও, এর মাধ্যমে সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করা হতে পারে যে—দেখ, আমরা স্থিতিশীল আছি।… আমাদের এসব ক্ষেপণাস্ত্র আছে। আমাদের এই শাসন ব্যবস্থা অন্তত আরও এক প্রজন্ম পর্যন্ত টিকে থাকবে,' যোগ করেন তিনি।

তেরতিতস্কি মনে করেন, জু আই হচ্ছে উত্তর কোরিয়ার 'ক্রাউন প্রিন্সেস'। কিম জং উনের সম্ভাব্য 'উত্তরাধিকারী'।

তবে তিনি এও মনে করেন যে, যেহেতু আনুষ্ঠানিকভাবে জু আইকে 'উত্তরাধিকারী' হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি তাই নিশ্চিত করে কিছুই বলা যায় না। কেননা, পিয়ংইয়ং সব সময় সব বিষয়েই 'চরম' গোপনীয়তা রক্ষা করে চলে। এর আড়ালে কিম অন্যকিছু পরিকল্পনা করে থাকতে পারেন।

জু আইকে জনসম্মুখে এনে তাকে জনপ্রিয় করার চেষ্টাও হতে পারে বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়।

কিম জু আই
কিম জং উন ও কিম জু আই। ছবি: কেসিএনএ/রয়টার্স

দক্ষিণ কোরিয়ার দৃষ্টিতে উত্তরের 'রাজকন্যা'

দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা ন্যাশনাল ইনটেলিজেন্স সার্ভিস (এনআইএস) গত মার্চে এক প্রতিবেদনে জানায়, কিম জু আইকে বাড়িতে পড়ানো হয়। সে ঘোড়ায় চড়া, স্কি ও সাঁতার পছন্দ করে। এই সংস্থাটি মনে করে যে কিম এখনো জু আইকে তার উত্তরাধিকারী হিসেবে অভিষিক্ত করেননি।

দক্ষিণ কোরিয়ার গণমাধ্যমে বলা হয়, ৩৯ বছর বয়সী কিম জং উন এখনই তার উত্তরাধিকারীর নাম ঘোষণা দিতে চান না। কেননা, যদি কখনো প্রমাণিত হয় যে তিনি ভুল মানুষকে উত্তরাধিকারী করেছেন তাহলে তা তার জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে।

ধারণা করা হচ্ছে, জু আইয়ের বড় ভাই থাকতে পারে, ছোট একজন থাকারও সম্ভাবনা আছে। তবে তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে উত্তর কোরিয়া বিশেষজ্ঞ ফিওদর তেরতিতস্কি বলেন, 'যেহেতু এখনো কিমের বয়স অনেক কম, সেহেতু তিনি তার উত্তরাধিকারী নিয়ে চিন্তিত নন।'

কিম জু আই
কিম জং উন ও কিম জু আই। ছবি: কেসিএনএ/রয়টার্স

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে জু আই

গত মাসে বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম 'ভয়েস অব আমেরিকা'র এক প্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয়—'উত্তর কোরিয়ার নেতা হয়তো মেয়ের মগজ ধোলাই করছেন'।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বহু বছর ধরে উত্তর কোরিয়ার নেতা নিজ দেশের জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করছে যে যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়া তাদের 'প্রধান শত্রু'। তাই তাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্য অস্ত্র বানানো ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।

এতে আরও বলা হয়, গত ১৮ নভেম্বর কিম জু আইকে প্রথম জনসম্মুখে দেখা যায়। সে সময় একটি বিশালাকৃতির 'হোয়াসং-১৭' ক্ষেপণাস্ত্রের সামনে তাকে দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়। এরপর তাকে অন্তত ১০ বার তার বাবার সঙ্গে দেখা গেছে।

গত ১৮ ও ১৯ মার্চ অনুষ্ঠিত সামরিক মহড়ার অনুষ্ঠানেও বাবা কিমের সঙ্গে মেয়েকে দেখা যায়।

কিম জু আই
বাবা কিম এবং বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, সামরিক কর্মকর্তা ও অন্যদের সঙ্গে কিম জু আই। ছবি: কেসিএনএ/রয়টার্স

গত ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনের শিরোনামে বলা হয়, 'কিমের মেয়ের উপস্থিতি উত্তরাধিকারী নিয়ে প্রশ্ন জাগিয়েছে'।

এই প্রতিবেদনে বলা হয়, কিমকে সাধারণত ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে প্যারেড দেখতে দেখা যায়। কিন্তু, বাবার পাশে মেয়ের উপস্থিতি সাধারণত দেখা যায় না। এমন দৃশ্য 'গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের' ইঙ্গিত দেয়। ধারণা করা হচ্ছে, এই মেয়েকে উত্তর কোরিয়ার ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে 'বেছে নেওয়া' হচ্ছে।

জার্মানির রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলের এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়, 'কিমের উদ্দেশ্য পরিষ্কার নয়'। বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে এতে আরও বলা হয়, একমাত্র কিমই বলেতে পারবেন আসলে তিনি কী ভাবছেন।

প্রতিবেদন অনুসারে, উত্তর কোরিয়ার সংবাদমাধ্যমে দেখা গেছে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা 'নিচু হয়ে জু আইকে অভিবাদন জানাচ্ছেন'। অনুষ্ঠানে তাকে কিমের 'সবচেয়ে প্রিয়' সন্তান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়, জু আইয়ের সুন্দর পোশাক তার মা রি সল জুর কথা মনে করিয়ে দেয়। তিনি উত্তর কোরিয়ার স্টাইল আইকন হিসেবে সুবিদিত।

কিম জু আই
জাতীয় মহাকাশ উন্নয়ন প্রশাসন পরিদর্শনে কিম জং উন ও কিম জু আই। ছবি: কেসিএনএ/রয়টার্স

জু আইকে নিয়ে প্রোপাগান্ডা?

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স এজেন্সির (সিআইএ) ওপেন সোর্স এন্টারপ্রাইজের সাবেক উত্তর কোরিয়া বিশ্লেষক ও ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক গবেষণা সংস্থা স্টিমসন সেন্টারের ফেলো রিচেল মিনইয়ং লি মনে করেন, জু আইকে জনসম্মুখে আনার পেছনে দেশটির 'প্রোপাগান্ডা মেশিন' কাজ করছে।

লি জানান, প্রথমদিকে উত্তর কোরিয়ার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পাশাপাশি জু আইকেও সামরিক অনুষ্ঠানে আনা হতো। এর মাধ্যমে পিয়ংইয়ং যে 'শক্তিশালী বার্তা' দিতে চায় তা হলো—'দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তার জন্য উত্তর কোরিয়া অস্ত্র উৎপাদন চালিয়ে যাবে।'

এই বিশ্লেষক আল জাজিরাকে বলেন, 'উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনীর প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে কিম তার মেয়েকে নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। সেখানে দেওয়া ভাষণে কিম "প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে" শক্তিশালী সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দেন।'

'এছাড়াও, জু আইকে ক্ষেপণাস্ত্র কারখানায় ও সামরিক কুচকাওয়াজে দেখা গিয়েছিল' উল্লেখ করে লি আরও বলেন, 'অন্যান্য অনুষ্ঠানে এই মেয়ের উপস্থিতিকে কিমের উত্তরাধিকার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। তবে, জু আইকে সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী হিসেবে তুলে ধরার চেয়ে এর পেছনে কিমের প্রোপাগান্ডা থাকার সম্ভাবনা আছে।'

সংবাদ প্রতিবেদন জানা যায়, জু আইকে তার বাবার সঙ্গে হাসিমুখে থাকার দৃশ্য উত্তর কোরিয়ার টেলিভিশনে দেখানো হয়। তবে লির মতে, এমন দৃশ্য দেখে দেশটির কোনো নাগরিকই জু আইকে কিমের সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী মনে করেন না।

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

12h ago