জাপান হারিয়ে যাবে?

জাপান হারিয়ে যাবে
টোকিওর এক নার্সিং হোমে রোবট ‘পেপার’র সঙ্গে ব্যায়াম করছেন প্রবীণ জাপানিরা। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

সূর্য উদয়ের দেশ জাপানে টানা ৪২ বছর ধরে শিশু জন্মের হার কমছে। এখন তা নতুন রেকর্ড গড়েছে। দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা জন্মহার বাড়াতে 'অভূতপূর্ব' ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

গত শুক্রবার জাপানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে দেশটির সংবাদমাধ্যম জাপান টুডে জানায়, গত ১ এপ্রিল জাপানে বিদেশিসহ ১৪ বছর বা এর কম বয়সী শিশুর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৪০ লাখ ৩৫ হাজার। গত বছরের তুলনায় ৩ লাখ শিশু কম।

জাতিসংঘের হিসাব অনুসারে, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইতালির চেয়ে জাপানে শিশু জন্মের হার কম। গত অক্টোবরে জাপান সরকার জানায়, দেশজুড়ে শিশু জন্মের হার কমেছে।

জাপানের 'অভাবনীয় চ্যালেঞ্জ'

গত ৩০ এপ্রিল প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম নিউজউইকের একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয়, 'জাপানের জনসংখ্যা এমনভাবে কমছে যা হয়তো আর বাড়ানো যাবে না'।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এশিয়ার দ্বিতীয় শীর্ষ অর্থনীতির দেশ জাপানের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

দেশটির পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, বর্তমানে সেখানকার মোট জনসংখ্যা ১২ কোটি ৪০ লাখ ৯৪ হাজার। ১৫ বছর থেকে ৬৪ বছর বয়সীর সংখ্যা কমে ৭ কোটি ৪০ লাখে দাঁড়িয়েছে। এটি ১৯৪৫ সালের পর সর্বনিম্ন।

অন্যদিকে, ৬৫ বছরের বেশি মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৬০ লাখ ২৩ হাজারে। এটি ১৯২০ সালের পর সবচেয়ে বেশি।

সবচেয়ে আশঙ্কাজনক তথ্য হচ্ছে, যে জনসংখ্যার ওপর ভিত্তি করে জাপানের অর্থনীতি 'বিস্ময়' দেখিয়েছিল তা ১৯৯০ এর দশক থেকে ক্ষয়ে যেতে শুরু করেছে।

জাপান হারিয়ে যাবে
থেরাপেটিক রোবট ‘পারো’কে নিয়ে প্রবীণ সাতসুকো ইয়াৎসুজাকা। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

নিম্ন জন্মহার ও বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় জাপান 'অভাবনীয় চ্যালেঞ্জ'-এ পড়েছে।

জাপানে যে গতিতে জনসংখ্যা কমছে তা জাতিটির অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। গত বছর দেশটিতে ৮ লাখ শিশু জন্ম নিয়েছে, যা ১৮৯৯ সালের পর সর্বনিম্ন। জাপান সরকার আশা করেছিল যে ২০২৭ সালে সেখানে ৮ লাখ ১৫ হাজার শিশু জন্ম নেবে। কিন্তু, এর আগেই শিশু জন্মের হার কমে গেছে। বাস্তবতার সঙ্গে সরকারের হিসাবের মিল পাওয়া যাচ্ছে না।

গত মাসে জাপানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জাতীয় জনসংখ্যা ইনস্টিটিউট ও সামাজিক নিরাপত্তা গবেষণায় (আইপিএসএস) বলা হয়েছে, এই ধারা চলতে থাকলে আগামী ২০৫৯ সালে জাপানে শিশু জন্ম নেবে ৫ লাখের কম।

'অতি বয়স্ক' মানুষের দেশ

অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপরারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সদস্যভুক্ত উন্নত দেশগুলোয় জনসংখ্যা স্থিতিশীল রাখতে একজন নারীর সন্তান জন্ম দেওয়ার সক্ষমতার গড় হার ধরা হয়েছে ২ দশমিক ১। অথচ, জাপানে এই হার ১ দশমিক ৩।

জাতিসংঘের দৃষ্টিতে জাপান পরিণত হয়েছে 'অতি বয়স্ক' মানুষের দেশে। কেননা, দেশটির ২০ শতাংশ মানুষের বয়স ৬৫ বছরের বেশি। অন্যদিকে, গত বছর দেশটিতে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা রেকর্ড হারে কমে দাঁড়িয়েছে ৫৯ দশমিক ৪ শতাংশে।

প্রবীণদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নবীনদের ওপর চাপ প্রতিনিয়ত বাড়ছে।

জাপান হারিয়ে যাবে
জাপানের ইবারাকি দ্বীপে অসুস্থ ইওইচি সুজুকির কাছে রোবট ‘এআইবিও’। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

আইপিএসএসের তথ্য মতে, আগামী ৫০ বছরে জাপানে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৩৮ দশমিক ৭ শতাংশে। সেসময় নারীদের গড় আয়ু হবে ৯১ বছর ও পুরুষদের ৮৫ বছর।

২০৫৩ সাল থেকে ২০৫৬ সালের মধ্যে জাপানের জনসংখ্যা ১০ কোটির নিচে নেমে আসবে। সেখানে তখন বিদেশিদের সংখ্যা বেড়ে যেতে পারে।

২০২১ সালে জাপানে মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ২ শতাংশ ছিল বিদেশি। আগামী ৫০ বছরে তা বেড়ে ১০ দশমিক ৮ শতাংশে দাঁড়াতে পারে।

সংকটে তরুণ সমাজ

ক্রমাগত শ্রমিক সংকট ও মূল্যস্ফীতির কারণে জাপানে ক্ষুদ্রশিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো সংকটে পড়েছে। গত ১ মে বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ তথ্য জানিয়ে বলেছে, দেশটির ৬০ শতাংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান এ বছর শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাড়িয়েছে।

১৯৯০ এর দশকের পর তথা প্রায় ৩০ বছর পর দেশটিতে এবারই প্রথম এমন চিত্র দেখা গেল।

জাপানের আবাসন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় শ্রমিকদের বেতনভাতা বাড়াতে হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

যেসব প্রতিষ্ঠান বেতন বাড়াতে পারেনি সেসব প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের ভাতা বাড়ানোর কথা ভাবছে।

টোকিওর হাচিওজি এলাকার ফায়ার ইঞ্জিন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের নিহন কিকাই কোগিও গণমাধ্যমকে জানান, ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে তারা পণ্যের দাম কমাতে বাধ্য হচ্ছেন।

গত ২ বছর ধরে লোকসানে আছেন উল্লেখ করে তিনি আরও জানান, শ্রমিকদের ভাতা বাড়াতে পারেননি বলে তার প্রতিষ্ঠানের ১৬০ কর্মীর মধ্যে গত বছর ১০ জন চাকরি ছেড়েছেন।

অর্থনৈতিক সংকট জাপানের তরুণ সমাজকে ধাক্কা দিয়েছে। নিউজউইকের প্রতিবেদনে বলা হয়, জাপানের যে তরুণ সমাজ দেশটিকে টিকিয়ে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে সেই তরুণ সমাজের একটি বিশাল অংশ বিয়ে করতে বা সন্তান নিতে দেরি করতে চায়। অনেককে অনেক অনেক দেরির কথাও বলেছেন। কারণ, একদিকে জাপানে চাকরির বাজার যেমন অনিশ্চিত, অন্যদিকে সেখানে জীবনযাত্রার খরচ খুবই বেশি।

জাপানের ভবিষ্যৎ

জনসংখ্যা হ্রাস-বৃদ্ধি নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারণে ভুল থাকলে তা দেশটির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু, একটি দেশের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়লে তার দায় পুরো সমাজকেই নিতে হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে যোগ হয় পশ্চিমের সাংস্কৃতিক প্রভাব। সেই প্রভাব এই এশীয় দেশটির তরুণ সমাজকে এতটাই প্রভাবিত করেছে যে তারা নিজেদের সংস্কৃতি থেকে সরে যেতে দ্বিধা করছে না। ফলে পারিবারিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে।

জনসংখ্যার দিক থেকে জাপানের আজকের দুরাবস্থা এতটাই প্রকট যে নিউজউইকের দৃষ্টিতে বিশ্ব অর্থনীতিতে জাপান তার তৃতীয় অবস্থানটিও ধরে রাখতে পারবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

জাপানের রিক্রুট ওয়ার্ক ইনস্টিটিউটের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ২০৪০ সালে দেশটিতে শ্রমিকের সংখ্যা ১ কোটি ১০ লাখে নেমে আসবে। নোমুরা রিসার্চ ইনস্টিটিউটের হিসাবে, এই দশকের শেষে জাপান প্রথমবারের মতো লজিস্টিকস সংকটে পড়তে যাচ্ছে।

ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের জ্যেষ্ঠ ফেলো এরিন মারফি নিউজউইককে বলেন, 'জাপানের অর্থনৈতিক অবস্থাও সংকটে পড়বে। করের অভাবে সরকার চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান কমে যাবে।'

তিনি মনে করেন, এমন পরিস্থিতিতে জাপান হয়তো অভিবাসন-বিরোধী নীতি থেকে সরে আসতে পারে। তার প্রশ্ন, ক্রেতা না থাকলে পণ্য উৎপাদন করা হবে কার জন্য? কর না পেলে গণপরিবহন চলবে কীভাবে? জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার অর্থ আসবে কোথা থেকে? প্রবীণদের যত্ন নেওয়ার খরচ মিটবে কে?

গত জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী কিশিদার সরকার 'সন্তান আগে' নীতির ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, 'জাপান এক খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে। এটি টিকে থাকবে কিনা এখন সেটাই প্রশ্ন।'

গত ৬ মার্চ কিশিদার পরামর্শক মাসাকো মরি আক্ষেপ করে গণমাধ্যমকে বলেন, 'এভাবে চললে জাপান একদিন বিলুপ্ত হয়ে যাবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Constitution should be updated

Dr Kamal Hossain, emeritus president of Gono Forum, yesterday recommended updating the constitution.

19m ago