তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া যা চায়
তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারার উপকণ্ঠে এক জনবহুল এলাকায় চায়ের দোকানে ২ তরুণ ভোটার চায়ের কাপে ঝড় তুলছিলেন আগামী ১৪ মের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে।
তাদের একজন ইফলাহ সমর্থন করেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানকে। অন্য তরুণ কানের সমর্থন এরদোয়ানের প্রতিদ্বন্দ্বী কামাল কিলিজদারগলুর প্রতি।
ইফলাহর দৃষ্টিতে এরদোয়ান তুরস্কের 'অভিভাবক'। তিনি মনে করেন, 'তুরস্কে এরদোয়ানের কোনো বিকল্প নেই'।
কামালের সমর্থক কানের অভিমত, 'দেশ ভালোভাবে চলছে না। এই নির্বাচনের মাধ্যমে এরদোয়ানের দীর্ঘ শাসনের সমাপ্তি হবে।'
তুরস্কের প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচন সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে গত ১৬ এপ্রিল ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান এই চিত্র তুলে ধরে।
তবে কেবল তুরস্কের ভেতরেই নয়, এর বাইরেও এরদোয়ানের পক্ষে-বিপক্ষে মত আছে।
আগামী ১৪ মে তুরস্কে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে বিশ্বের ২ পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যেও 'রেষারেষি' দেখা যাচ্ছে।
পশ্চিমের 'শত্রু' এরদোয়ান
২০০৩ সালের ১৫ মার্চ দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতা নিয়েছিলেন রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। ভোটের মাঠে যুক্তরাষ্ট্র ও বিশেষ করে ইউরোপবিরোধী মনোভাব প্রকাশ করে ভোটারদের মন জয়ের পাশাপাশি মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে তিনি মুসলিম বিশ্বেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেন।
দেশে-বিদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠা এরদোয়ান ২০১৪ সালে তুরস্ককে সংসদীয় ব্যবস্থা থেকে প্রেসিডেনশিয়াল পদ্ধতিতে রূপান্তর করেন। বিরোধীদের মতে, একক ক্ষমতা উপভোগ করতেই শাসনব্যবস্থায় এমন পরিবর্তন আনেন এরদোয়ান।
এরদোয়ানের সমর্থকদের কাছে তিনি 'পিতৃতুল্য' হলেও বিরোধীরা তাকে 'কর্তৃত্ববাদী' শাসক বলে গণ্য করে।
এর প্রতিফলন দেখা যায় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও। এরদোয়ানের শাসনামলে একদিকে মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সঙ্গে ন্যাটোর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য তুরস্কের দূরত্ব বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে পশ্চিমবিরোধী রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে।
গত ২০ বছর ধরে তুরস্কের শাসনভার এরদোয়ানের হাতে থাকায় তুরস্কে আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি এর পররাষ্ট্রনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। দীর্ঘসময় শাসনের ফলে ঘরে-বাইরে তার অনেক শত্রু-মিত্র সৃষ্টি হয়েছে।
বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, বিশেষ করে চলমান ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তুরস্কের নির্বাচনকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে। এই সংকটে 'নিরপেক্ষ' অবস্থান নিয়ে ও সংকট সমাধানে 'মধ্যস্থতাকারী' হিসেবে উপস্থাপন করে এরদোয়ান নিজেকে নতুন উচ্চতায় তুলে এনেছেন।
কিন্তু এরদোয়ানের এই ভূমিকাকে সন্দেহের চোখে দেখে আসছে পশ্চিমের দেশগুলো। গত ২০ বছরে এরদোয়ানের সঙ্গে নানা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও এর ইউরোপীয় মিত্রদের প্রকাশ্য বিবাদ দেখা গেছে।
গতকাল মঙ্গলবার ফরাসি সংবাদমাধ্যম ফ্রান্স টোয়েন্টিফোরের প্রতিবেদনে বলা হয়, এক সময়ের শত্রু ও বর্তমানের 'ঘনিষ্ঠ বন্ধু' রাশিয়া চায় বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবার ক্ষমতায় আসুক। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের সমর্থন আছে এরদোয়ানের প্রতিদ্বন্দ্বী ও পশ্চিমপন্থি জাতীয়তাবাদী নেতা কামালের প্রতি।
'এরদোয়ানকে নিয়ে হতাশ পশ্চিম'
নির্বাচনে কামাল কিলিজদারগলুর ৬ দলীয় জোট 'নেশন অ্যালায়েন্স' চায় পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্ক আগের পর্যায়ে উন্নীত করতে। এই জোট চায় ইউরোপীয় মানবাধিকারনীতি মেনে ইউরোপীয় ইউনিয়নে তুরস্কের সদস্যপদ নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে।
শুধু তাই নয়, এই জোট যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কর্মসূচি নিয়ে দ্বন্দ্বও মেটাতে চায়।
রাশিয়ার এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র কেনায় ২০১৯ সালে এই কর্মসূচি থেকে তুরস্ককে বের করে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এ ঘটনা ওয়াশিংটনের সঙ্গে আঙ্কারার দূরত্ব অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, তুরস্কের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমের দেশগুলো নীরব থাকলেও এ কথা ধরে নেওয়া যে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ এরদোয়ানের প্রতিদ্বন্দ্বী কামালের বিজয়ে খুশি হবে।
পশ্চিমের দেশগুলো ক্রমাগত তুরস্কে বিরোধীদের দমনপীড়ন বন্ধ, মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতা তুলে ধরার আহ্বান জানালে এরদোয়ান কঠোর ভাষায় 'অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাইরের শক্তির হস্তক্ষেপ না করার' পরামর্শ দেন।
এক্ষেত্রে রাশিয়ার ভূমিকা ভিন্ন। মস্কো প্রতিবেশী তুরস্কের সঙ্গে মূলত বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দেয়।
ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক 'সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের বিশ্লেষক জেফরি মানকফ বলেন, 'পশ্চিমের দেশগুলোর বহু কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতা তুরস্কের এরদোয়ানের ওপর বিরক্ত। তাকে নিয়ে তারা হতাশা প্রকাশ করেছেন। তারা মনে করেন যে, পশ্চিমের সঙ্গে তুরস্কের দূরত্ব বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ এরদোয়ান। তিনি সবকিছু ব্যক্তিগতভাবে নিয়ে সস্তা জনপ্রিয়তার পথে হেঁটেছেন।'
তবে মানকফ মনে করেন, ভোটারদের মধ্যে পশ্চিমবিরোধী মনোভাব ছড়িয়ে দিয়ে আবার বিজয়ী হওয়া এরদোয়ানের মতো রাজনীতিকের জন্য কঠিন কিছু নয়।
একেপি বনাম সিএইচপি
আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা কামাল আতাতুর্কের হাতে গড়া রিপাবলিকান পিপলস পার্টি (সিএইচপি) দেশটির জাতীয়তাবাদী দল হিসেবে পরিচিত। ১৯২৩ সালে রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত সিএইচপিকে পশ্চিমপন্থি হিসেবে গণ্য করা হয়।
অন্যদিকে ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত এরদোয়ানের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টিকে (একেপি) ধরা হয় ইসলামপন্থি ও পশ্চিমবিরোধী দল হিসেবে।
কয়েক দশকের সেনাশাসন ও সেনাসমর্থিত শাসকদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ তুর্কিরা পরিবর্তনের আশায় ২০০২ সালে সংসদীয় নির্বাচনে একেপিকে বিজয়ী করে। দলটি গঠনের এক বছরের মাথায় এটি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছিল মূলত উদারপন্থি দলনেতা আব্দুল্লাহ গুলের জনপ্রিয়তার কারণে।
এর পরের বছর একেপির নেতৃত্ব চলে আসে তুলনামূলক রক্ষণশীল এরদোয়ানের হাতে। তিনি ২০১৪ সাল পর্যন্ত দলীয় প্রধান হিসেবে ছিলেন। এরপর ২০১৮ সালে তিনি আবার দলের প্রধান হন এবং এখন পর্যন্ত তিনি সেই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
এরদোয়ানবিরোধীদের মতে, তিনি একজন কর্তৃত্ববাদী ও বিরোধী মত দমনকারী। তার দলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও আছে।
অন্যদিকে, স্বল্পভাষী কামাল কিলিজদারগলুর খ্যাতি আছে অর্থনীতিবিদ ও সমাজবাদী গণতন্ত্রী হিসেবে। তবে, তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বী এরদোয়ানের মতো অতটা 'জনপ্রিয়' নন।
বিশ্লেষকদের মতে, ইসলামপন্থি এরদোয়ান ও ধর্মনিরপেক্ষ কামালের এবারের প্রতিদ্বন্দ্বিতা নির্বাচনে নতুন মাত্রা যোগ করতে যাচ্ছে। তবে, কামাল জিতলেই যে তুরস্ক আবার পশ্চিমমুখী হয়ে উঠবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই।
এরদোয়ানের প্রতি রাশিয়ার 'স্পষ্ট' সমর্থন
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি সহযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ন্যাটোভুক্ত দেশ তুরস্কের ক্ষমতা গ্রহণ করলেও পশ্চিমের দেশগুলোর সঙ্গে তার 'মধুচন্দ্রিমা' বেশিদিন টেকেনি।
২০০২ সালে একেপি ক্ষমতায় এসে পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণের মাধ্যমে প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করে। মধ্যপন্থি ইসলামি নীতি গ্রহণ করায় আরব ও মুসলিম ব্যবসায়ীদের জন্য আকর্ষণীয় স্থান হয়ে উঠে তুরস্ক।
পশ্চিমের দেশগুলোর ওপর একক নির্ভরশীলতা কমাতে গিয়ে এরদোয়ানের তুরস্ক মার্কিনবিরোধী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গেও সখ্যতা গড়ে তোলে।
যে রাশিয়ার সঙ্গে তুরস্কের দ্বন্দ্ব শত শত বছরের পুরোনো, সেই রাশিয়ার সঙ্গেই এখন দেশটির ঘনিষ্ঠতা বেশ গভীর। সাম্প্রতিক সময়ে সিরিয়া, লিবিয়া ও আজারবাইজান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া নাগোর্নো-কারাবাখ নিয়ে মস্কোর সঙ্গে আঙ্কারার মতপার্থক্য থাকলেও বিশ্বমঞ্চে পশ্চিমের একাধিপত্য কমানোর বিষয়ে প্রতিবেশী দেশ ২টি একমত।
২০১৬ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এরদোয়ানকে সরানোর চেষ্টা করা হলে তা ব্যর্থ হয়। পশ্চিমের দেশগুলো এই অভ্যুত্থানের জোরালো নিন্দা না করায় তুরস্ক সাবেক মিত্রদের সঙ্গে ব্যবধান বাড়ানোর পাশাপাশি রাশিয়া-চীনসহ পশ্চিমবিরোধী দেশগুলোর সঙ্গে সখ্যতা বাড়িয়েছে।
ওয়াশিংটন ডিসির সেন্ট লরেন্স ইউনিভার্সিটি ও মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের তুরস্কবিষয়ক বিশ্লেষক হওয়ার্ড ইসেনস্টাট ফরাসি গণমাধ্যম ফ্রান্স টোয়েন্টিফোরকে বলেন, 'রাশিয়া এরদোয়ানের বিজয় চায়।' তিনি মনে করেন, এরদোয়ান আবারও নির্বাচিত হলে তুরস্কের বর্তমান পররাষ্ট্রনীতিতে বিশেষ কোনো পরিবর্তন আসবে না।
জার্মান মার্শাল ফান্ডের আঙ্কারা ব্যুরোর পরিচালক ওজগুর উনলুহিশারজিকলি সংবাদমাধ্যমটিকে বলেন, 'সেই শীতল যুদ্ধের যুগ থেকেই ওয়াশিংটনের পর মস্কো আঙ্কারার দ্বিতীয় পছন্দ। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের সম্পর্কে ফাঁক খোঁজার চেষ্টা মস্কো কখনই বন্ধ করেনি।'
বিশ্লেষক জেফরি মানকফের মতে, 'পশ্চিমের কাছে নেতা হিসেবে এরদোয়ান বেশ বিরক্তিকর। এ বিষয়টি রাশিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে।'
সাবেক তুর্কি কূটনীতিক ও ইস্তাম্বুলভিত্তিক গবেষণা সংস্থা কারনিজি ইউরোপের ভিজিটিং ফেলো সিনান উলগেন বলেন, 'রাশিয়া পরিষ্কার করেই এরদোয়ানকে সমর্থন দিয়েছে। রাশিয়া থেকে কেনা প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম পরিশোধের বিষয়ে এরদোয়ান সরকারকে মস্কোর দেওয়া সুবিধাগুলো এর প্রমাণ।'
গত ১৯ এপ্রিল কাতার ইকোনমিক ফোরামের ওয়েবসাইটে তুরস্কের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে বলা হয়—সম্প্রতি জনজরিপে দেখা গেছে যে, তুরস্কে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে 'হাড্ডাহাড্ডি' লড়াইয়ের আভাস পাওয়া গেছে। এমনকী, আঙ্কারায় নতুন সরকার আসার সম্ভাবনাও আছে।
গত ২২ এপ্রিল প্রখ্যাত সাময়িকী ফরেন পলিসির 'এরদোয়ান নির্বাচনে হেরে গেলে কী হতে পারে' শীর্ষক প্রতিবেদনেও এই জরিপের প্রসঙ্গ আসে। এতে বলা হয়, ক্ষমতায় আসার ২০ বছর পরও ভোটের মাধ্যমে এরদোয়ানকে সরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি কল্পনা করা কঠিন। তবে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে স্বল্প ব্যবধানে পরাজিত করার ঘোষণা দিতে পারেন।
Comments