চীন-তাইওয়ান দ্বন্দ্ব কি নতুন বৈশ্বিক সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি করছে
চীন-তাইওয়ান সংকটের গল্প ৭ দশকের বেশি পুরোনো। এই দীর্ঘ সময়ে সংকট সমাধানের চেষ্টা যতটা না দৃশ্যমান হয়েছে তার চেয়ে বেশি দৃশ্যমান হয়েছে তাইওয়ান প্রণালীতে নানান সময়ে চীনের সামরিক মহড়াকে ঘিরে বৈশ্বিক উত্তেজনা।
স্বঘোষিত দ্বীপরাষ্ট্র তাইওয়ানকে চীন বরাবরই নিজ ভূখণ্ডের অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করে। অন্যদিকে, তাইওয়ান চায় স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে নিজস্ব পরিচয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচিত হতে।
তাইওয়ানের এই আকাঙ্ক্ষা রোধে চীন প্রয়োজনে 'বল প্রয়োগের' হুমকি দিয়ে আসছে বরাবর। নতুন করে পরাশক্তি চীনের এমন হুমকি চলমান ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে আরও এক বৈশ্বিক সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি করেছে দুনিয়ার শান্তিপ্রিয় মানুষের মনে।
গতকাল মঙ্গলবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানিয়েছে, তাইওয়ান প্রণালীতে চীনের ৩ দিনের সামরিক মহড়া 'শেষ হওয়া'র পরদিন দ্বীপটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোসেফ উ সংবাদমাধ্যমটিকে বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেছেন, 'সব দেখে মনে হচ্ছে তারা তাইওয়ানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে।'
একইদিনে তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছিল, তাইওয়ান প্রণালীতে চীনের ৩ দিনের সামরিক মহড়া শেষ হলেও বেইজিংয়ের যুদ্ধবিমান ও যুদ্ধজাহাজগুলো তাইওয়ানের আশপাশে অবস্থান করছে।
দ্বীপটির সরকারি সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে এতে আরও বলা হয়, প্রকৃতপক্ষে চীন-তাইওয়ান যুদ্ধ হলে চীনের নৌবাহিনী যেভাবে হামলা চালাবে তার প্রশিক্ষণ চলছে তাইওয়ানের চারপাশে।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, যদিও গত সোমবার স্থানীয় সময় রাতে চীন মহড়া শেষ হওয়ার কথা বলেছে, তবুও গতকাল সকালে চীনের ৯ যুদ্ধজাহাজ ও জে-১৬ ও সু-৩০ জঙ্গিবিমানসহ ২৬টি উড়োজাহাজকে মহড়াস্থলে দেখা গেছে।
চীনের এই সামরিক মহড়াকে বেইজিংয়ের 'দায়িত্বজ্ঞানহীন' আচরণ আখ্যা দিয়ে সমালোচনা করেছেন তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন। তিনি মনে করেন, এই অঞ্চলে বড় দেশ হিসেবে চীনের এমন আচরণ 'শোভা পায় না'।
চীনের এমন আচরণ কি বিশ্ববাসীকে নতুন বার্তা দিচ্ছে?
তাইওয়ান প্রণালীতে চীন যখনই কোনো মহড়ার আয়োজন করে তখন তাইওয়ান সরকার এর সমালোচনা করে, পিপলস লিবারেশন আর্মির গতিবিধির ওপর নজর রাখে। বরাবরের মতো তাইওয়ান এটাও বলে যে তারা কোনো উত্তেজনা চায় না।
জটিল হচ্ছে তাইওয়ান পরিস্থিতি
২০২২ সালের আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইপে সফরে পর থেকেই তাইওয়ান আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ঘন ঘন শিরোনাম হচ্ছে।
সেসময় তাইওয়ানকে ঘিরে 'নজিরবিহীন' সামরিক মহড়ার অংশ হিসেবে চীন দ্বীপটির উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে বেশ কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল।
এর প্রায় ৪ মাস পর তাইওয়ান প্রণালীতে আবারও বড় আকারের সামরিক মহড়া করে চীন।
তাইওয়ান প্রণালীকে বিশ্বের 'সবচেয়ে বিপদজনক অঞ্চল' হিসেবে আখ্যা দিয়ে ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল তাইওয়ান ইনস্টিটিউট জানায়, কয়েক দশকের পুরোনো এই সংকট সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আরও জটিল হয়েছে।
গত সোমবার ফেসবুকে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন লিখেন, 'আমি বিশ্বে আমার দেশের প্রতিনিধিত্ব করি'। সাইয়ের মতে, চলতি মাসের শুরুতে তার গুয়েতেমালা, বেলিজ ও যুক্তরাষ্ট্র সফর নতুন কিছু নয়। তাইওয়ানের জনগণ তা প্রত্যাশা করে।
কিন্তু, তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টের সফরে ভীষণ ক্ষিপ্ত চীন। 'গুরুতর পরিণতি'র হুমকি দিয়েছে বেইজিং। প্রতিক্রিয়া হিসেবে তাইওয়ান প্রণালীতে তাদের এই মহড়া।
সংবাদমাধ্যমগুলো জানায়, 'নির্ভুলভাবে লক্ষ্যবস্তুতে হামলা ও তাইওয়ানকে ঘেরাও করার এই মহড়ায় কয়েক ডজন বোমারু ও জঙ্গিবিমান অংশ নেয়।
তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মহড়া চলাকালে দ্বীপটির চারপাশ দিয়ে চীনের ৯১টি সামরিক উড়োজাহাজ উড়ে গেছে।
একে 'রেকর্ড' হিসেবে মন্তব্য করেছে তাইওয়ানের সরকারি সংবাদ সংস্থা সেন্ট্রাল নিউজ এজেন্সি। যদিও এর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে যে তারা এটি যাচাই করতে পারেনি।
তবে তাইওয়ান প্রণালীর 'উত্তেজনা' শুধু দ্বীপটিতেই সীমাবদ্ধ থাকছে না।
গতকাল রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনের মহড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাপান। বিশেষ করে, জাপানের দক্ষিণাঞ্চলীয় দ্বীপগুলো তাইওয়ানের অনেক কাছে। তাইওয়ান প্রণালীতে কোনো সংঘর্ষ হলে তা জাপানকেও জড়িয়ে ফেলতে পারে।
গত বছরের আগস্টে চীনের মহড়া চলাকালে ছোড়া একটি ক্ষেপণাস্ত্র জাপানের 'বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে'র সীমানায় পড়েছিল। তাই এখানে বেইজিংয়ের মহড়ায় উদ্বিগ্ন থাকে টোকিও।
গতকাল জাপানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়াসুকাজু হামাদা মন্তব্য করেন, তাইওয়ানকে ঘিরে চীনের মহড়া দ্বীপটির আকাশ-সাগর নিয়ন্ত্রণ হাতে রাখতে বেইজিংয়ের এক 'ভীতিকর প্রশিক্ষণ'।
ছড়িয়ে পড়ছে 'তাইওয়ান ভীতি'
তাইওয়ান প্রণালীতে বেইজিংয়ের মহড়া শেষ হতে না হতেই যুক্তরাষ্ট্র ও ফিলিপাইন বড় আকারের সামরিক মহড়া শুরু করেছে।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে 'নিয়ন্ত্রণে রাখার' লক্ষ্য নিয়েই গতকাল দক্ষিণ চীন সাগরে এই মহড়ার আয়োজন করা হয়েছে।
সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা জানায়, 'বালিকাতান' বা 'কাঁধে কাঁধ' নামের এই মহড়ায় ১২ হাজার ২০০ মার্কিন সেনার সঙ্গে ফিলিপাইনের ৫ হাজার ৪০০ সেনা অংশ নিচ্ছে। এ ছাড়াও, অস্ট্রেলিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশ সেখানে প্রতিনিধি পাঠিয়েছে।
আগামী ২৮ এপ্রিল এই মহড়া শেষ হওয়ার কথা।
সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সমগ্র দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিংয়ের সম্প্রসারণ নীতির কারণে ফিলিপাইন বেশ চাপে আছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে চীনের কোস্ট গার্ডকে অভিযুক্ত করে ম্যানিলা বলে, তারা ফিলিপাইনের নৌবাহিনীর জাহাজকে লক্ষ্য করে লেজার নিক্ষেপ করেছিল। জাহাজটি ফিলিপাইনের আয়ুঙ্গিন শাওল অঞ্চলে রসদ নিয়ে যাচ্ছিল।
এ ক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১২ সালে বেইজিং ফিলিপাইনের স্কারবোরো শাওলের নিয়ন্ত্রণ নেয়। এর পরের বছর ম্যানিলা চীনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে অভিযোগ করে।
দ্য হেগ থেকে চীনের স্কারবোরো শাওলের দাবিকে আইনগত দিক থেকে 'ভিত্তিহীন' বললে চীন সেই রায় প্রত্যাখ্যান করে।
গত ২ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র ও ফিলিপাইন 'প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি'র ঘোষণা দেয়। এই চুক্তি অনুসারে, মার্কিন সেনারা আরও সহজে ফিলিপাইনে ঘাঁটি গড়তে পারবে।
জনজরিপে দেখা গেছে, অধিকাংশ ফিলিপিনো ওয়াশিংটনের সঙ্গে ম্যানিলার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে সমর্থন করে। তবে, এই অঞ্চলে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় অনেকে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
এক সময় যে ফিলিপাইনে জনক্ষোভের মুখে মার্কিন ঘাঁটি বন্ধ করা হয়েছিল এখন সেই ফিলিপাইনেই আরও বেশি সুবিধা নিয়ে মার্কিন সেনারা আসছে।
এ কথা বলা অপেক্ষা রাখে না যে, ফিলিপাইনের স্কারবোরো শাওলের নিয়ন্ত্রণ, তাইওয়ানকে ঘিরে চীনের সামরিক কর্মকাণ্ড ও দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিংয়ের ঘাঁটি গড়ায় যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে ওয়াশিংটন ও ম্যানিলার সম্পর্ক জোরদার হচ্ছে।
সংঘাতের শুরু ও ধারাবাহিকতা
১৯৪৯ সালের অক্টোবরে জাতীয়তাবাদী নেতা চিয়াং কাই-শেকের 'কুওমিনতাং' অনুসারীরা পরাজিত হলে মাও সে-তুংয়ের নেতৃত্বে কমিউনিস্টরা চীনের ক্ষমতায় আসে। পরাজিত জাতীয়তাবাদীরা আশ্রয় নেয় তাইওয়ানে।
সে বছর ডিসেম্বরে জাতীয়তাবাদীরা তাইওয়ানে নিজেদের সরকার গঠনের পাশাপাশি বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে।
এর পরের বছর তাইওয়ানের দিকে মিত্রতার হাত বাড়ায় যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র তখন কোরিয়ায় কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল। তাইওয়ানকে চীনের সম্ভাব্য হামলা থেকে রক্ষা করতে যুক্তরাষ্ট্র তখন তাইওয়ান প্রণালীতে রণতরী পাঠায়।
তাইওয়ানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে বাণিজ্যিক ও সামরিক সম্পর্ক বজায় রাখলেও যুক্তরাষ্ট্র 'এক চীন' নীতিতে বিশ্বাস করে। এই নীতি অনুসারে, তাইওয়ান কোনো পৃথক রাষ্ট্র নয়। তবে তাইওয়ানকে চীনের অংশ হিসেবেও স্বীকার করে না ওয়াশিংটন।
যুক্তরাষ্ট্র যেমন একদিকে তাইওয়ানের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে, অন্যদিকে তেমনি চীনের জোর করে তাইওয়ান দখলেরও বিরোধিতা করে।
১৯৮৭ সালে বেইজিং প্রথমবারের মতো তাইওয়ানের বাসিন্দাদের চীন সফরের অনুমতি দিলে অনেকে তাদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান। ১৯৯১ সালে তাইওয়ান জরুরি আইন তুলে নিলে চীনের সঙ্গে 'যুদ্ধাবস্থা'র অবসান হয়।
এর ২ বছর পর বিবদমান ২ পক্ষের নেতারা সিঙ্গাপুরে প্রথম সরাসরি আলোচনায় বসেন।
২০০৫ সালের মার্চে চীন এক নতুন আইন প্রণয়ন করে। আইনে বলা হয়, তাইওয়ান যদি নিজেকে স্বাধীন ঘোষণা করে তাহলে চীন দ্বীপটির ওপর বল প্রয়োগ করবে।
২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাইওয়ানের স্বাধীনতাপন্থি ডেমোক্র্যাটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি বিজয়ী হলে চীন দ্বীপটির সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে। কেননা, এই দল 'এক চীন নীতি' মানে না।
এরপর গত আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইপে সফর পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। যা এখন নতুন এক সংঘাতের আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে।
নতুন সংকট দেখবে বিশ্ববাসী?
গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের চলতি বছরের হিসাব অনুসারে, সামরিক শক্তির বিচারে ১৪৫ দেশের মধ্যে তাইওয়ানের অবস্থান ২৩তম। এই তালিকায় চীনের অবস্থান তৃতীয়। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পর চীন তৃতীয় শীর্ষ সমরশক্তি।
আর্মড ফোর্সেস ডট ইইউয়ের তথ্য অনুসারে, চীনের বার্ষিক সামরিক খরচ ২৯৩ বিলিয়ন ডলার। এর বিপরীতে তাইওয়ানের খরচ ১৯ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার।
বলা বাহুল্য, সামরিক দিক থেকে চীনের তুলনায় অনেক পিছিয়ে তাইওয়ান। তবে বর্তমানে পাশ্চাত্যে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক পরিস্থিতির মুখে প্রাচ্যে নতুন সংকট সৃষ্টি হয় কি না সেদিকেই এখন নজর বিশ্ববাসীর।
Comments