বিপন্ন প্রজাতির গোটালী মাছের সফল কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদন

কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতিতে উৎপাদিত কিছু গোটালী মাছ | ছবি: সংগৃহীত

বৈজ্ঞানিকদের চেষ্টায় বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে ভোজন রসিকদের থালা থেকে প্রায় হারিয়ে যাওয়া এক সময়ের অতি প্রিয় ছোট মাছ গোটালী।

সুস্বাদু এই মাছটিকে আন্তর্জাতিক পরিবেশ সুরক্ষা সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচার (আইইউসিএন) বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে ঘোষণা করেছিল।

দীর্ঘ গবেষণার পর সম্প্রতি নীলফামারীর সৈয়দপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) স্বাদু পানি উপকেন্দ্রের বৈজ্ঞানিকরা এর কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন।

উপরে পুরষ মাছ ও নিচে স্ফীত উদরের (পেট) স্ত্রী মাছ | ছবি: সংগৃহীত

প্রতিষ্ঠানটির প্রিন্সিপাল বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আজহার আলী বলেন, 'আইইউসিএন দেশি প্রজাতির এই মাছটির বৈজ্ঞানিক নাম ক্রস চেইলাস ল্যাটিয়াস এবং এটি সাইপ্রিনিডে পরিবারভুক্ত। ২০১৫ সালে এটি বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তারপর থেকেই বাংলাদেশ সরকার এটি সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় কর্মসূচি নেয়।'

তিনি আরও বলেন, 'আমাদের জলাশয়গুলোর দূষণ ভয়াবহ, মাছ ধরার জন্য নিষিদ্ধ কারেন্ট নেট, চায়না দুয়ারি নেট, বৈদ্যুতিক ও অন্যান্য নিষিদ্ধ পদ্ধতির ব্যবহার, সর্বোপরি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাব—সব কিছু মিলেই এই নেতিবাচক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।'

'বাংলাদেশে মোট ২৬১ প্রজাতির দেশি মাছ রয়েছে। তার মধ্যে ৬৪টি প্রজাতি বিপন্ন,' যোগ করেন তিনি।

সূত্র জানিয়েছে, গোটালী মাছ দেশের কোনো কোনো স্থানে টাটকিনি বা কালা বাটা নামেও পরিচিত। এটি এক সময় সারা দেশে, বিশেষত উত্তরাঞ্চলের তিস্তা অববাহিকা এবং ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, সিলেট ও অন্যান্য এলাকার ঝর্না ও পাহাড়ি নদীগুলোতে ব্যাপক হারে পাওয়া যেত।

মাছটির মাথা চ্যাপ্টা ও নিম্নাংশ সরু এবং এটির সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ১০ দশমিক দুই সেন্টিমিটার ও ওজন ১৫-১৭ গ্রাম।

প্রতিষ্ঠানটির জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সোনিয়া শারমিন বলেন, 'মাছটির জিন পুল রক্ষার জন্য আমরা ২০২৩ সাল থেকে ব্যাপক গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা তিস্তা ও বুড়ী তিস্তা নদী থেকে পাঁচ-ছয় গ্রাম ওজনের কিছু নমূনা সংগ্রহ করি।'

'এগুলো আমরা কেন্দ্রে অবস্থিত বিশেষ গবেষণা পুকুরে এক বছরের জন্য সংরক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ করি, যাতে মাছগুলো নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারে ও প্রজনন উপযোগী হয়।'

এই পর্যায়ে বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও সিনথেটিক প্রবৃত্তকারী এজেন্টগুলো যুক্ত করে এর প্রজনন দক্ষতা, যেমন এর উর্বরতা, ডিম্বস্ফোটন ও অন্যান্য বিষয়গুলো পরীক্ষা করা হয়।

এভাবে স্ত্রী মাছের শরীরে সিনথেটিক হরমোন ইনজেক্ট করা হয় | ছবি: সংগৃহীত

প্রজনন মৌসুম অর্থাৎ জুলাই-আগস্টে বয়ঃপ্রাপ্ত নমুনা মাছগুলোকে গবেষণা পুকুর থেকে এনে হ্যাচারির কংক্রিট ট্যাংকে রেখে কিছু সময় মৃদু পানিপ্রবাহ দেওয়া হয়। তারপর সিনথেটিক হরমোন ইনজেকশন পুশ করা হয়। ইনজেকশন পুশ করার আট থেকে ১০ ঘণ্টা পর স্ত্রী মাছগুলো ডিম ছাড়ে এবং পুরুষ মাছগুলো সেগুলোকে নিষিক্ত করে। অন্যান্য প্রক্রিয়া সম্পাদন করার পর ডিম থেকে পোনা মাছ উৎপন্ন হয়। সেগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে ডিমের কুসুম ও গরম পানির মিশ্রণ খাওয়ানো হয়। প্রায় ছয়-সাত ঘণ্টা পর সেগুলো নার্সারিতে স্থানান্তরিত করা হয়।

পোনাগুলো সেখানে ৪৫ থেকে ৬০ দিন থাকার পর পাঁচ-ছয় সেন্টিমিটার লম্বা হয়। সর্বশেষ সেগুলো পুকুরে ছেড়ে দেওয়া হয় যেখানে চূড়ান্তভাবে ৬৫-৭০ শতাংশ পোনা বেঁচে থাকতে পারে।

গবেষণাটি পাঁচজন বৈজ্ঞানিক পরিচালনা করেন, যার নেতৃত্বে ছিলেন আজহার আলী। অন্যরা হলেন—জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সোনিয়া শারমিন ও মালিহা হোসেন মৌ এবং দুজন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শ্রীবাস কুমার সাহা ও মো. আবু নাসের।

আজহার আলী বলেন, 'কৃত্রিমভাবে প্রজননকৃত এই পোনা মাছগুলোকে আমরা একটি নির্দিষ্ট সময় পর সারা দেশে ছড়িয়ে দেবো, যাতে বেসরকারি ও সরকারি হ্যাচারিগুলেতে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হতে পারে।'

বিপন্ন নেটিভ ট্যাংরা প্রজাতির কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদনের কৃতিত্বের জন্য ২০১৭ সালে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল বিএফআরআই সৈয়দপুর স্বাদু পানি উপকেন্দ্র।

Comments

The Daily Star  | English
Aminul Islam Bulbul new BCB president

Bulbul 'agrees' to take over BCB president's post

Aminul Islam Bulbul is coming to the Bangladesh Cricket Board as its president, the former national team captain himself confirmed to The Daily Star.

1h ago