বরগুনা ডেঙ্গুর হটস্পট হয়ে ওঠার কারণ কী

ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত বরগুনা কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ওমর আল আরাবিকে (৯) ঈদের দিন প্রথমে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে তাকে নেওয়া হয় বরিশালের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে।
সেখানেও অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় আরাবিকে আনা হয়েছে রাজধানী ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে। বর্তমানে সে এই হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন।
আরাবির বাবা আবুল কালাম আজাদ বরগুনা শহরের একজন তরুণ ব্যবসায়ী। তাদের বসবাস শহরের খামারবাড়ি সড়ক এলাকায়।
বরগুনা জেলা; বিশেষ করে বরগুনা পৌর শহর এখন ডেঙ্গুর হটস্পট। এই শহরের ঘরে ঘরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এই জেলার গ্রামাঞ্চলেও ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুসারে, এ পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ৫ হাজার ১৫ জনের ভেতর কেবল বরগুনা জেলাতেই আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ২০৪ জন। অর্থাৎ মোট আক্রান্তের ২৪ শতাংশ এ জেলার।
এর ভেতর মঙ্গলবার সকাল থেকে গতকাল বুধবার ৮টা পর্যন্ত সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ২৮৮ জন ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর ভেতর ২০২ জনই বরগুনা জেলার।
এর আগে গত ৬ জুন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বরগুনার প্রয়াত সংসদ সদস্য জাফরুল হাসান ফরহাদের ছোট মেয়ে আজমেরী মোনালিসা জেরিন (২৭) মারা যান। তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও উদ্যোক্তা ছিলেন।
বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী এ জেলায় কেন ডেঙ্গু পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ রূপ ধারণ করল—তা নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার চিকিৎসক ও জেলা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গেও কথা বলেছে। তাদের ভাষ্য, মশার উপদ্রব কমাতে পৌরসভার পক্ষ থেকে তেমন কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। যতটুকু নেওয়া হয়েছে তাও অপ্রতুল। এছাড়া জলাবদ্ধতা, অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও নাগরিকদের অসচেতনতাও এমন পরিস্থিতির জন্য দায়ী।
বিষয়টি নিয়ে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের নবনিযুক্ত তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. রেজয়ানুল আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। এখানকার বেশিরভাগ বাসা-বাড়ির আশপাশে ছোট ছোট ডোবার সংখ্যা বেশি। নাগরিকদের ভেতর মশারি ব্যবহার না করার প্রবণতাও আছে।'
এই চিকিৎসক আরও বলেন, 'হাসপাতাল এলাকার ড্রেনগুলোও দীর্ঘদিন পরিষ্কার করা হয়নি। চলতি সপ্তাহে পৌর প্রশাসন ও স্থানীয়দের সহযোগিতায় ড্রেনগুলো পরিষ্কার করা হয়েছে। মশা মারতে পৌর প্রশাসনের পক্ষ থেকে যে ওষুধ ছিটানো হয় তার পরিমাণও কম বলে মনে হয়েছে।'
এ ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) বরগুনা শাখার সভাপতি ও বরগুনার নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. কামাল হোসেনের বক্তব্য, বরগুনার অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও ব্যাপক জলাবদ্ধতার কারণে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। অল্প বৃষ্টিতেই এখানকার বেশিরভাগ রাস্তাঘাট তলিয়ে যায়। পানি আটকে থাকে।
এর বাইরে ফগিংসহ মশা নিয়ন্ত্রণে পৌরসভার অন্যান্য কার্যক্রম নিয়েও প্রশ্ন তোলেন কামাল হোসেন।
প্রায় একইরকম পর্যবেক্ষণ বরগুনা বাজারের ওষুধ ব্যবসায়ী মো. সাইফুল ইসলাম ও চর কলোনী এলাকার বাসিন্দা অলিউল্লাহ এমরানের।
বরগুনার জেলা স্বাস্থ্য অধিকার ফোরামের সভাপতি হাসানুর রহমান ঝন্টু বলছেন, বরগুনা শহর ও গ্রামাঞ্চলে ছোট-খাট ঝোপঝাড় বেশি। নাগরিকদের ভেতর যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলার প্রবণতাও প্রবল।
তবে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে পৌরসভার আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই বলে দাবি করেন বরগুনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ও পৌর প্রশাসক অনিমেষ বিশ্বাস।
তিনি বলেন, 'দেশের অন্যান্য সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় মশা নিধনে যে ওষুধ ছিটানো হয় আমরাও একই ওষুধ ছিটাচ্ছি। পৌরসভার পাঁচটি ও জেলা প্রশাসন থেকে পাওয়া আর দুটি ফগার মেশিন দিয়ে পৌর এলাকার সর্বত্র সকাল থেকে রাত অবধি নিয়মিত ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। নাগরিকদের সচেতনতা বৃদ্ধিতে লিফলেট বিতরণ ও মাইকিং করা হচ্ছে। জলাবদ্ধতা নিরসনেও পৌরসভা নিরলসভাবে কাজ করছে।'
Comments