বছরে ৫০ লাখ মৃত্যুর কারণ ‘অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স’, সমাধান কী?
আমাদের চারপাশে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, পরজীবী এবং ছত্রাকসহ নানা অণুজীব ছড়িয়ে রয়েছে, যা আমাদের শরীরে বসবাস করে ও আমাদের শরীর থেকে পুষ্টি নেয়।
আমরা হজমশক্তি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং অত্যাবশ্যক পুষ্টিকণা তৈরির জন্য এই অণুজীবদের ওপর নির্ভর করি। এমনকি কৃষি ও শিল্প প্রক্রিয়ার জন্যও আমরা কিছু অণুজীবের ওপর নির্ভরশীল।
অন্যদিকে, কিছু অণুজীব মানুষ, গবাদিপশু ও গাছপালার রোগের কারণ হতে পারে। এই রোগ মোকাবিলার জন্য বিজ্ঞানীরা ওষুধ (অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল) তৈরি করেছেন, যা তাদের বিস্তার রোধ করতে ও কমিয়ে দিতে পারে।
সময়ের সঙ্গে এই অণুজীবগুলো এসব অ্যান্টি মাইক্রোবিয়ালের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এমনকি কিছু অণুজীব 'সুপারবাগ' হয়ে ওঠে। যার ফলে এদেরকে আর ওষুধ দিয়ে প্রতিরোধ করা যায় না। ফলস্বরূপ আমরা হাসপাতাল ও লোকালয়ে অধিক হারে এমন সংক্রমণের সাক্ষী হচ্ছি, যার চিকিৎসা করা সম্ভব হচ্ছে না।
এই ঘটনাটি, যা সাধারণ ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগগুলোকে প্রাণঘাতী করে তোলার সম্ভাবনা রাখে, তা 'অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স' (এএমআর) নামে পরিচিত।
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের কারণে প্রায় ৫০ লাখ মৃত্যু ঘটে, যা এইচআইভি-এইডস এবং ম্যালেরিয়াজনিত সর্বমোট মৃত্যুর চেয়েও বেশি।
পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে ওষুধ প্রতিরোধী সংক্রমণের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বছরে ১ কোটিতে পৌঁছতে পারে, যা বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর প্রধান কারণকে—ক্যানসার—ছাড়িয়ে যাবে।
বিশ্ব অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স সচেতনতা সপ্তাহের উদ্দেশ্য হলো, এই নীরব ঘাতক সম্পর্কে জ্ঞান এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
স্বল্প-আয়ের জনগোষ্ঠীকে ভুলে যাওয়া যাবে না
অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের বিরুদ্ধে বৈশ্বিকভাবে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে উচ্চআয়ের দেশগুলোর ক্ষেত্রে যে সমাধান প্রযোজ্য, তা স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থায় উপযুক্ত নাও হতে পারে।
ন্যায্য ও সার্বজনীন পদ্ধতিতে এই সমস্যাগুলো মোকাবিলা করার জন্য ব্রিটিশ একাডেমি বিভিন্ন পেশাজীবীদের—যেমন: যোগাযোগ, মহামারিবিদ্যা, ন্যায়নীতি এবং মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ—সম্মিলিত দক্ষতার সমন্বয়ে একটি বৈশ্বিক আহ্বায়ক কর্মসূচি গ্রহণ করছে।
আমরা যদি অ্যান্টিবায়োটিকের ওপর মানুষের নির্ভরতা কমাতে চাই, তবে আমাদের অবশ্যই অ্যান্টিবায়োটিক নির্ভরতা তৈরির জন্য যে কারণগুলো দায়ী, সেগুলোকে মোকাবিলা করতে হবে।
অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স একটি বিশ্বব্যাপী সমস্যা হলেও অঞ্চলভেদে এ সমস্যার রয়েছে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য। সাব-সাহারান আফ্রিকায় অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের কারণে বেশিরভাগ মানুষের মৃত্যু ঘটে, যেখানে ম্যালেরিয়া ও যক্ষ্মা রোগের ওষুধের বিপরীতে গড়ে ওঠা প্রতিরোধ একটি উদ্বেগপূর্ণ সমস্যা হয়ে উঠছে।
স্বল্পআয়ের পরিস্থিতিতে সস্তা অ্যান্টি মাইক্রোবিয়ালগুলো প্রায়ই ব্যবহার করা হয়, যা নিম্নমানের এমনকি নকলও হতে পারে। এটি বরং ওষুধ প্রতিরোধ গড়ে ওঠার জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করে। অনেক ক্ষেত্রেই এই অ্যান্টি মাইক্রোবিয়ালগুলো ওষুধের দোকানে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই রোগীর চাহিদা অনুযায়ী বিক্রি হয়।
গবাদিপশুর ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার ও মহামারির ঝুঁকি
অ্যান্টিবায়োটিক হলো সর্বাধিক ব্যবহৃত অণুজীবপ্রতিরোধক। ২০০০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার ৬৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বব্যাপী মানুষের তুলনায় গবাদিপশু ও কৃষিতে বেশি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়।
অ্যান্টি মাইক্রোবিয়ালগুলোর মধ্যে ৭৩ শতাংশ গবাদিপশুর জন্য ব্যবহার করা হয়। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল, যা গবাদিপশুদের মধ্যে অ্যান্টি মাইক্রোবিয়ালের অযৌক্তিক ব্যবহারকে এ ধরণের ওষুধ প্রতিরোধের ক্রমবর্ধমান সমস্যার গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
গবাদিপশুর রোগের প্রাদুর্ভাব রোধ করতে এবং উৎপাদন বাড়ানোর জন্য পশুপালনকারীরা অ্যান্টিবায়োটিকের ওপর নির্ভর করে—বিশেষ করে এমন পরিস্থিতিতে, যেখানে পশুগুলোকে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রাখা হয় এবং যেখানে পশুপালনকারীদের পশুচিকিত্সা করানোর উপায় নেই। এ ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকগুলো 'দ্রুত সমাধান' হিসেবে কাজ করে।
উগান্ডার গ্রামীণ পরিবেশে পরিচালিত একটি গবেষণায় একজন নারী গবেষকদের জানিয়েছেন, তিনি তার পরিবারের সদস্য এবং মুরগির চিকিৎসার জন্য তার ঘরে থাকা আগের বেঁচে যাওয়া অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করছেন। অ্যান্টিবায়োটিক পুনঃব্যবহারের এই বিষয়টিকে তাদের নিজেদের বেঁচে থাকা এবং গবাদিপশুদের জন্য ব্যবহারের মাধ্যমে জীবিকা নিশ্চিত করার উপায় হিসেবে দেখা হয়।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে খামারের গবাদিপশুদের মধ্যে অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল প্রতিরোধের বিষয়টি যদি নজরদারি করা না হয়, তাহলে পরবর্তীতে তা মহামারির রূপ নিতে পারে।
সবাই, সবখানে ঝুঁকির মধ্যে
অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল অবশিষ্টাংশ মাটি থেকে নদীতে এবং সেখান থেকে স্রোতের মাধ্যমে ছড়িয়ে পরিবেশ দূষণ করে। সেইসঙ্গে খাদ্য ও পানিকে দূষিত করে এবং ওষুধ প্রতিরোধ অবস্থার সৃষ্টি করে।
এর ফলে, যারা এই ওষুধ সেবন করেন না, তারাও এর ঝুঁকিতে থাকেন। অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল ওষুধ যথাযথভাবে ব্যবহার করা না হলে এই ধরনের দূষণ আরও বেড়ে যায়।
বিশ্বব্যাপী সার্বজনীন ন্যায্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স মোকাবিলায় অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্থায়ী নতুন পদ্ধতি গ্রহণ করা জরুরি। সেক্ষেত্রে আগে থেকে ঠিক করা সমাধানের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে সংশ্লিষ্ট সবার এবং জনসাধারণের মতামতের ভিত্তিতে বিকল্প সমাধানগুলো বিবেচনা করা উচিত।
সংক্রমণপ্রবণ এলাকা, বিশেষত যেখানে স্বাস্থ্যসেবা অপর্যাপ্ত, সেসব এলাকার জন্য 'সহজ' সমাধানগুলো বাস্তবায়ন করা কষ্টসাধ্য হতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি নিষিদ্ধ করা অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার রোধ করতে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু এটা যেসব এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা অপর্যাপ্ত এবং যাদের কাছে কোনো বিকল্প উপায় নেই, তাদেরকে জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করতে পারে। একইভাবে, অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া গবাদিপশুপালনকারীদের জীবিকা নির্বাহ করা কষ্টসাধ্য হবে।
মানুষ এবং তাদের ঐতিহ্যকে সম্মান করে ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাধান মানুষের স্বাস্থ্য, গবাদি পশু ও প্রাকৃতিক পরিবেশের উপকার করবে।
সূত্র:
'Joubert, M., 'Cheah, P. Y., & 'Lewycka, S. (2023, November 17). Antimicrobial resistance is a silent killer that leads to 5 million deaths a year. Solutions must include the poor. The Conversation. https://theconversation.com/antimicrobial-resistance-is-a-silent-killer-that-leads-to-5-million-deaths-a-year-solutions-must-include-the-poor-217693
অনুবাদ: লামিসা রহমান, সেন্টার অব এক্সিলেন্স ফর হেলথ সিস্টেম অ্যান্ড ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ, ব্র্যাক জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি
Comments