ডেঙ্গু প্রতিরোধে নতুন প্রজন্মের ভ্যাকসিন

২০১৯ সালের পরে এ বছর আবার ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ডেঙ্গুজ্বর এখন আর শুধু ঢাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, ঢাকার বাইরেও তা ছড়িয়ে পড়েছে। ডেঙ্গুজ্বরের প্রাদুর্ভাব এখন প্রতি বছরই দেখা দিচ্ছে এবং প্রতিবারই মারাত্মক আকার ধারণ করছে। প্রাথমিক প্রতিরোধক ব্যবস্থা হিসেবে স্প্রে দিয়ে মশা নিধন তেমন কোনো কাজেই আসছে না। বরং এডিস মশা তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন আনছে এবং কামড়াচ্ছে দিন বা রাত যেকোনো সময়। সরকারের উচিত মশা নিধনের আধুনিক পদ্ধতি প্রয়োগ করা। যেমন: জেনেটিক পদ্ধতিতে মশা বন্ধ্যাত্বকরণ পদ্ধতি প্রয়োগ করা যেতে পারে।

তবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হচ্ছে ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করা। ডেঙ্গুজ্বরের কোনো নির্দিষ্ট  চিকিৎসা নেই, নেই কোনো অ্যান্টিভাইরাল ওষুধও। ভ্যাকসিনই ডেঙ্গু প্রতিরোধের একমাত্র কার্যকরী ব্যবস্থা। সম্প্রতি জাপানের টাকেডা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ডেঙ্গুর নতুন জেনারেশনের ভ্যাকসিন কিউডেঙ্গা (টিএকে-০০৩) তৈরি করেছে, যা ডেঙ্গু প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকরী ও নিরাপদ। কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিন সম্প্রতি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডে জনসাধারণের ওপর প্রয়োগের অনুমতি পেয়েছে।

এর আগে সানোফির তৈরি সর্বপ্রথম ডেঙ্গু ভ্যাকসিন ডেংভ্যাক্সিয়া বাজারে এলেও কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে তা নিয়ে জনমনে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। উপরন্তু যারা পূর্বে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়নি (সেরোনেগেটিভ), তাদের জন্য এই ভ্যাকসিনটি নিরাপদ নয়। এ ছাড়াও ৯ বছরের কম বয়সী শিশুরা এই ভ্যাকসিনের উপযুক্তও নয়। কম বয়সী শিশু ও যাদের পূর্বে ডেঙ্গু হয়নি তাদের এই ভ্যাকসিন দিলে বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে মারাত্মক ডেঙ্গু হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়—এটা এক ধরনের ভ্যাকসিনজনিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, যা অ্যান্টিবডি-ডিপেন্ডেন্ট এনহ্যান্সমেন্ট নামে পরিচিত।

সানোফির ডেঙ্গু ভ্যাকসিনটি তৈরি করা হয়েছে ইয়োলো ফিভার ভাইরাসের ভেতরে ডেঙ্গু ভাইরাসের এনভেলপ ও মেমব্রেন প্রোটিনের জিন প্রবেশ করিয়ে। এই ভ্যাকসিন প্রয়োগে শরীরে প্রধানত হিউমোরাল বা অ্যান্টিবডি সমৃদ্ধ ইমিউনিটি তৈরি হয়। কিন্তু সেল-মেডিয়েটেড ইমিউনিটি তৈরি হয় না। ফলে এই ভ্যাকসিন দিলে শরীরে ডেঙ্গু ভাইরাসের বিরুদ্ধে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, তা সংক্রমণের পরে ভাইরাসের রিপ্লিকেশন বা বংশবৃদ্ধি বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। সেই কারণে সংক্রমণের তীব্রতা বেড়ে যায়। এ ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যেকোনো নতুন ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেই দেখা দিতে পারে। সানোফির ভ্যাকসিনটির ফেইজ-৩ ট্রায়াল করা হয়েছিল এক বছর ধরে। তাই এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াটি ট্রায়ালের সময় ধরা পড়েনি।

এসব সমস্যা বিবেচনায় রেখে টাকেডার নতুন কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিনটির ১৯টি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করা হয়েছে সাড়ে ৪ বছর ধরে ২৮ হাজার শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক স্বেচ্ছাসেবকের ওপর। কোনো ট্রায়ালেই সানোফির ভ্যাকসিনের মতো অ্যান্টিবডি-ডিপেন্ডেন্ট এনহ্যান্সমেন্ট বা মারাত্মক কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়নি। এর মূল কারণ হচ্ছে ভ্যাকসিনটির ডিজাইন। কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিনটি তৈরি করা হয়েছে ডেঙ্গু ভাইরাসের সেরোটাইপ-২ স্ট্রেইন ব্যবহার করে। এটি একটি লাইভ অ্যাটিনিউয়েটেড ভ্যাকসিন, যার ভেতরে ডেঙ্গু ভাইরাসের ৪টি সেরোটাইপ বা স্ট্রেইনের জিন প্রবেশ করানো হয়েছে, যেখানে স্ট্রাকচারাল প্রোটিন ছাড়াও রয়েছে ভাইরাসের নন-স্ট্রাকচারাল প্রোটিন। আর এর ফলেই এই টেট্রাভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন প্রয়োগে শরীরে তৈরি হয় অ্যান্টিবডি এবং সেল-মেডিয়েটেড ইমিউনিটি। এর ফলেই সম্ভবত এই ভ্যাকসিনে সানোফির ভ্যাকসিনের মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় না। পূর্বে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত (সেরোপজিটিভ) অথবা অনাক্রান্ত (সেরোনেগেটিভ) ৪ বছরের শিশু থেকে শুরু করে যেকোনো বয়সের মানুষ কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিন নিতে পারবে।

দুই ডোজের কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিন ডেঙ্গুজ্বর থেকে সুরক্ষা দেয় ৮০ দশমিক ২ শতাংশ এবং ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোধ করে ৯০ দশমিক ৪ শতাংশ। ভ্যাকসিনের এই কার্যকারিতা বজায় থাকে ১৮ মাস পর্যন্ত। ভ্যাকসিনের সুরক্ষা নির্ভর করে কোন সেরোটাইপের ডেঙ্গু ভাইরাস দিয়ে ডেঙ্গুজ্বর হয়েছে তার ওপর। যেমন: ডেঙ্গু সেরোটাইপ-১ ও সেরোটাইপ-২ এর সংক্রমণ প্রতিরোধে এই ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা যথাক্রমে ৭০ ও ৯৫ শতাংশ। তবে ডেঙ্গু সেরোটাইপ-৩ সংক্রমণ প্রতিরোধে এর কার্যকারিতা মাত্র ৪৯ শতাংশ। অর্থাৎ কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিন ডেঙ্গু সেরোটাইপ-৩ এর বিরুদ্ধে তেমন কার্যকর না।

তবে যারা পূর্বে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে ডেঙ্গু সেরোটাইপ-৩ এর বিরুদ্ধে এই ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা ৭৪ শতাংশ, যা বজায় থাকে প্রায় ৫৪ মাস। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এই ভ্যাকসিনটি সিভিয়ার ডেঙ্গু ও হেমোরেজিক ডেঙ্গু থেকে সাড়ে ৪ বছরের জন্য সুরক্ষা দেয় ৭০ শতাংশ, তা যে সেরোটাইপ দিয়েই সংক্রমণ হোক না কেন। বাংলাদেশের সরকারি নিয়ম অনুযায়ী যদি কোনো ভ্যাকসিন কমপক্ষে ৪ বছর সুরক্ষা দেয়, তাহলে সেই ভ্যাকসিন জনসাধারণের ওপর প্রয়োগের জন্য সংগ্রহ করা যাবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৩৫ হাজার ২৭০ জন। কিন্তু এই সংখ্যাটি শুধুমাত্র যারা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, তাদের সংখ্যা। প্রকৃত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা এর চেয়েও অনেক বেশি হওয়ার কথা। ডেঙ্গু জ্বর সাধারণত সেলফ-লিমিটিং রোগ, অর্থাৎ ৫ থেকে ৭ দিনের ভেতর আপনা-আপনি ভালো হয়ে যায়। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দরকার পড়ে না। ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত দশমিক ৫ থেকে ৫ শতাংশ সিভিয়ার ডেঙ্গুর আকার ধারণ করে, যার চিকিৎসা শুধুমাত্র হাসপাতালেই করা সম্ভব। সিভিয়ার ডেঙ্গু ভয়াবহ, যা থেকে মৃত্যুহার প্রায় আড়াই থেকে ৫ শতাংশ। তবে সঠিক চিকিৎসা না হলে ৫০ শতাংশ রোগী মারা যেতে পারে।

সরকারি তথ্যমতে, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৩৫ হাজারেরও বেশি রোগীর মধ্যে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ১৮৫ জন। সিভিয়ার ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার ৫ শতাংশ ধরে হিসাব করলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া আনুমানিক ১১ শতাংশ রোগীই সিভিয়ার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার কথা। এই সংখ্যাটি স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ। কেন এমনটা হচ্ছে, তার সঠিক কারণ খুঁজে বের করা জরুরি।

৪ ধরনের ডেঙ্গু ভাইরাসে এই রোগে আক্রান্তের সম্ভাবনা থাকে। ভাইরাসের এই ধরনগুলো ডেঙ্গু ভাইরাস সেরোটাইপ-১, ২, ৩ ও ৪ নামে পরিচিত। কেউ যদি এক ধরনের সেরোটাইপে আক্রান্ত হওয়ার পর ১৮ মাসের ভেতরে ডেঙ্গুর ভিন্ন আরেকটি সেরোটাইপে আক্রান্ত হয়, তাহলে তাদের সিভিয়ার ডেঙ্গু হতে পারে। বাংলাদেশে এ বছর ভাইরাসের কোন সেরোটাইপটি প্রধানত সংক্রমণ ছড়াচ্ছে এবং বিগত বছরগুলোতে কোন সেরেটাইপ বিদ্যমান ছিল, তা জানা গেলে এ বছর সিভিয়ার ডেঙ্গুজ্বর সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে। এ তথ্য ডেঙ্গু ভ্যাকসিন প্রয়োগের ক্ষেত্রেও দরকার হবে।

২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গুজ্বর দেশের একটি প্রধান সিজনাল এনডেমিক রোগ হিসেবে রয়েছে। প্রতি বছর এই জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে নগর অঞ্চলের হাজারো মানুষ এবং মারাও যাচ্ছে কয়েক শ। ডেঙ্গুজ্বর প্রতিরোধে প্রধান হাতিয়ার হতে পারে ভ্যাকসিন। ডেঙ্গুর কার্যকর ও নিরাপদ ভ্যাকসিন এখন হাতের নাগালে। সরকারের উচিত ডেঙ্গু ভাইরাস দমনে এই ভ্যাকসিন প্রয়োগে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া এবং যত দ্রুত এই উদ্যোগ নেওয়া হবে, ততই মঙ্গল।

ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম: এমবিবিএস, এমএসসি, পিএইচডি; সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, লেস্টার ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য

Comments

The Daily Star  | English

Polythene ban: A litmus test for will and eco-innovation

Although Bangladesh became the first country in the world to announce a complete ban on the use of polythene bags in 2002, strict enforcement of the much-lauded initiative has only started taking shape recently.

14h ago