সারাদেশের চেয়ে শুধু রোহিঙ্গা ক্যাম্পেই ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি

সতর্কতা সত্ত্বেও ‘কার্যকর উদ্যোগ’ নেয়নি কক্সবাজার প্রশাসন

দেশে এ বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৩৯ জন। তাদের মধ্যে ১৭ জনই কক্সবাজার জেলার। বাকিদের মধ্যে ঢাকায় ১৭ জন, বরিশালে ৪ জন ও চট্টগ্রামে ১ জন মারা গেছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে গতকাল বুধবার পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছেন মোট ৯ হাজার ৮৩৭ জন। তাদের মধ্যে রাজধানীতে আক্রান্ত হয়েছেন ৭ হাজার ৮০১ জন এবং রাজধানীর বাইরে রোগীদের মধ্যে কক্সবাজার জেলায় সবচেয়ে বেশি ৮৯৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন। তারা সবাই বাংলাদেশি নাগরিক।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডেঙ্গুর তথ্য দেওয়া হয় না। তবে, কক্সবাজার সিভিল সার্জন সূত্রে জানা গেছে, এ বছরে শুধু কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এখন পর্যন্ত ১২ হাজার ৪১৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। আর মারা গেছেন ২৪ রোহিঙ্গা।

কক্সবাজারে যে এবার ডেঙ্গু রোগী বাড়তে পারে, আগে থেকেই সেই ধারণা দিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা। চলতি বছরের মে মাসে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও এর আশেপাশের এলাকায় মশা নিয়ে একটি জরিপ করা হয়। সেই দলে ছিলেন কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার।

অধ্যাপক কবিরুল বাশার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মে মাসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জরিপ করে অস্বাভাবিকভাবে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার উপস্থিতি পাই। আমরা তখন বলেছিলাম যে কক্সবাজারে ডেঙ্গু মহামারি আকার ধারণ করতে পারে। কক্সবাজারের রোগীর যে চিত্র পাই, এই সংখ্যাটি আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।'

এডিস মশা নিধনে কক্সবাজারে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই জানিয়ে এই কীটতত্ত্ববিদ বলেন, 'এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রীয়ভাবে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা থাকতে হবে। না হলে এভাবে একটির পর একটি জেলা ডেঙ্গুর হটস্পট হতে থাকবে।'

কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, 'এ বছর কক্সবাজারে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে পারে, এই তথ্যটি আমাদের আগেই জানা ছিল। যারা মশা নিধন করবে, তাদেরকে অনেক আগেই বিষয়টি জানিয়েছি। আমাদের যে জেলার মাসিক মিটিংগুলো হয়, সেখানেও এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি।'

'যারা ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, তাদের অধিকাংশই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। তাদের অনেকেই ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিতে চান না। কবিরাজি চিকিৎসায় বিশ্বাসী তারা। পরিস্থিতি একবারই খারাপ হলে তারপর ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। তাই এখানে মৃত্যুর সংখ্যা একটু বেশি', বলেন তিনি।

কক্সবাজার সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. শাহ ফাহিম আহমেদ ফয়সাল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একটি জলাশয় ছিল। সেখান থেকেই মূলত ডেঙ্গুর ভেক্টর বেশি ছড়িয়েছে। প্রথমে একটি ক্যাম্পে, এরপর আশেপাশের ক্যাম্পে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে। তা ছাড়া বিভিন্ন জেলা থেকে, বিশেষ করে ঢাকা থেকে অনেকেই কক্সবাজারে ঘুরতে যায়। তাদের মাধ্যমেও এখানে ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটতে পারে।'

ডেঙ্গু প্রতিরোধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, জানতে চাইলে তিনি শুধু প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থার কথাই জানান। কিন্তু এডিস মশা নিধনে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, লার্ভি সাইট ও অ্যাডাল্টি সাইট করা হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে তিনি কোনো তথ্য দিতে পারেননি। তবে, ২ সপ্তাহ ধরে ড্রেন পরিষ্কারে পৌরসভার তৎপরতা বেড়েছে বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, 'রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবশ্যই যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে আমি মনে করি। তবে এই উদ্যোগগুলো আরও আগে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল।'

কক্সবাজারের নাগরিক ফোরামের সভাপতি আ ন ম হেলাল উদ্দিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পৌরসভার অব্যবস্থাপনার কারণে মূলত কক্সবাজারে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। মশা নিধনে পৌরসভার দৃশ্যমান কোনো কাজ আমরা দেখিনি। তারা মাঝেমধ্যে ফগিং করে। তাও সব জায়গায় করে না। এক জায়গায় ফগিং করলে মশা উড়ে অন্য জায়গায় চলে যায়। আবার চলে আসে। এভাবেই মশা বাড়ছে। মশা নিধনে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আমরা কক্সবাজারবাসী নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত।'

কক্সবাজার পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা একেএম তারিকুল আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আমরা মাইকিং করি, লিফলেট বিতরণ করি ও ফগিং করি। যেসব এলাকায় রোগী বেশি, সেসব এলাকায় নিয়মিত ফগিং করা হয় এবং যেখানে রোগী কম, সেখানে ১ দিন পর পর ফগিং করা হয়।'

সিভিল সার্জন কার্যালয় জানিয়েছে, কক্সবাজারে ৫টি এলাকায় রোগী অনেক বেশি। পৌরসভার পক্ষ থেকেও এই বিষয়টি জানানো হয়। তবে, ওই ৫টি এলাকায় শুধু ফগিং ছাড়া আর বিশেষ কোনো ব্যবস্থা বা ক্রাশপ্রোগ্রাম নেওয়া হয়নি বলে জানান পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।

এ বিষয়ে কীটতত্ত্ববিদ ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যে ৫টি এলাকা তারা শনাক্ত করতে পেরেছে, সেসব এলাকায় অনেক বেশি লার্ভিসাইটিং করতে হবে। মশার লার্ভা ধ্বংস করতে হবে। ফগিং করে সব অ্যাডাল্ট মশা মেরে ফেলতে হবে। ওই এলাকার শিশুসহ সবাইকে সবসময় মোজা এবং ফুলহাতা শার্ট ও প্যান্ট পরিয়ে রাখতে হবে। ঘুমাতে গেলে অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে। প্রত্যেকের ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে হবে এবং ওইসব এলাকা থেকে রোগী কোথায় কোথায় যাচ্ছে, তা তদারকি করতে হবে।'

এডিস মশা নিধনে কক্সবাজার পৌরসভার পক্ষ থেকে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জানতে পৌর মেয়র মুজিবুর রহমানের ফোনে ৬ বার কল করলেও তিনি ধরেননি। এসএমএস পাঠালেও তিনি উত্তর দেননি।

Comments

The Daily Star  | English

Power, Energy Sector: Arrears, subsidies weighing down govt

The interim government is struggling to pay the power bill arrears that were caused largely by “unfair” contracts signed between the previous administration and power producers, and rising international fuel prices.

7h ago