শুষ্ক মৌসুমে বিবর্ণ ‘প্রমত্তা পদ্মা’

হুমকির মুখে নদীপাড়ের জীবন-জীবিকা-পরিবেশ
শুষ্ক মৌসুমে পদ্মা
শুষ্ক মৌসুমে পাবনার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পদ্মার বিশাল অংশ এখন বালুচর। ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/স্টার

এক সময়ের প্রমত্তা পদ্মা নদীর উত্তাল ভাব এখন আর নেই। কালের বিবর্তনে বিবর্ণ হয়ে পড়েছে দেশের অন্যতম প্রধান এ নদী।

উজানে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় এখন শুষ্ক মৌসুমে পাবনার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পদ্মার বিশাল অংশ বালুচরে পরিণত হয়েছে।

এ পরিবর্তন পদ্মার সঙ্গে মিশে থাকা নদীপাড়ের মানুষের জীবন, জীবিকা আর পরিবেশকে হুমকিতে ফেলেছে।

যে নদীতে এক সময় পাল তোলা নৌকা চলতো সে নদীতে এখন নৌকা চলে সীমিত সংখ্যায়। যন্ত্রচালিত বাহনে বিশাল চর পারি দিয়ে নদীর তীরে এসে যাত্রীদের নৌকায় চড়তে হয়।

নদীর পানি কমে যাওয়ায় মাছের আকাল দেখা দেওয়ায় নদীপাড়ের মৎস্যজীবীরা এখন কর্মহীন। অনেকেই পেশা বদলাচ্ছেন।

ভারতের ফারাক্কায় বাঁধের কারণে উজানের পানির চাপ কমে যাওয়ায় গত কয়েক দশক ধরেই ধীরে ধীরে ছোট হচ্ছে এই প্রমত্তা নদীর আয়তন। এ বছর শুষ্ক মৌসুমে হঠাৎ করে পদ্মায় পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় সংকট আরও বেড়েছে।

শুষ্ক মৌসুমে পদ্মা
পানিশূন্য পদ্মার বুকে যন্ত্রচালিত বাহন। ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/স্টার

যৌথ নদী কমিশনের তথ্য অনুসারে, চলতি জানুয়ারির প্রথম ১০ দিনে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পদ্মার পানির প্রবাহ পরিমাপ করা হয় ৮৫ হাজার ৩১৬ কিউসেক। গত বছর এই সময় ওই পয়েন্টে পানির প্রবাহ পরিমাপ করা হয় ১ লাখ ১১ হাজার কিউসেক।

জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে পানি আরও কম পাওয়া যায়। যৌথ নদী কমিশনের ওয়েবসাইটে বলা হয়, জানুয়ারির দ্বিতীয় ১০ দিন হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানির প্রবাহ পরিমাপ করা হয় ৭০ হাজার ৮২৭ কিউসেক। গত বছর একই সময়ে ওই পয়েন্টে ১ লাখের বেশি কিউসেক পানি পরিমাপ করা হয়।

পানি পরিমাপক দপ্তর, হাইড্রলজি পাবনা বিভাগীয় কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '১৯৯৬ সালের গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি অনুযায়ী প্রতি বছরের মতো এ বছরও ভারত ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল বছরের প্রথম দিন থেকে পানি পরিমাপ করছে।'

জাহিদুল ইসলাম জানান, এ বছর ফারাক্কা পয়েন্টে পানির প্রবাহ অনেক কম থাকায়, গত বছরের তুলনায় এ বছর শুরু থেকেই হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পদ্মার পানি প্রায় ৩০ হাজার কিউসেক কম প্রবাহিত হচ্ছে।

তার দাবি, 'গত বছরের তুলনায় কম পানি প্রবাহিত হলেও চুক্তি অনুযায়ী ঠিকমতোই পানি পেয়েছে বাংলাদেশ।'

সরেজমিনে দেখা গেছে, পদ্মায় পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় এ বছর শুরু থেকেই নদীর বেশ কয়েকটি অংশ শুকিয়ে গেছে। মাইলের পর মাইল ধূ ধূ বালুচর।

পাবনা ও কুষ্টিয়ার সীমান্তবর্তী শিলাইদহঘাট এলাকায় দেখা গেছে, প্রায় সাড়ে ৫ কিলোমিটার প্রশস্ত নদীর ৪ কিলোমিটার এলাকা যন্ত্রচালিত বাহনে পারি দিয়ে যাত্রীদের নৌকায় চড়তে হচ্ছে।

শুষ্ক মৌসুমে পদ্মা
যন্ত্রচালিত বাহনে চড়ে এক সময়ের প্রমত্তা পদ্মার বিস্তৃর্ণ অংশ পাড়ি দিতে হচ্ছে। ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/স্টার

প্রমত্তা পদ্মার বুকে বিস্তৃর্ণ বালুচর সাইকেল, মোটরসাইকেল, ভ্যান, অটোরিকশা, হিউম্যান হলারসহ নানান রকম যানবাহনে পার হয়ে নদীর তীরে নৌকায় আসতে হচ্ছে। এতে সময় ও খরচ গুণতে হচ্ছে অনেক বেশি।

নদীর তীরবর্তী পাবনা সদর উপজেলার গঙ্গাধরদিয়ার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাসুদ রানা ডেইলি স্টারকে বলেন, '১২ বছর আগে যখন এ স্কুলে যোগ দিই তখনো শুষ্ক মৌসুমে নদীর অনেকখানি চর পারি দিতে হয়েছে। তখন ২ দফায় নৌকা চড়ে নদী পারি দিতে হচ্ছে।'

তিনি জানান, ক্রমেই নদীর গতিপথ বদলেছে। এখন পুরো নদীর প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকায় চর। প্রতিদিন বালুময় পথ মোটরসাইকেলে এসে তারপর নৌকায় উঠতে হচ্ছে। তার ঠিক সময়ে স্কুলে পৌঁছাতে অনেক সমস্যা হয়।

ওই স্কুলের অপর শিক্ষক নদীপাড়ের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নদী শুকিয়ে যাওয়ায় চরগুলো এখন মাটি ও বালু ব্যবসায়ীদের দখলে। অপরিকল্পিতভাবে মাটি-বালু কেটে নেওয়ায় চরের নানান অংশে বড় বড় গর্ত হয়েছে। ফলে বর্ষায় নদীভাঙনের আশংকা দেখা দিয়েছে।'

মাঝি মো. মোকাদ্দেস হোসেন বলেন, 'এ বছর পানি কমে যাওয়ায় এক কিলোমিটার নদীপথ পারি দিতে এ চর ও চর ঘুরে যেতে হচ্ছে। এতে অনেক সময় লাগছে।'

পদ্মায় পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় মাছের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। সারাদিন জাল ফেলে ১-২ কেজির বেশি মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। উপার্জন না থাকায় অনেকেই পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন।

শুষ্ক মৌসুমে পদ্মা
পদ্মার চর থেকে অপরিকল্পিতভাবে মাটি-বালু তোলা হচ্ছে। ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/স্টার

পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী যুক্তিতলা এলাকার মৎস্যজীবী মো. সালাউদ্দিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এক সময় নদীতে জাল ফেলে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ কেজি মাছ পেতাম। এখন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত জাল ফেলে ১/২ কেজির বেশি মাছ পাচ্ছি না।'

'বাধ্য হয়ে অন্য কাজ করে সংসার চালাতে হচ্ছে,' যোগ করেন তিনি।

পদ্মার এমন ভয়াবহ বিপর্যয়ে হুমকিতে পড়েছে নদীপাড়ের মানুষের জীবন, জীবিকা আর প্রাকৃতিক পরিবেশ। পরিকল্পিত ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীকে প্রবাহমান করার দাবি অনেকের।

হাইড্রলজি বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাহিদুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পদ্মা আন্তর্জাতিক নদীর অংশ। এখানে পানির উৎস আমাদের হাতে নেই। প্রাকৃতিক কারণে পদ্মার যে বিপর্যয় হয়েছে তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে অপরিকল্পিত কাজকর্মে।'

তিনি আরও বলেন, 'বেশ কয়েকটি স্থানে বাঁধ দিয়ে নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি অংশে অপরিকল্পিত নির্মাণকাজ হওয়ায় নদীর ক্ষতি হয়েছে। নদীর চর থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু তুলে নদীকে বিপর্যস্ত করা হচ্ছে।'

তার মতে, পদ্মাকে বাঁচাতে সঠিক পরিকল্পনা প্রয়োজন। সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। ড্রেজিং করে নদীকে প্রবাহমান করতে হবে। নদীর ক্ষতি হয় এমন নির্মাণকাজ বন্ধ করে সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে হবে।

Comments

The Daily Star  | English

Jatiyo Party's office set on fire in Khulna

Protesters vandalised the Jatiyo Party office in Khulna's Dakbangla area last evening

1h ago