পুড়িয়ে মারা হলো শত প্রাণ

হাতিমারা চা বাগান কর্তৃপক্ষের দেওয়া আগুনে পুড়ে মরা এক মায়াহরিণ। ছবি: সংগৃহীত

হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের পাশে হাতিমারা চা বাগান কর্তৃপক্ষ তাদের ইজারা নেওয়া জমিতে বাগান সম্প্রসারণের জন্য গাছ কেটে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এই আগুনে পুড়েছে হনুমান, মায়াহরিণ, বিরল প্রজাতির কাঠবিড়ালি ও পাখিসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী।

স্থানীয় বাসিন্দা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জায়গাটি মায়া হরিণের পছন্দের জায়গা। এখানে থাকা আউলা নামের একটি গাছের ফল মায়া হরিণ খায়। এই আউলা গাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাচীণ ১৪০টি গাছ কেটে জঙ্গলে আগুন ধরিয়ে দেওয়ায় বানর, হনুমান, মায়াহরিণ, শূকরসহ নানা প্রজাতির অনেক প্রাণী আশ্রয় হারিয়েছে। অনেক প্রাণী পুড়ে মারা গেছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, যে প্রক্রিয়ায় বাগান কর্তৃপক্ষ জঙ্গল পরিষ্কার করছে, তাতে অনেক প্রাণীর মৃত্যু পরোয়ানা লেখা হয়ে গেছে। তবে এই 'নির্মম হত্যাযজ্ঞ' থামাতে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেয়নি বন বিভাগ।

আগুনে মৃত একটি হনুমান সরিয়ে নিচ্ছেন স্থানীয়রা। ছবি: সংগৃহীত

দেশের অন্যতম প্রাকৃতিক পাহাড়ি বনাঞ্চল রেমা-কালেঙ্গা হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলায় অবস্থিত। প্রায় ১ হাজার ৭৯৫ হেক্টর আয়তনের এ বনভূমি অভয়ারণ্য হিসেবে স্বীকৃত। এর পাহাড়ের সর্বোচ্চ উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬৭ মিটার।

রেমা-কালেঙ্গার বনে ৫ প্রজাতির কাঠবিড়ালির মধ্যে বিরল প্রজাতির মালায়ন বড় কাঠবিড়ালির একমাত্র বসবাস এ বনেই। ৩ প্রজাতির বানর কুলু, রেসাস আর লজ্জাবতীর দেখা মেলে এ অভয়ারণ্যে। এ বনে ১৮ প্রজাতির সরীসৃপের মধ্যে কোবরা, দুধরাজ, দাঁড়াস ও লাউডগা আছে।

এর বাইরে ১৬৭ প্রজাতির পাখির মধ্যে ভীমরাজ, টিয়া, হিল ময়না, লাল মাথা কুচকুচি, সিপাহি বুলবুল, বসন্তবাউরি, শকুন, মথুরা, বনমোরগ, প্যাঁচা, মাছরাঙা, ইগল, চিলসহ নানা জাতের পাখি দেখার সুযোগ আছে এ বনে।

এই অভয়ারণ্য ঘেঁষেই হাতিমারা চা বাগানের অবস্থান।

পুড়ে যাওয়া জঙ্গল। ছবি: সংগৃহীত

গতকাল রোববার জায়গাটি ঘুরে দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদক দেখতে পান, আগুনের ভয়ে পাখিসহ অনেক বণ্যপ্রাণী আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি করছে। কিছু কিছু আশ্রয় নিয়েছে স্থানীয়দের ঘরবাড়িতে। এদের অনেকগুলোর শরীরের বিভিন্ন অংশ পুড়ে যাওয়া।

স্থানীয়রা বলেন, আগের ২ দিনে তারা আগুনে পোড়া অনেক মৃত প্রাণী মাটিচাপা দিয়েছেন।

স্থানীয় নানু মিয়া নামের এক ব্যক্তি বলেন, 'রোববার দুপুরে আগুনে লেজ পুড়ে যাওয়া একটি বানর আমার বাড়িতে ঢুকেছিল। বোঝা যাচ্ছিল যে বানরটি খুব আতঙ্কে আছে।'

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক স্থানীয় ব্যক্তি বলেন, 'গত ৩ দিনে আমরা স্থানীয় প্রশাসন বা বন বিভাগের কোনো কর্মকর্তাকে ঘটনাস্থলে আসতে দেখিনি।'

আহত বক। ছবি: সংগৃহীত

এ বিষয়ে পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন মিতা ফাউন্ডেশনের সমন্বয়ক বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন বলেন, 'যে জমিতে হাতিমারা চা বাগান কর্তৃপক্ষ তাদের বাগান সম্প্রসারণ করছে সেটি ছিল মায়া হরিণের অভয়ারণ্য। এই হরিণ আউলা গাছের ফল খেতে ভালোবাসে। এই আউলা গাছ ছাড়াও কাটা পড়েছে আম, জাম, কাঁঠাল, তেঁতুল, বট, আমলকী, বহেরাসহ আরও অনেক গাছ।'

কেটে নেওয়া গাছগুলোর কোনো কোনোটি শত বছরের পুরোনো বলেও জানান তিনি।

হবিগঞ্জের কালেঙ্গা রেঞ্জের বন কর্মকর্তা মো. খলিলুর রহমানের ভাষ্য, তিনি নিজেও গাছ কাটা ও আগুন দেওয়ার ঘটনা দেখেছেন। তিনি বলেন, 'এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান বলেন, 'রেমা-কালেঙ্গা বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, যেখানে অনেক বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীর দেখা মেলে।'

গতকাল রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। ছবি: সংগৃহীত

জানতে চাইলে সিলেটের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, 'বন বিভাগের অনুমতি ছাড়াই এসব গাছ কাটা হচ্ছে। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য হাতিমারা চা বাগানের ব্যবস্থাপক মঈন উদ্দিনের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

আহত বকের ছানা। ছবি: সংগৃহীত

ঘটনাটিকে 'বর্বর ও জঘন্য' হিসেবে অভিহিত করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তার ভাষ্য, এটি পুরোপুরি বেআইনি একটি কাজ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

এ বিষয়ে সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. তৌফিকুল ইসলাম বলেন, 'আমি চা বাগান কর্তৃপক্ষকে গাছ কাটা বন্ধ করতে বলেছিলাম। কিন্তু শুনেছি যে তারা আবার গাছ কাটতে শুরু করেছে। আমি আমাদের কর্মকর্তাকে পাঠিয়েছি। অনুমতি ছাড়া গাছ কাটা বন্ধ না করলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

US retailers lean on suppliers to absorb tariffs

Rather than absorbing the cost or immediately passing it on to consumers, many US apparel retailers and brands have turned to their suppliers in Bangladesh, demanding they share the pain

3h ago