‘উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তুললে লুণ্ঠনের নতুন ক্ষেত্র তৈরি হবে’
আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে আনার পাশাপাশি জ্বালানি সংকট নিরসনের কারণ দেখিয়ে দেশীয় খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের যে প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার, তাতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার পরিকল্পনার কথা জানা গেছে।
গত ১৫ মার্চ বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জ্বালানি বিভাগের পরিকল্পনা হলো নতুন তিনটি কয়লা খনি—ফুলবাড়ী, দীঘিপাড়া ও খালাশপীর থেকে কয়লা উত্তোলন করা।
এর ভেতর ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা 'যেতে পারে' বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। পাশাপাশি বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির উত্তরাংশে উন্মুক্ত পদ্ধতি ব্যবহারের 'প্রস্তাব তৈরি হচ্ছে' বলেও জানান তিনি।
কিন্তু উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশে ব্যাপক বিরোধিতা এবং বিতর্ক আছে। এ পদ্ধতিতে কয়লা তুললে তা ফসলি জমি, জনবসতি, পানিসম্পদ ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে বলে সতর্ক করে আসছেন বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীরা।
২০০৬ সালে বিএনপি সরকারের আমলে ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত কয়লা খনির বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। ওই আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে স্থানীয় তিন তরুণ নিহত হওয়ার পাশাপাশি দুই শতাধিক আন্দোলনকারী আহত হন। তখন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এই আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে আন্দোলনকারীদের পক্ষ নেন।
এ দফায় উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার নতুন সরকারি উদ্যোগের বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম, তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ এবং বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সাবেক সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিমের সঙ্গে।
এ বিষয়ে অধ্যাপক শামসুল আলমের বক্তব্য হচ্ছে, 'এটা ডিসাইডেড ও সেটেলড।' অর্থাৎ প্রস্তাব কিংবা পরিকল্পনার কথা বলা হলেও উন্মুক্ত পদ্ধতি প্রয়োগের ব্যাপারে সরকার বদ্ধপরিকর। তার অভিমত, 'কয়লা উত্তোলন করার ব্যাপারে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু উন্মুক্ত পদ্ধতি হচ্ছে পুরোপুরি ডিজাস্টার। এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য।'
শামসুল আলম মনে করেন, 'কৃষিজমি হলো নবায়নযোগ্য সম্পদ। কিন্তু কয়লা তা নয়। কৃষিজমি খাদ্য জোগায়, সম্পদ তৈরি করে। উন্মুক্ত পদ্ধতি মানে হলো এই সম্পদ ধ্বংস করে, এর ভেতরের পানিসম্পদ ধ্বংস করে কয়লা তুলে আনা। এতে কৃষিজমিও আর রিকভার করা যাবে না।'
এই অধ্যাপকের ভাষ্য, 'এমন একটা সম্পদ ধ্বংস করে আমরা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে যে কয়লা উত্তোলন করব, সেটার প্রয়োজন শুধু বিনিয়োগকারীদের। তারা দ্রুত কয়লা উত্তোলন করে তাদের পুঁজি তুলে নিয়ে যাবে। এমন একটা সর্বনাশ যাতে না হয়, তার জন্য তিন তিনটা মানুষ জীবন দিয়েছিল। তার জন্য যে আন্দোলন হয়েছিল, তাতে আজকের সরকারপ্রধানেরও সমর্থন ছিল।
'অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষ কয়লা কোম্পানি জিএইচপি ফুলবাড়ীতে স্টাডি করে দেখতে পায় যে এখানে পানির স্তর, আবাদি জমি এবং ঘন জনবসতির যে প্রেক্ষাপটটা আছে, তাতে এখানে উন্মুক্ত খনি করতে গেলে যে ডিজাস্টার হবে, সেটা তাদের পক্ষে সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। তাদের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়বে। সুতরাং কাজ করতে এসেও তারা তখন চলে যায়।'
'এখন এখানে কয়লা উত্তোলন করতে হলে উন্মুক্ত না হলে বিনিয়োগ আসবে না। আর উন্মুক্ত পদ্ধতি ছাড়া কয়লা উত্তোলন করলে নিজেদের পয়সায় করতে হবে। যেটা আমরা এখন করছিও (বড়পুকুরিয়ার একাংশ)। তাতেও তো আমরা লাভ করছি। সরকার সেখান থেকে প্রচুর রেভিনিউ পাচ্ছে।'
শামসুল আলম বলেন, 'এখন উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তুললে যেসব বিনিয়োগ আসবে তার নেপথ্যে কমিশনভোগী আসবে, এজেন্ট আসবে, যৌক্তিক ব্যয়ের তুলনায় আবারও সেই অযৌক্তিক ব্যয় বাড়বে। লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বাড়িয়ে মুনাফা উঠিয়ে নেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। লুণ্ঠনের আরেকটা নতুন ক্ষেত্র তৈরি হবে। এ জন্য তো আমরা একটা শ্রেণি তৈরি করেই ফেলেছি, যারা এরকম লুণ্ঠনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার নেপথ্যে থাকে সরকারি সিদ্ধান্ত তৈরি করার মাধ্যমে।'
এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, 'এক খাত থেকে আরেক খাতে ওই লুণ্ঠনেরই সম্প্রসারণ হতে যাচ্ছে। এটাকেই আমরা উন্নয়ন বলছি। আমরা শুধু ব্যয় বাড়িয়েছি। ব্যয় বাড়িয়ে মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়েছি। জ্বালানি নিরাপত্তা দিতে পারিনি। সেই জ্বালানি নিরাপত্তার অজুহাত ধরেই কোথায় কাদের কীভাবে সর্বনাশ হবে, সেটারই আলামত আবার নতুনভাবে আসল। এই উন্মুক্ত পদ্ধতির প্রস্তাব যদি পেট্রোবাংলার সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে, জ্বালানি বিভাগের সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে, তাহলে এটা ভয়ংকর হতে যাচ্ছে।'
২০০৬ সালে উন্মুক্ত খনির বিরুদ্ধে ফুলবাড়ীতে যে আন্দোলন হয়েছিল, তার পুরোভাগে ছিলেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ এবং বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সাবেক এই সদস্যসচিব মনে করেন, যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা উত্তোলনের এই তোড়জোড় সেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রেরই আসলে দরকার ছিল না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক এই অধ্যাপকের ভাষ্য, 'এটা (কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র) একটা পরিকল্পিত বিষয় ছিল যে তারা (সরকার) কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করবে। এটা চালাতে কয়লা আমদানির কথা বলবে মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য। একটা পর্যায়ে গিয়ে আমদানি করা নিয়ে সংকট তৈরি হবে। তখন তারা কয়লা উত্তোলনের কথা বলবে। মানে পুরো জিনিসটাই একটা রোডম্যাপ হিসেবে পরিকল্পিতভাবেই এই জায়গায় এসেছে।'
আনু মুহাম্মদ বলেন, 'আমাদের কথা হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য এবং বর্তমান বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে প্রযুক্তিগত বিকাশের বর্তমান স্তরে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কয়লাখনি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না। এটা হলো একটা বাতিল হয়ে যাওয়া বিষয়। অতীতের বিষয়। বাংলাদেশের মতো জায়গায়; যেখানে ঘন জনবসতি, প্রাণবৈচিত্র্য অনেক বেশি এবং পানিসম্পদ অনেক গুরুত্বপূর্ণ, আবাদি জমি খুবই উর্বর, সেখানে কয়লাখনি কিংবা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদাহরণ সারা পৃথিবীতে কোথাও নেই। সুতরাং বাংলাদেশের জন্য এটা একেবারেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকে যাওয়াটাই ছিল একটা সর্বনাশা সিদ্ধান্ত।
'সেই সর্বনাশের ফলে যে সংকটটা তৈরি হচ্ছে, সেই সংকট সমাধানের কথা বলে সর্বনাশা ওই সিদ্ধান্ত বাতিল না করে আরেকটা সর্বনাশা সিদ্ধান্তের দিকে এগিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেটা হলো উন্মুক্ত পদ্ধতি।'
'আমি জানি না সরকার কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে কি না। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে উত্তোলনের বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার দরকার আছে।'
এ সময় ফুলবাড়ী আন্দোলনের প্রসঙ্গ তুলে এই অধ্যাপক বলেন, 'উন্মুক্ত পদ্ধতির বিরুদ্ধে ফুলবাড়ীতে ব্যাপক আন্দোলন হয়েছিল। ছয় দফা চুক্তি সই হয়েছিল তৎকালীন (বিএনপি) সরকারের সঙ্গে। সেই চুক্তিতে পরিষ্কার একটা ধারা ছিল যে, প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশের জন্য বাংলাদেশের কোথাও উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন হবে না।
'সেই চুক্তি সই করেছিল তৎকালীন বিএনপি সরকার এবং তা পূর্ণ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বিএনপি সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, "এই চুক্তির যদি পূর্ণ বাস্তবায়ন না হয়, তাহলে এর পরিণতি ভয়াবহ হবে"।'
প্রধানমন্ত্রীর ওই অঙ্গীকার অনুসারে এখন উন্মুক্ত পদ্ধতির প্রশ্নই আসতে পারে না বলেও মন্তব্য করেন আনু মুহাম্মদ। বলেন, 'পরবর্তীতেও প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন যে উন্মুক্ত খনি আমাদের কৃষি, আমাদের পানিসম্পদ ও আমাদের প্রাণ-প্রকৃতি ইত্যাদির জন্য গ্রহণযোগ্য না।'
এ ছাড়া ২০০৬ সালে একটি এবং ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি উন্মুক্ত খনির বিরুদ্ধে মত দেয় বলে জানান আনু মুহাম্মদ। বলেন, 'দুই কমিটির কোনোটিই এই উন্মুক্ত খনি প্রকল্পের বিষয়টি অনুমোদন করেনি। প্রত্যেকের রিপোর্ট থেকে যেটা এসেছে—এশিয়া এনার্জি অর্থাৎ জিসিএল তখন উন্মুক্ত খনির যে প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল, তা বাংলাদেশের জন্য আর্থিকভাবে খুবই লোকসান হবে, পরিবেশগতভাবে ধ্বংসাত্মক হবে এবং জ্বালানি নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও এটা সহায়ক হবে না। তারা এই প্রকল্পটি পুরো বাতিল করার কথা বলেছিল।
'সুতরাং বিশেষজ্ঞদের মতামত, জনগণ—যারা জীবন দিয়ে এই প্রকল্পটি ফিরিয়েছিলেন, পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার—এ সবকিছু মেলানোর পর উন্মুক্ত খনির তো কোনো প্রশ্নই আসতে পারে না।'
তিনি আরও বলেন, 'অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষ কয়লা কোম্পানি জিএইচপি ফুলবাড়ীতে স্টাডি করে দেখতে পায় যে এখানে পানির স্তর, আবাদি জমি এবং ঘন জনবসতির যে প্রেক্ষাপটটা আছে, তাতে এখানে উন্মুক্ত খনি করতে গেলে যে ডিজাস্টার হবে, সেটা তাদের পক্ষে সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। তাদের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়বে। সুতরাং কাজ করতে এসেও তারা তখন চলে যায়।'
আনু মুহাম্মদের ভাষ্য, 'জিএইচপির জায়গায় এমন একটা কোম্পানি (জিসিএম) আসছে, যাদের কোনো ধরনের গ্রহণযোগ্যতা নাই। এত বছরেও তারা পৃথিবীতে আরেকটা খনি করতে পারেনি। একেবারেই অনভিজ্ঞ। ভুঁইফোড় একটা কোম্পানি। ফুলবাড়ী কয়লা খনিতে তাদের কোনো কন্ট্রাক্টও নাই। কিন্তু তারা ফুলবাড়ীকে দেখিয়ে লন্ডনে শেয়ার ব্যবসা করছে। সুতরাং এখানে একটা হিডেন ও খুবই এভিল একটা বিষয় কাজ করছে।'
অবশ্য অধ্যাপক ম. তামিম মনে করেন, 'ফুলবাড়ী ও বড়পুকুরিয়া—এ দুটি জায়গাতেই উন্মুক্ত পদ্ধতি ব্যবহারের সুযোগ আছে। অন্য যেগুলো (কয়লাখনি) আছে, সেগুলোর গভীরতা অনেক বেশি। উন্মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম।'
ম. তামিম বলেন, 'আমি জানি না সরকার কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে কি না। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে উত্তোলনের বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার দরকার আছে।'
এই অধ্যাপক আরও বলেন, 'ফুলবাড়ী নিয়ে এশিয়া এনার্জির একটা প্রস্তাবনা ছিল। সেখানে তারা বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছিল যে কীভাবে তারা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করবে। সেটা মেনে নিয়ে সরকার কি সেই পদ্ধতিতেই এগুচ্ছে, নাকি অন্য কোনো পক্ষকে দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে আমাদের কী কী ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে সেটা দেখে নেবো, তা দেখার বিষয় আছে।'
Comments