একদিকে ঝড়ের ভয়, অন্যদিকে চুরি-আতঙ্ক
বেড়িবাঁধের ওপারেই সমুদ্র। এপারে 'নাজুক' জেলেপাড়া। এরমধ্যেই অতি প্রবল হয়ে ওঠা ঘূর্ণিঝড় যেভাবে চোখ রাঙাচ্ছে তাতে ভয় না পাওয়ার কোনো কারণ নেই জলের সঙ্গে নিত্য বসবাস করা এ মানুষগুলোর। তারপরও ঘর ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার মতো 'সাহস' করে উঠতে পারেননি অনেকে। কারণ, চুরির ভয়।
চট্টগ্রামের ইপিজেড থানার আকমল আলী ঘাট এলাকার এই জেলেপাড়ায় প্রায় দেড় হাজার পরিবারের বাস। এখানকার বাসিন্দাদের ভাষ্য, অতীতে এমন দুর্যোগে অনেকবার আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ফিরে এসে দেখেছেন ঘরে কিছুই নেই। সব চুরি হয়ে গেছে। তাই এবার দমকা বাতাস না ওঠা পর্যন্ত তাদের অনেকে ঘর পাহারায় আছেন। বাতাস উঠলে 'বিপদ বুঝে' আশ্রকেন্দ্রের দিকে রওনা হবেন তারা।
ঘূর্ণিঝড় 'মোখা' থেকে বাঁচতে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যাওয়ার জন্য রেডিক্রিসেন্টের সদস্যরা যখন আজ দুপুর ১২টার দিকে আকমল আলী বেড়িবাঁধ এলাকায় মাইকিং করছিলেন, তখন জেলেপাড়ার একেবারে শেষদিকের একটি ছাপড়া ঘরে অপেক্ষা করছিলেন ৬০ বছর বয়সী হরিবালা। মানসিক ভারসাম্যহীন ছেলেকে নিয়ে ভিক্ষা করে চলেন তিনি। তার আশঙ্কা ঘর ছেড়ে চলে গেলে তার সবকিছু চুরি হয়ে যাবে।
হরিবালা বলেন, 'এই ঘরই আমার সবকিছু। ঘরে তেমন কিছুই নেই। তারপরও যতটুকু আছে তাও যদি চুরি হয়ে যায়, তাহলে আমার সব শেষ হয়ে যাবে। ছেলেটা সকাল থেকে এদিক-ওদিক করছে। ২ দিন ধরে মাইকিং চলছে। খুব সমস্যা দেখলে (আশ্রয়কেন্দ্রে) চলে যাব।
কাছাকাছি ৩ বছর বয়সী নাতনিকে নিয়ে ঘরের সামনে বসে ছিলেন ফুল মালা রানী। ঘরের মালামাল চুরি হয়ে যাওয়ার ভয়ে তিনিও ঘর ছেড়ে যাননি।
ফুল মালা রানীর ভাষ্য, 'ঝড় আসলে অনেকের কপাল খুলে যায়। ফাঁকা ঘর পেয়ে চুরি করে নিয়ে যায় সব। এর আগে তালা মেরে রেখে গেলেও লাভ হয়নি। তাই ঝড় শুরু না হওয়া পর্যন্ত যাব না।'
ফুল মালার রানীর মতো একই সুরে কথা বললেন জেলেপাড়ার আরেক বাসিন্দা সুমন জলদাস। বেড়িবাঁধের ওপরে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের গতিবিধি দেখছিলেন তিনি।
সুমন বলেন, 'পাড়ার অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্রে চলে গেছেন। মাছ ধরার জাল, রশিসহ অনেককিছু আছে। এগুলো চুরির হাত থেকে বাঁচাতে পুরুষরা থেকে গেছেন।'
আজ শনিবার দুপুর ২টা পর্যন্ত আকমল আলীর ঘাটের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে দেখা গেছে, মাছ ধরার জাল, রশিসহ অন্যান্য সরঞ্জাম গুছিয়ে রাখছেন অনেকে। আউটার রিং রোডের পাশে স্তুপ করে রাখা হচ্ছে সব। অনেকেই নিজ নিজ ঘরের টিন রশি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে রাখছেন। ঘরের আসবাব ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রও বেঁধে রাখা হচ্ছে। দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একে একে।
জেলার ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা হুসাইন মোহাম্মদ রেডক্রিসেন্টের সেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে মাইকিং করছিলেন। আরেক পাশে চলছিল ফায়ার সার্ভিসের মাইকিং।
হুসাইন মোহাম্মদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা গত ২ দিন ধরে সবাইকে নিরাপদ দূরত্বে আমাদের নির্ধারিত আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যেতে বলছি। অনেকেই চলে গেছেন। কিছু মানুষ থেকে গেছেন মালামাল চুরির ভয়ে। আমরা বিকাল ৩টার মধ্যে বাকিদের সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি।'
এই ত্রাণ কর্মকর্তা জানান, দমকা হাওয়া শুরু না হওয়া পর্যন্ত স্থানীয় কিছু পুরুষের পাশাপাশি পুলিশ পাহারায় থাকবে।
এদিন দুপুর ২টার পর আকমল আলী ঘাটের অবস্থা পরিদর্শনে আসেন মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী।
চট্টগ্রাম জেলার জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার তৌহিদুল ইসলাম জানান, জেলার ২ সিএসডি এবং ১৬টি এলএসডি গোডাউন আছে। সেখানে মজুতকৃত খাদ্যশস্যের সুরক্ষায় সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মস্থলে উপস্থিত আছেন। গুদামের ভেতরে পানির প্রবেশ ঠেকানোর জন্য বাফেল ওয়াল নির্মাণ করা হয়েছে।
এছাড়া আপৎকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলায় ১৫টি উপজেলায় ১৪টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সম্পূর্ণ তৈরি আছে বলে জানান তৌহিদুল ইসলাম। প্রত্যেক ইউনিয়নে একটি করে এবং উপজেলা পর্যায়ে ৫টি করে মোট ২৮৪টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিভাগের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বক্তব্য, চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের ১৭টি থানায় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি অতিরিক্ত মিলিয়ে পুলিশের মোট ২ হাজার সদস্য তৈরি আছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলছে, চট্টগ্রামে পাউবোর মোট ২৫০ কিলোমিটার বাঁধ আছে। এর মধ্যে ১২ দশমিক ৭ কিলোমিটার ছাড়া বাকি অংশ পুরোপুরি 'প্রোটেকটেড' বলে দাবি তাদের।
এদিকে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সময়ে দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা সচল করার জন্য ১০৫টি 'গেরিলা' টিম প্রস্তুত রেখেছে বলে জানিয়েছে।
অতি প্রবল এই ঘূর্ণিঝড় এগিয়ে আসায় কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরে এরইমধ্যে ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত জারি করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে ৮ নম্বর মহাবিপৎসংকেত বহাল আছে। পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৪ নম্বরের পরিবর্তে ৮ নম্বর মহাবিপৎসংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। মোংলা সমুদ্রবন্দরের জন্য থাকছে ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত।
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট অতিপ্রবল এই ঘূর্ণিঝড় আরও শক্তি সঞ্চয় করে কক্সবাজারের ৬৩০ কিলোমিটার কাছে চলে আসার পর আজ শনিবার দুপুর আড়াইটায় আবহাওয়া অধিদপ্তর সংকেত পুনর্বিন্যাস করে নতুন বুলেটিন দেয়।
ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের কাছাকাছি এলাকায় সাগর উত্তাল রয়েছে। এজন্য বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সব মাছধরা নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।
Comments