ঘরে ফেরার অপেক্ষায় সড়কে রাত কাটছে লক্ষ্মীপুরের কলাকোপাবাসীর

লক্ষ্মীপুরে বন্যা
বন্যায় প্লাবিত লক্ষ্মীপুরের চর কলাকোপা গ্রাম। ছবি: সাজ্জাদ হোসেন/স্টার

বন্যার পানিতে টিনশেড ঘর ডুবে যাওয়ায় গত সাত দিন যাবত রাস্তায় ঘুমাচ্ছেন লক্ষ্মীপুরের চর কলাকোপা গ্রামের বাসিন্দা আবুল কালাম। তার ঘরের ভেতরে এখনো কোমর সমান পানি।

'দিনে বাড়ির কাছে রাস্তায় বসে থাকি, আর রাতে রাস্তায় কাগজ বিছিয়ে ঘুমাই। ৬২ বছরের জীবনে এত ভয়াবহ বন্যা কখনো দেখিনি,' বলেন কালাম।

তিনি আরও বলেন, বিগত সময়ে বন্যার পানি দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে কমে যেত কিন্তু এবার পানি কমছে না।

কৃষক আবুল কালাম একা নন, কলাকোপা ছাড়াও আশেপাশের ছয়টি গ্রামের অন্তত ২০০ মানুষ গত এক সপ্তাহ যাবত ঘরছাড়া। সন্ধ্যা হলে তারা আশ্রয় নেন স্থানীয় 'চাইররাস্তা' নামে একটি সড়কে।

ওই গ্রামের বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন বলেন, 'গ্রামের কোথাও আলোর ব্যবস্থা নেই। এই জায়গায় সবাই আসে কারণ এখানে বাতি (রোড লাইট) আছে। রাতে কেউ ঠিক মতো ঘুমাতে পারে না, কষ্টের কথা বলতে বলতে সময় কেটে যায়।'

আবুল কালাম বলেন, 'কোথাও কোনো শুকনো জায়গা নেই, তিনটি গরু রাস্তায় এনে রেখছি৷ নিজেরা খাচ্ছি স্থানীয়দের সহযোগিতায়, আর মানুষের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে গরুর খাবার কিনছি।'

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, টানা এক সপ্তাহ যাবত পাশের পূর্ব স্বরসীতা, চর বাদাম, পোরাগাছা, আজাদনগর, হারুন বাজার, হাজীগঞ্জ গ্রাম জলমগ্ন।

লক্ষ্মীপুরে বন্যা
লক্ষ্মীপুরের চর কলাকোপা গ্রামে সবার বাড়ি-ঘর বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। ছবি: সাজ্জাদ হোসেন/স্টার

কলাকোপা গ্রামের কৃষক নজির আহমেদ বলেন, 'আমাদের গ্রামের সব বাড়িতেই পানি ঢুকেছে। প্রধান সড়ক ছাড়া আর কোনো শুকনো জায়গা নেই। আমার স্ত্রী আত্মীয়ের বাসায় থাকছেন৷ আমি একা বাড়ি পাহারা দিচ্ছি। রাতে ঘুমাতে পারি না সাপের ভয়ে। মশার কামড়েও ঘুম ভেঙে যায়। জীবনে এত কষ্ট কখনো করিনি।'

কেলাকোপা ঘুরে দেখা যায়, গ্রামের সবগুলো প্রবেশপথই বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। বেশির ভাগ নারী-পুরুষ রাস্তায় বসে আছেন। রাস্তার পাশেই গবাদি পশুকে খাবার খাওয়াচ্ছেন।

পূর্ব স্বরসীতা গ্রামের কৃষক দুলাল হোসেন বলেন, 'গত এক মাসে তিনবার বীজতলা লাগিয়েছি, বন্যার পানিতে সব ভেসে গেছে। ফসলের জন্য যে টাকা ধার করেছিলাম, তা দিয়ে এখন চলছে। কিন্তু পানি শুকিয়ে গেলে আবাদের টাকা কোথায় পাব, কীভাবে ঋণ পরিশোধ করব জানি না।'

লম্বাখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন প্রায় ১০০ মানুষ, তাদের সবার বাড়ি-ঘর বন্যার পানিতে ডুবে গেছে।

চর বাদাম গ্রামের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা বেলাল হোসেন বলেন, 'স্কুলের একটি রুমের মেঝেতে আমরা ২৫ জন থাকছি। এই স্কুলের চারপাশেও পানি, যারা আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন তারাও পানিবন্দি।'

পরিবারের পাঁচ সদস্য আশ্রয়কেন্দ্রে খাবার কষ্টে আছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'দুইবেলা চিড়া-মুড়ি ও একবেলা ভাত খেয়ে ক্ষুধা নিরারণ করছি।'

লক্ষ্মীপুরে বন্যা
ত্রাণ না পাওয়া অভিযোগ করেছেন বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা। ছবি: সাজ্জাদ হোসেন/স্টার

আশ্রয় কেন্দ্রের বাইরে পর্যাপ্ত ত্রাণ পৌঁছেনি বলে অভিযোগ তুলেছেন পূর্ব স্বরসীতা গ্রামের আরেক বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম।

তিনি বলেন, 'সরকারের পক্ষ থেকে আমরা কিছুই পাইনি। যারা আশ্রয় কেন্দ্রে আছেন, তারা ত্রাণ পেলেও আমরা যারা বাইরে আছি তারা কোনো সহযোগিতা পাচ্ছি না।'

'আমার জীবনে এত ভয়াবহ বন্যা, এর আগে কখনো দেখিনি। আমার দুটি গরু, একটি ছাগল বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেছে৷ আমার একটি পুকুরের সব মাছ ভেসে গেছে। গত এক মাসে আমি জমিতে তিনবার বীজতলা রোপণ করেছি, বন্যার পানিতে সব নষ্ট হয়ে গেছে,' যোগ করেন তিনি।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসসন কর্মকর্তা ইউনুছ মিয়া বলেন, 'লক্ষ্মীপুর জেলার ৯০ ভাগ এলাকাই এখন প্লাবিত৷ বর্তমানে আট লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় আছেন। তাদের সহায়তায় ৭৮৯ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ২০ লাখ ৭০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।'

ত্রাণ সংকটের কথা জানিয়েছেন নোয়াখালীর পশ্চিম মাইজদী গ্রামের কৃষক মুজিবুল হক।

তিনি বলেন, 'গত সাত দিনের মধ্যে দুই দিন আমি ও আমার স্ত্রী না খেয়ে ছিলাম। আমাদের কাছে কোনো সাহায্য-সহায়তা আসেনি। প্রতিবেশীর কাছ থেকে ১০ কেজি চাল পাওয়ায় পরিবারের ছয়জনের ক্ষুধা নিবারণ হচ্ছে। গরুর খাবার নেই বাসায়, কেনার টাকাও নেই।'

মুজিবুলের বাড়িতে প্রবেশের প্রায় দুই কিলোমিটার পথে এখনো জলাবদ্ধতা রয়েছে।

'গত ২১ আগস্ট রাত সাড়ে ১২টার দিকে বৃষ্টির প্রচণ্ড শব্দে ঘুম ভেঙে যায়৷ এরপর ঘরের ভেতরে পানি ঢুকতে শুরু করে,' জানান তিনি।

একই এলাকার গৃহিণী শিল্পী বেগম বলেন, 'কেউ আমাদের সহায়তার জন্য আসেনি। জনপ্রতিনিধিরা ৫ আগস্ট থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, কোনো সরকারি কর্মকর্তাও আসেননি।'

মাইজদী ঘুরে দেখা যায়, শহরের প্রধান সড়ক ও বিভিন্ন এলাকার রাস্তায় এখনো পানি জমে আছে।

সরকারি হিসাবে নোয়াখালী জেলায় প্রায় ছয় টন ত্রাণ সরবরাহ করা হয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English

Govt publishes gazette of 1,558 injured July fighters

Of them, 210 have been enlisted in the critically injured "B" category, while the rest fall under the "C" category of injured fighters

7h ago