ঘূর্ণিঝড় মিধিলি: বরিশাল, নোয়াখালী, পটুয়াখালীতে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি
ঘূর্ণিঝড় মিধিলিতে বয়ে যাওয়া ঝড়ো হাওয়ায় উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতির শঙ্কা করছেন চাষীরা।
বরিশালে ঘুর্ণিঝড়ে শীতকালীন ফসল ও আমন ধানের ক্ষতি ছাড়াও মৎস্য ও ঘরবাড়ির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অনেক অঞ্চলেই গাছপালা উপড়ে ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
নোয়াখালীর ৫টি উপকূলীয় উপজেলা—হাতিয়া, সুবর্ণচর, কবিরহাট, কোম্পানীগঞ্জ ও সদর উপজেলার ৩৪টি ইউনিয়নে কয়েকশ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে গাছ উপচে পড়ে, ডালপালা ও বিদ্যুতের খুটি ভেঙে পড়ে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
ঘুর্ণিঝড়ের প্রভাবে পটুয়াখালীতে আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। স্থানীয়রা ক্ষেতের অর্ধেক ফসল অপুষ্ট ও চিটা হওয়ার আশঙ্কা করছেন। কৃষি বিভাগের দাবি, জেলার ১ লাখ ৯০ হাজার হেক্টর জমির আমন ধানের মধ্যে প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমির আমন ধানের ক্ষতি হয়েছে, যার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫০ কোটি টাকা।
বরিশাল
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে অবিরাম বৃষ্টিতে বরিশাল নগরীরর নিম্নাঞ্চল ছাড়াও বিভাগের অধিকাংশ কৃষিক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শনিবার সরেজমিনে নগরীরর বটতলা, কলেজ রোডসহ নিচু এলাকাগুলো বৃাষ্টির পানিতে ডুবে থাকতে দেখা যায়।
আবহাওয়া বিভাগের মতে, বরিশাল জেলায় মোট ২২৫ মিমি বৃষ্টিপাত হয়েছে, এ সময় ঘণ্টায় ৫৫ কিলোমিটার বেগে বাতাস প্রবাহিত হয়েছে।
সরেজমিনে ঝালকাঠী জেলার নলছিটি ও সদরসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, ঝড়ের প্রভাবে মাঠে থাকা আমন ধান তলিয়ে গেছে। ঝালকাঠী জেলার নলছিটি উপজেলার শ্রীরামপুর, মগড়, ডুবিল গ্রামে আমন ধান ছাড়াও ক্ষেতে থাকা পুঁইশাক, লাউশাক ও করলা ক্ষেতের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বরিশাল অঞ্চলের তথ্যমতে, বিভাগে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ৬ লাখ ৭৩ হাজার ২০৪ হেক্টর জমির মধ্যে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৯৭৯ হেক্টর জমির ধানের আংশিক ক্ষতি হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচলাক শওকত ওসমান জানান, মাঠে থাকা আমন ধান ছাড়াও শীতকালীন সবজির বেশ ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে। তবে এখনই এর আর্থিক মূল্য নিরূপণ করা যাচ্ছে না। কয়েকদিন পরে এই ক্ষয় ক্ষতির হিসেব দেয়া যাবে।
মাঠে থাকা ২০ হাজার ৩৭৯ হেক্টর জমির শীতকালীন সবজির মধ্যে অর্ধেক অর্থাৎ ১০ হাজার ৪৩০ হেক্টর জমির ক্ষতি হয়েছে বলে জানান তিনি।
বিভাগীয় মৎস্য অফিসের উপপরিচালক নৃপেন্দ্র নাথ বিম্বাস জানান, ভোলার বেরহানউদ্দিন উপজেলা থেকে চর জহিরুদ্দিনে যাবার সময়ে একটি মাছ ধরার ট্রলার ডুবে যায়। এ ঘটনায় ৪ জেলে সাঁতার কেটে তীরে উঠতে পারলেও এক জেলে নিখোঁজ রয়েছে।
এদিকে ভোলার মৎস্য কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ জানান, ভোলায় কুকরী, ঢালচর ও মুজিবনগর ইউনিয়নে ১৫ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে। এ ছাড়া ১৮টি নৌকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৫৭ লাখ টাকা।
বিভাগীয় অফিস সূত্র জানায়, বরিশাল বিভাগের অন্তত ৩১১টি ইউনিয়নের ২ লাখ ১৫ হাজার ১৬ জন দুর্যোগ কবলিত হয়েছে। এর মধ্যে ১৩২টি বাড়িঘর সম্পূর্ণ ও ১ হাজার ১১১টি আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে।
বিভাগীয় কমিশনার মো. শওকত আলী জানান, বিভাগে জানমালের বড় ধরনের কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে গাছপালা উপড়ে গিয়ে ফসল ও ঘরবাড়ি ক্ষতি হয়েছে।
নোয়াখালী
নোয়াখালীর কৃষি অধিদপ্তরের উপ পরিচালকের কার্যালয়ের সূত্রে জানা গেছে, নোয়াখালী জেলার সদর, সেনবাগ, চাটখিল, কোম্পানীগঞ্জ, হাতিয়া, সুবর্ণচর—এই ৭টি উপজেলায় চলতি বছর ১ লাখ ৩৫ হাজার ১১৯ হেক্টর আমন চাষ হচ্ছিল। ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে ২৪ হাজার ৫০৩ হেক্টর আমনের ক্ষতি হয়েছে।
জেলা কৃষি প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা মো. শহীদুল ইসলাম জানান, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে কাঁচা-পাকা ২৪ হাজার ৫০৩ হেক্টর আমান ফসল আক্রান্ত হয়েছে। এছাড়া ৯টি উপজেলায় ১ হাজার ২৩৭ হেক্টর শীতকালীন শাক সবজির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
এদিকে নোয়াখালীতে গত ৩ দিন ধরে বিদ্যুৎ না থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছে ৪ লাখ মানুষ।
নোয়াখালী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে জেলা সদর ও ৯টি উপজেলায় ৮ লাখ ৬৬ হাজার বিদ্যুৎ গ্রাহক রয়েছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবি) অধীনে ১ লাখ ৭ হাজার এবং পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির অধীনে ৭ লাখ ৫৯ হাজার গ্রাহক রয়েছেন।
পল্লী বিদ্যুৎ নোয়াখালী জেলা কার্যালয়ের জেনারেল ম্যানেজার (জি.এম) জাকির হোসেন বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বৈদ্যুতিক খুঁটির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ৯টি উপজেলায় ২২৮টি খুঁটি ভেঙে পড়েছে। ৩২টি ট্রান্সফরমার নষ্ট হয়েছে। ৬ শতাধিক গাছ ভেঙে পড়ে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে গেছে। এর ফলে ৫০ শতাংশেরও বেশি গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছেন। বিদ্যুৎকর্মীরা এসব লাইন মেরামত ও খুঁটি বসানোর কাজ শুরু করেছেন।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. জাহিদ হাসান খান বলেন, 'ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে জেলার উপকূলীয় ৫টি উপজেলায় কয়েকশ কাঁচা ঘরবাড়ি আংশিক ও সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির সঠিক পরিমাণ নির্ণয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তারা কাজ শুরু করেছেন। রিপোর্ট হাতে পেলে সঠিক পরিমাণ বলা যাবে।'
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. নাজিমুল হায়দার বলেন, 'ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে জেলার উপকূলীয় ৫টি উপজেলায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের জন্য সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের কাছে প্রতিবেদন পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিবেদন হাতে আসার পর সঠিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বলা যাবে।'
পটুয়াখালী
আজ শনিবার জেলার বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, বেশিরভাগ আমন ধান নষ্ট হয়ে গেছে। বৃষ্টির পানি জমে আমন খেতগুলো ১-২ ফুট পানিতে প্লাবিত হয়েছে। একইসঙ্গে, মৌসুমী শাক-সবজি ক্ষেতগুলোও বৃষ্টির পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এ অঞ্চলের প্রধান কৃষি ফসল আমন। পটুয়াখালীতে এ বছর ১.৯০ লাখ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষ হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এসব ধান সংগ্রহ ও মাড়াইয়ের কথা ছিল।
সদর উপজেলার আউলিয়াপুর গ্রামের কৃষক সিকান্দার মিয়া বলেন, 'ধানে ফুল এসেছে এই সময়ে অতিবৃষ্টি ও বাতাসের কারণে ধানের কাঙ্ক্ষিত ফলন পাওয়া যাবে না। অকিাংশ ধান চিটা হয়ে যাবে। ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে ধানখেত পানিতে ডুবে আছে। এতে কৃষি জমির ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।'
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. নজরুল ইসলাম জানান, মোট আবাদের ৫ ভাগ ধান পেকেছে এবং ২০ ভাগ আধাপাকা অবস্থায় থাকায় ক্ষতির কারণ নেই। তবে ৭৫ ভাগ ফসলের প্রায় ২০ ভাগ জমির ফসল চিটা হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এছাড়াও জেলায় ৮০০ হেক্টর জমির খেসারি ডাল ও ৩৪৮ হেক্টর জমির মৌসুমী শাক-সবজি ক্ষেতের ক্ষতি হয়েছে। তবে প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করতে কিছু সময় লাগবে।
এছাড়া, পটুয়াখালীতে ঘুর্ণিঝড়ে ৬টি বসতঘর সম্পূর্ণ, ১৩১টি আংশিক, ১টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এদিকে, পটুয়াখালী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার তুষার কান্তি হালদার জানান, ঘুর্ণিঝড়ে ৮৫ টি বৈদ্যুতিক খুঁটি উপড়ে পড়েছে। এখনও বিভিন্ন উপজেলার প্রায় এক লাখ গ্রাহক বিদ্যুহীন। তবে আজ সন্ধ্যার মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবকি হবে বলে আশা করছি।
পটুয়াখালী আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ মাহবুবা সুখী বলেন, 'ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে পটুয়াখালীতে প্রবল বৃষ্টিপাত হয়েছে। শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ২০১ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।'
এদিকে, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বরগুনায় ২০৫টি বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মিল্টন চাকমা শুক্রবার এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা অনুযায়ী সহায়তা করা হবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক।
প্রতিবেদনটি দ্য ডেইলি স্টারের বরিশাল, নোয়াখালী ও পটুয়াখালীর নিজস্ব সংবাদদাতাদের পাঠানো তথ্য থেকে তৈরি করা হয়েছে।
Comments