ঘূর্ণিঝড় মোখা: ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধে অরক্ষিত দক্ষিণ উপকূলে আতঙ্ক

খুলনার দাকোপ উপজেলার খোনা খেয়াঘাট এলাকায় ঢাকি নদীতে জিও ব্যাগ ফেলে বাঁধের ভাঙন রোধের চেষ্টা। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

বাংলাদেশ উপকূল থেকে হাজারখানেক কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় 'মোখা' আতঙ্কিত করে তুলেছে দেশের দক্ষিণ উপকূলের বাসিন্দাদের।

বিশেষ করে খুলনা জেলার কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা উপজেলা এবং সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার অনেক বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকায় এখানকার বাসিন্দাদের আতঙ্ক আরও বেড়েছে।

আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, 'মোখা'র কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার। এটি দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ১৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর খুবই বিক্ষুব্ধ রয়েছে।

দাকোপের কামারখোলা এলাকার গুনারি গ্রামে বাঁধের চিত্র। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এখন মোখার গতিপথ যেমন আছে তেমনটি থাকলে আগামী রোববার দুপুর নাগাদ ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশের কক্সবাজার এবং মিয়ানমারের কিয়াউকপিউয়ের মধ্যবর্তী এলাকা দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে। আর ঘূর্ণিঝড় উপকূলের দিকে এগিয়ে আসার সময় প্রচুর বৃষ্টি ঝরাবে। সেই সঙ্গে উপকূলীয় নিচু এলাকা স্বাভাবিকের চেয়ে ২ থেকে ২ দশমিক ৭ মিটার বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পরে।

ঠিক এ বিষয়টিই ভাবিয়ে তুলেছে দক্ষিণ উপকূলের বাসিন্দাদের। কারণ খোদ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) দেওয়া তথ্য বলছে, খুলনা ও সাতক্ষীরার বিভিন্ন উপজেলায় ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের সংখ্যা অন্তত ৩৯টি। আর এসব এলাকায় অতি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ আছে অন্তত ১২টি।

এ বিবেচনায় খুলনা জেলায় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপ উপজেলা।

এসব উপজেলার কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কয়রা উপজেলার ৬ নম্বর ও ৪ নম্বর রিং বাঁধ, গাজীপাড়া, গোলখালী, হাজতখালী, জোড়শিং, মহেশপুর, ঘাটাখালী, হরিণখোলা ও মদিনাবাদ লঞ্চঘাট সংলগ্ন এলাকা এবং মঠবাড়িয়া ও হোগলা এলাকার প্রায় ১২ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে পানির উচ্চতা বাড়লে এসব বাঁধ উপচে লোকালয় প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা আছে।

ঘূর্ণিঝড় 'মোখা'র পূর্বাভাস পেয়ে খুলনার কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশি গ্রামের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম এরমধ্যেই তার স্ত্রী ও ৩ সন্তানকে নিরাপদ জায়গায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন। বছর তিনেক আগে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, 'সাকবাড়িয়া নদীর পানির চাপ বেশি হলে আমাদের বাঁধ কোনভাবেই টিকবে না। আম্পানের পর আমাদের গ্রামসহ আশপাশের এলাকার কয়েক শ পরিবারের সবকিছু প্রায় ২ বছর ধরে পানির নিচে ডুবে ছিল। জানি না এবার কী হবে!'

নুরুল ইসলাম আরও বলেন, 'সাকবাড়িয়া এবং কপোতাক্ষ নদ যখন ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে তখন এই দুর্বল বেড়িবাঁধ কোনো কাজে আসে না। যতবারই ঝড় হয়েছে বাঁধের কোনো না কোনো জায়গা ভেঙে আমাদের গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। দোয়া করি, মোখা যেন এদিকে না আসে।'

এ বিষয়ে উত্তর বেদকাশী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সরদার নুরুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত গাজীপাড়া ও গাতিরঘেরী এলাকায় গতবছর বাঁধ দেওয়া হয়েছিল। তবে তা এখনো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে।'

মহেশ্বরীপুর ইউপির চেয়ারম্যান শাহনেওয়াজ শিকারির ভাষ্য, 'জোয়ার বাড়লে বাঁধের ধসে যাওয়া জায়গাগুলো দিয়ে পানি ঢুকবে। তাতে গোটা ইউনিয়ন তলিয়ে যেতে পারে।'

উপকূলীয় কয়রা ও পাইকগাছা উপজেলার বেড়িবাঁধ পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২। ওই কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের আওতাধীন ৬৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের ১০ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ। আর অতিঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ আছে ৩ কিলোমিটার।'

আশরাফুল আলম আরও বলেন, 'পাইকগাছার তুলনায় কয়রা উপজেলায় আমাদের বেশি নজর রাখতে হচ্ছে। কারণ ওই এলাকাটি সুন্দরবন সংলগ্ন ও এর ৩ দিকে কপোতাক্ষ এবং শাকবাড়িয়া নদী। বড় আকারের জলোচ্ছ্বাস হলে ভালো বাঁধও ধসে যেতে পারে।'

দাকোপের কামারখোলা এলাকার গুনারি গ্রামে বাঁধের চিত্র। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

এদিকে গত সপ্তাহে দাকোপ উপজেলার মোজামনগর, ঝালবুনিয়া, দক্ষিণ কামিনিবাসিয়া, জালিয়াখালী, মধ্যপানখালী, কালাবগী, সুতারখালী, চুনকুড়ি, ঢাংমারি, জাবেরের খেয়াঘাট, খোনা, গড়খালী, উত্তর কামিনিবাসিয়া, বটবুনিয়া, শিবসার পাড়, ভিটেভাঙ্গা, শ্রীনগর, কালীবাড়ি, গুনারী, খলিশা এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এসব জায়গার বাঁধের বেশিরভাগ অংশই ঝুঁকিপূর্ণ।

কামারখোলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পঞ্চানন কুমার মন্ডল বলেন, 'কালাবগী, নলিয়ান ফরেস্ট স্টেশনের পাশের এলাকা ও গুনারীসহ বাঁধের ৬-৭টি জায়গা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ২২০ কোটি টাকা ব্যয়ে বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় এখানে যে বাঁধ নির্মিত হয়েছিল, তা এখনই ভেঙে যাচ্ছে শিবসার পানির প্রবল চাপে। আর পাউবো যে বাঁধ নির্মাণ করে, তা তো কাজ শেষ হওয়ার আগেই ভেঙে যায়।'

ওই এলাকার বেড়িবাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১। এ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুর রহমান তাজকিয়া বলেন, 'ঝড়ের পূর্বাভাস পাওয়ার পর থেকেই মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ সবার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ মেরামতের বিষয়টি তদারকি করেছি। আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি আছে।'

এদিকে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, বুড়িগোয়ালিনী, আটুলিয়া, কাশিমাড়ী এলাকার কয়েকটি বেড়িবাঁধ অতিঝূঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিরা।

এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে বুড়িগোয়ালিনী এলাকা। বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ভবতোষ মণ্ডল বলেন, 'বুড়িগোয়ালিনীর দুর্গাবাটি ও দাতিনাখালীর ৩ জায়গায় বাঁধের অবস্থা ভালো না। গত আম্পানে জায়গাগুলো ভেঙে গিয়েছিল। পরে মেরামত করা হলেও তা পুরোপুরি ঠিক হয়নি।

গাবুরা ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য আবদুর রহিম বলেন, 'হরিষখালী, পার্শেমারী টেকেরহাট, গাবুরা, চকবারা ও লেবুবুনিয়াসহ ৫টি জায়গায় বেড়িবাঁধ জরাজীর্ণ হয়ে আছে। এমনিতেই প্রতিনিয়ত সেখানে বাঁধ ভাঙছে।'

সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সালাউদ্দিন বলেন, 'আমাদের আওতাধীন মোট ৩৮০ কিলোমিটার বাঁধের ২০ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ ও ৩ কিলোমিটার অতিঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে ঝড়ের আভাস পেয়ে অতিঝুঁকিপূর্ণ ৩ কিলোমিটার বাঁধ সংস্কার করা হচ্ছে।'

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ সানাউল ইসলামের ভাষ্য, 'দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মাটির ধরন অন্য এলাকার থেকে ভিন্ন। বাঁধ নির্মাণের সময় কোন মাটিতে কাজ করা হচ্ছে, কোন লেয়ার দিয়ে করা হচ্ছে এবং কোন সময়ে করা হচ্ছে—এ বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখা উচিত। সম্ভবত এর অনেককিছু মাথায় রাখা হয়নি। তাই এই অবস্থা।'

খুলনা অঞ্চলে এর আগে ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার সময় ৬৮৩ কিলোমিটার এবং ২০২০ সালে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের সময় ৪৭৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। যার ক্ষত এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি উপকূলবাসী। এর মধ্যেই চোখ রাঙাচ্ছে মোখা।

Comments

The Daily Star  | English

Tanvir takes five as Tigers clinch 2nd Sri Lanka ODI

Bangladesh captain Mehidy Hasan Miraz has won the toss and opted to bat first in the second ODI against Sri Lanka, looking to keep the three-match series alive with a win at the R Premadasa Stadium today. 

17h ago