কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া: প্রান্তজনের বিদীর্ন-বিষন্নতার চিত্রণ
সে অনেকদিন আগের কথা। কোনো এক নামীদামি আলোকজ্জ্বল কৃষি বিষয়ক সভায় শুনেছিলাম, কৃষি নাকি আর কৃষকের হাতে থাকবে না। আরও অনেকদিন পরে জেনেছিলাম ধানের থেকে বাওকুল লাগালে নাকি লাভ অনেক বেশি। বাবার ধানি জমিতে সন্তান বাওকুল লাগিয়ে বাম্পার ফলন ঘরে তুলেছেন। ধান লাগিয়ে লাভ কি তবে? লাভ তো আছেই। এবার তবে কৃষির দায় বর্তাবে বহুজাতিকের হাতে। প্যাকেটে প্যাকেটে সাদা চাল পৌঁছে যাবে নগরীর আনাচে-কানাচে। অথবা ক্ষুদ্র ঋণের কারবার হবে এ দফায়। ১০ হাজার টাকার ঋণ, শোধ হবে ২৪ সপ্তাহে। হপ্তাপ্রতি ৬০০ টাকা করে। তবু কি শেষ রক্ষা হবে কৃষকের? তবু কি তিনবেলা ভাত জুটবে তার? মনে হয় না। তাই কৃষক হবেন উদ্বাস্তু, শহরমুখী হবে তার যাত্রা। বিশাল শহরে হয়তো রিকশাওয়ালা বা দিনমজুর হওয়ার লড়াইয়ে শামিল হবেন ধানি জমির কৃষক। হবেন কুড়া পক্ষী, শূন্য হবে যাদের শেষ সীমানা।
চলচ্চিত্রের গল্পটা হাওরের। নির্মাতা মুহাম্মদ কাইয়ুমের ভাষায় এ হলো 'ভাটির দেশে মাটির গল্প'। তবে একটু গভীরে ভাবলে সারাদেশের কৃষকের সংগ্রামও যেন এখানে মিলেমিশে একাকার। সিনেমার মূল পুরুষ চরিত্র সুলতানের উত্তর থেকে দক্ষিনের এই যাত্রাই যেন আমাদের সেই কথাই মনে করিয়ে দেয়। চলচ্চিত্র হিসেবে কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া'র শক্তির জায়গা লোকেশন, কাস্টিং, অভিনয় এবং অতি অবশ্যই নির্মাতার সৎ ও আন্তরিক নির্মাণের প্রচেষ্টা। এইবেলা বলে নেওয়া ভালো যে, সিনেমাটোগ্রাফি এই চলচ্চিত্রের সবচেয়ে শক্তির জায়গা হলেও একই সঙ্গে তা দূর্বলতম জায়গাও বটে। অনেক বছর ধরেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা টেলিভিশনের পর্দায় রোমান্টিক হাওরের যে উপস্থাপন আছে, তার থেকে এই চলচ্চিত্রে হাওরের উপস্থাপনের তেমন কোনো ফারাক নেই। তাই চলচ্চিত্রের দৃশ্যায়ন দর্শক মনে কোনো অস্বস্তি তৈরি করে না বা হাওর সংক্রান্ত মধ্যবিত্তের আদি রোমান্টিকতা থেকে দর্শককে বিযুক্ত করতে সক্ষম হয় না । বরং, গল্পের পরম্পরা দর্শককে নিয়ে যেতে চায় বিদীর্ন বিষন্নতার গহ্বরে। এই চলচ্চিত্রের প্রথম নয়, দ্বিতীয় নয় বরং বিয়ের বাদ্য, আনন্দ আর রঙের বিপরীতে ছোট্ট শিশুর মৃত্যুর দৃশ্যের মধ্য দিয়ে দর্শক প্রথম অস্বস্তি এবং বেদনার বোধের মধ্যে প্রবেশ করে। এই বোধ জারি থাকে শেষ দৃশ্য পর্যন্ত যখন 'রুকুর মা' নৌকায় দাঁড়িয়ে নিজ বাসগৃহে পুনরায় ফিরে আসবার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন, আর ঢেউয়ের ধাক্কায় নৌকা দুলতে থাকে ভয়ঙ্করভাবে। আমরা বুঝতে পারি এই কুড়া পক্ষীদের শূন্যের যাত্রাপথ হবে আরও ভয়ঙ্কর, হয়তোবা নিষ্ঠুরতমও। ফলে এই সংগ্রাম এখানেই শেষ নয় বরং তা বহমান।
এই সিনেমার গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হলো এর গল্পের লেয়ার বা স্তর, যা দর্শকের সকল আকাঙ্ক্ষা বা আশাকে চরিতার্থ করে না। ফলে শেষ দৃশ্য পর্যন্ত দর্শকমনে গল্প নিয়ে এক ধরনের দোলাচল জারি থাকে। কোমরে ঝুনঝুনি থাকা সত্ত্বেও ছোট্ট আবুর পানিতে ডুবে মৃত্যুদৃশ্য যেমন আকস্মিক অস্বস্তি হিসেবে দৃশ্যপটে হাজির হয়, তেমনি সুলতান এবং রুকুর মায়ের বিয়ের ঘটনাও দর্শককে আশ্বস্ত করে। একইভাবে তেলসন্ধি পুজা এবং খেতকে নানাভাবে বান্ধা দেওবার পরও মূলচরিত্রদের ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণ আর ধানি জমিতে ছাতা মাথায় হাঁটার সংস্কার আমাদের অনেকটা সময়জুড়ে শঙ্কা ও স্বস্তির দোলাচলের মাঝে রেখে দেয়, যা গল্পের গতির সঙ্গে দর্শককে বেঁধে রাখে চলচ্চিত্র শেষ হওয়ার পরেও। মজার বিষয় হলো, বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্র এর গল্প ও দৃশ্যভাষার সঙ্গে যে আপসকামী সম্পর্ক রেখে চলে, এটিতে তা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। বরং, ছোট্ট শিশুর বয়ানে ডকু-ড্রামা ধরনের এই ছবি তার নির্মাণকৌশল, বিষয় নির্ধারণ ও গান বাছাই, বিপন্ন গ্রামীণ সংস্কৃতি থেকে শুরু করে বছর তিনেকের বা তারও বেশি সময় ধরে গবেষণার মধ্য দিয়ে যে এথনোগ্রাফিক প্রদর্শন হাজির করেছে তা মূলধারার মিডিয়া এবং চলচ্চিত্র বা খোদ রাষ্ট্রের জন্য বিরাট এক প্রশ্ন হিসেবে হাজির হয়। ফলে চলচ্চিত্রটির জন্য বরাদ্দ হয় একটি মাত্র হল এবং দিনে দুটি মাত্র শো। পাশাপাশি চলচ্চিত্রটি নিয়ে জারি থাকে নিরঙ্কুশ নীরবতা।
অনেকে চলচ্চিত্রটিকে পদ্মা নদীর মাঝি'র (১৯৯৩) সঙ্গে তুলনা করছেন। খুব সম্ভবত বর্তমান চলচ্চিত্রের হাওরের সেই বিচ্ছিন্ন দ্বীপটির সঙ্গে ময়না দ্বীপের অল্প-বিস্তর সাজুয্য আছে বলে তাদের এই অনুমান তৈরি হয়েছে। তবে একটু খুঁটিয়ে দেখলে চলচ্চিত্রটিকে সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী (১৯৫৫) দ্বারা অনুপ্রাণিত মনে হতে থাকে। রুকুদের পরিবারের দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই, সদস্যসংখ্যা এবং ধরন, ভাইবোনের মধ্যে একজনের মৃত্যু, অতঃপর শহরমুখী যাত্রা- এমন সবকিছুর সঙ্গেই পথের পাঁচালী'র মিল আছে। বিশেষ করে রবিশঙ্করের সঙ্গীতায়োজনে গ্রামবাংলার প্রকৃতির যে চিত্রায়ণ তার সঙ্গেও এই চলচ্চিত্রের দৃশ্যায়নের বিশেষ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তবে পথের পাঁচালীতে চরিত্রগুলোর সম্পর্কের যে জটিল চিত্রায়ণ; তা এখানে অনুপস্থিত।
বিশ্বজুড়ে অতি উষ্ণায়ন আর অতিবৃষ্টির এই সময়ে প্রান্তিক এক দেশের আরও প্রান্তিক মানুষগুলোর প্রধান শত্রু প্রাকৃতিক দূর্যোগ আর তার তার মোকাবিলাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে এই চলচ্চিত্রের কাহিনী। প্রকৃতি আর দুর্যোগই তাই এই চলচ্চিত্রের খলনায়ক। এই ফোকাস থেকে পরিচালক একবারও দর্শককে বিচ্যুত হতে দেন না, কিংবা দিতে চান না। তাই কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া চলচ্চিত্রের প্রতিটি চরিত্রই অত্যন্ত সরলভাবে উপস্থাপিত। এখানে জীবনযাত্রা যতটাই জটিল, সম্পর্কগুলো ঠিক ততটাই সরল। সুলতানের সঙ্গে রুকুর মায়ের বিয়ে, সেই বিয়েতে রুকুর উপস্থিতি, রুকুর দাদার সম্মতি, নারী এবং পুরুষ কৃষকের প্রবল শ্রম- সবই কেবল একবেলা গিমা শাক, ছোট মাছ আর টকডাল দিয়ে এক শানকি ভাত খাওয়ার সমীকরণে আটকে থাকে। তবে এর মাঝেও কঠিন রাজনৈতিক প্রশ্ন উঁকি দিয়ে যায়, যখন কৃষক তার নিজ জমিতে ওঠা জলে মাছ ধরলে চোর হিসেবে সাব্যস্ত হন। সম্মুখীন হন পুলিশি বাধা, জেল-জরিমানার। অথবা যে দেশে বা জায়গায় কোনো ডিজিটাল সুবিধা নেই, নেই খাদ্যের যথেষ্ঠ জোগান- সেখানেও বহুজাতিক, ক্ষুদ্রঋণ আর রাষ্ট্রের পদচারণা আছে নিরঙ্কুশভাবেই, সেসব প্রশ্নও সমানে জারি রেখেছেন পরিচালক।
খুব সরল কথ্য ভঙ্গিতে গল্প আগায়। এখানে কিছু ইন্টেলেকচুয়াল মন্তাজের কাজ থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ের প্রচলিত বা অপ্রচলিত কমপ্লেক্স এডিটিং এর ধার ধারেননি তিনি। সহজ সরল মানুষের বয়ান সোজাসাপ্টা হাজির করেছেন। কিছু রোমান্টিক সিনিক ভিউ মধ্যবিত্ত দর্শককে চোখের আরাম দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু চলচ্চিত্র শেষে রুকুর মায়ের বাস্তুহারা হওয়ার হাহাকার নিয়েই ঘরে ফিরেছেন তারা। চারপাশে যখন ধুন্ধুমার পুলিশি পৌরুষ, মারামারি, ভায়োলেন্স নিয়ে গল্প বলার ছড়াছড়ি, তখন বিপন্ন সময়ের বিপন্ন মানুষের গল্প ক'জনাই বা বলতে পারে। ক'জনই বা এমন চলচ্চিত্রে লগ্নি করতে আগ্রহী হয়? ভাটি অঞ্চলের কৃষকের যাপিত জীবন নিয়ে এই প্রবল যান্ত্রিক সভ্যতায় মোহাম্মদ কাইয়ুম লাভ-ক্ষতির অঙ্ক না মিলিয়ে একদল নিবেদিত অভিনয় শিল্পী নিয়ে একটা গল্প বলে গেলেন এই বা কম কিসে। অভিনয়ে জয়িতা মহলানবীশকে কেনো জাতীয় পুরস্কার দেয়া হবে না- এমন প্রশ্ন তার অভিনীত প্রতিটি দৃশ্যে মনে জেগেছে। সেই যে মাকড়সার জালের সামনে ভাতের বলকের উল্টোপাশে বসে ঠোঁট ফুলিয়ে কান্নার দৃশ্যের হাহাকার খুব কম শিল্পীই পারবেন ফুটিয়ে তুলতে। অন্যদিকে উজ্জ্বল কবীর হিমুকে পুরো সময়জুড়ে গ্রামের বিভ্রান্ত আর সরল কৃষক বলেই ভ্রম হতে থাকে, নিজেকে ছাড়িয়ে তিনি যেন ঠিক সুলতানই হয়ে ওঠেন।
সবশেষে বলি, এমন বাস্তুহারা মানুষের গল্প দেখাবার জন্য বিজ্ঞাপনে বলতে হয়েছে, সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সিনেমাহলে চলচ্চিত্রটি প্রদর্শিত হচ্ছে। এটা আমাদের দৈন্যই বলতে হবে। এর বাইরে চলচ্চিত্র সংস্কৃতিকে বের করে আনা এখন কঠিন বলেই মনে হয়। তবুও মধ্যবিত্ত আর সাংস্কৃতিক এলিটদের বাইরে গিয়েও চলচ্চিত্রটি যাদের নিয়ে বানানো তাদের জন্য প্রদর্শনীর ব্যবস্থা হতে পারে, ঠিক তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদের মুক্তির কথা (১৯৯৯) চলচ্চিত্রটির মতো করেই। তাদের নিয়ে কেউ অন্তত ভেবেছে, এই বোধ তাদের সাহস দেবে। আবার তারাই তো সেই মানুষ, যারা প্রকৃত অর্থেই জানেন যে দূর্যোগে বাস্তুচ্যুত, ক্ষুধার্ত ও সর্বহারা মানুষের নগরান্তরিত হওয়ার ভয়ানক হাহাকারের ভার ঠিক কতটুকু।
Comments