চলচ্চিত্রের বিপ্লবী ঋত্বিক ঘটক

ঋত্বিক ঘটক। ছবি: সংগৃহীত

নদীর পাড় ভেঙে পড়ে, ব্রিজ-কালভার্ট ভেঙে পড়ে, বিল্ডিং ভেঙে পড়ে, ভেঙে পড়ে হাত থেকে পড়ে যাওয়া কাঁচের গ্লাসটাও। সবকিছুই হয়তো একসময় ভেঙে পড়ে, সব ভাঙনের একটা নিজস্ব শব্দও আছে। কেবল শব্দ নেই হৃদয় ভাঙনের, শব্দ নেই মানুষের ভাবাবেগের। যদিও আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ পায় মুখের ভাষায়, কান্নার সুরে, কখনো বা শব্দহীনতায়, চেহারার অভিব্যক্তিতে। তবুও প্রকাশের এসব মাধ্যম যেন কম পড়ে যায় সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়া, রাগ-অভিমান-ক্ষোভ, আর্তনাদ-হাহাকারের তীব্রতা বোঝাতে, কম পড়ে যায় বিদ্রোহ-বিপ্লব ঘটানোর জরুরি অবস্থা ঠিক কতটা জরুরি তা তুলে ধরতে।

১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে চলচ্চিত্রের আবির্ভাব মানুষের ভাবাবেগ প্রকাশের এক অনন্য মাধ্যম হিসেবে ধরা দেয়। তবে সেসময় চলচ্চিত্র ছিল নির্বাক। চলচ্চিত্রের ভাষা হয়ে উঠে ক্যামেরা, অর্কেস্ট্রার বাজনা এবং অভিনেতার অভিনয়। এরপর চলচ্চিত্রের ভাষা নতুনমাত্রা পায় সবাক চলচ্চিত্রের যুগে এসে অর্থাৎ ১৯২৭ সালে। মানুষের মনোভাবকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরার চেষ্টা খানিকটা সহজ হয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে চলচ্চিত্রের ভাষা মানুষের মনোভাব প্রকাশের শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠে। আর এই মোক্ষম হাতিয়ার বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একজন যথার্থই ব্যবহার করেছিলেন- আমাদের বাংলা চলচ্চিত্রের প্রবাদপুরুষ 'ঋত্মিক ঘটক'।

আজ ৪ নভেম্বর, চলচ্চিত্রের বিপ্লবী কবি ঋত্বিক কুমার ঘটকের জন্মদিন।

সিনেমার ব্যাপারে ঋত্বিক বলেছেন, 'আমি প্রতি মুহুর্তে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে বোঝাব যে, এটা কোনো ভেবে বের করা গল্প নয়।' কিংবা 'আমি আপনাকে সস্তা আনন্দ দিতে আসিনি। সিনেমার কাজ মন যোগানো না, মন জাগানো। ফিল্ম মানে ফুল নয়, অস্ত্র।'

ঋত্বিকের ঘটকের মনে দেশভাগ যে দাগ কেটেছিল, তার প্রকাশ আমরা তারই পরিচালিত 'মেঘে ঢাকা তারা', 'কোমল গান্ধার', 'সুবর্ণরেখা' ইত্যাদি চলচ্চিত্রে দেখতে পাই। একইসঙ্গে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন মানব মনের বিচিত্র অনুভূতি।

'মেঘে ঢাকা তারা' সিনেমার দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত

'তিতাস একটি নদীর নাম', 'অযান্ত্রিক', 'নাগরিক', 'বাড়ি থেকে পালিয়ে', 'যুক্তি তক্কো আর গপ্পো' ইত্যাদি চলচ্চিত্রে চিত্রিত করেছেন আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার নগ্ন দৃশ্য। আর এসব সম্ভব হয় তখনই যখন একজন পরিচালক চলচ্চিত্রের ভাষা নিপুণভাবে সৃষ্টি করেন।

আবার, যেকোনো ভাষা শক্তিশালী হয়ে উঠে ব্যবহৃত শব্দের মাধ্যমে। একটি চলচ্চিত্রে নির্মাতারা ৫ ধরনের শব্দ ব্যবহার করে থাকে সাধারণত- কথা/সংলাপ, সঙ্গীত, দৃশ্যমান ঘটনার পরিপূরক শব্দ, দৃশ্যোর্ধ্ব দ্যোতনাময় শব্দ এবং নীরবতা। ঋত্মিকের কাছে নীরবতা সবচেয়ে বেশি সংকেতবহ উপাদান, যা দৃশ্যের লয়-গতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে আবার আবেগহীনতাও প্রকাশ করতে পারে। শব্দ নিয়েও দারুণ খেলেছেন ঋত্বিক। দুই বাংলার মিলনে তিনি বাজিয়েছেন প্রাচীন বিবাহের সুর, পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে বাঁচতে চাওয়ার আর্তনাদ ফুটিয়ে তুলেছেন ধ্বনি-প্রতিধ্বনির মাধ্যমে। তার পরিচালিত চলচ্চিত্রের মধ্যে শব্দের একটা ধাঁচ আছে।

সেই ধাঁচ চলচ্চিত্রকে করে তুলেছে শৈল্পিক। আর উল্লেখ্য সব বিশেষণ ঋত্বিক ঘটককে বিশেষায়িত করেছে 'বিপ্লবী পরিচালক' হিসেবে।

Comments

The Daily Star  | English

What if the US election ends in a Trump-Harris tie?

While not highly likely, such an outcome remains possible, tormenting Americans already perched painfully on the edge of their seats ahead of the November 5 election

3h ago