পাশ্চাত্য ও শাস্ত্রীয় সংগীতের মেলবন্ধন ব্যান্ডদল ‘শক্তি’

ব্যান্ডদল 'শক্তি'। বাম থেকে- তবলাবাদক ভি সেলভাগণেশ, গায়ক শঙ্কর মহাদেবন, গিটারিস্ট জন ম্যাকলফলিন, বেহালাবাদক গণেশ রাজাগোপালন ও তবলাবাদক ওস্তাদ জাকির হোসেন। ছবি: সংগৃহীত

লন্ডনের গ্রিনিচে ছোট্ট একটি দোকানে জ্যামিং সেশন চলছিল। অনেকগুলো বাদ্যযন্ত্র, সবকটিতেই সঙ্গীতের কোনো না কোনো ধাঁচের সুর বাঁধছে। একদিকে শুধু বই আর বই। কাঠের পাটাতনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ক্যাসেটে। ছিমছাম দোকানটিতে নিয়মিত আসতেন মধ্যবয়সী জন ম্যাকলফলিন। জ্যাজ ও ব্লুজ মিউজিকের শিল্পী হিসেবে বেশ নাম-ডাক তার। ৬ ফিট উচ্চতার এই ভদ্রলোকের আগ্রহ ভারতের ধ্রুপদী সঙ্গীত নিয়ে। তাই এ বিষয়ে আরও জানতে ও শিখতে আসতেন এই দোকানে। তাকে ভারতীয় সঙ্গীত নিয়ে দীক্ষা দিতেন ২০-২২ বছর বয়সী এক তরুণ। পেশায় একজন তবলাবাদক।

ভাবের আদান প্রদানের পাশাপাশি দফায় দফায় চলতো আড্ডা আর সঙ্গীতের চর্চা। একদিকে গিটারের ছন্দ সেই তালে তবলা। ২০-২২ বছরের এই তবলাবাদকের নাম জাকির হোসেন। তিনি ওস্তান আল্লা রাখা খানের ছেলে। ১৯৭১ সালে তিনিই পন্ডিত রবি শঙ্কর আর জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে মিলে করেছিলেন "কনসার্ট ফর বাংলাদেশ"।

ধ্রপদী সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহ আর বিরতির মাঝে জ্যামিং সেশন জন ম্যাকলফলিনকে দিলো নতুন ধারণা। তিনি ভাবলেন, কেমন হয় যদি পৃথিবীর দুই দিকের দুই সঙ্গীত ধারা এক সঙ্গে সুর বাধে? যেমন ভাবা তেমনই কাজ।

এভাবেই যাত্রা শুরু ব্যান্ডদল 'শক্তি'র।

ব্যান্ডটির নাম 'শক্তি' কেন?

শক্তির যাত্রার আগেই 'মহা বিষ্ণু অরকেস্ট্রা' নামে জন ম্যাকলফলিন আরেকটি ব্যান্ড গড়েছিলেন। কিন্তু সেই ব্যান্ডটি বেশিদিন এগিয়ে যেতে পারেনি। ফলে ১৯৭৩ সালে গঠিত হয় শক্তি। এই ব্যান্ডে মৃদঙ্গম বাদক হিসেবে যুক্ত ছিলেন রামনাথ রাঘবন, ভায়োলিন বাদক হিসেবে এল. শঙ্কর ও ঘুমট বাদক হিসেবে বিক্কু বিনয়াক্রম। তাদের সঙ্গে মিললেন ওস্তাদ জাকির হোসেন আর এভাবেই জ্যাজ ধারার সঙ্গীতের সুরে যুক্ত হলো কর্নাটাক মিউজিকের তাল। দুটি ভিন্ন ধারা ও সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন থেকে তারা শক্তির মতো দেখেছেন ফলে ব্যান্ডটির নাম হয়েছে শক্তি।

শক্তির যাত্রা

১৯৭৩ সালে যাত্রা শুরু করে মাত্র তিন বছরের মধ্যেই জনপ্রিয়তা পায় শক্তি।

ততদিনে ওস্তাদ জাকির হোসেন ও জন ম্যাকলফলিন কয়েকটি শোও সেরে ফেলেছেন। তাদের প্রথম দিককার সৃষ্টির মধ্যে জনপ্রিয় ছিল, 'জয়', 'ইন্ডিয়া' 'টু সিস্টার্স', 'মাইন্ড ইকোলজি' ও 'ফেইস টু ফেইস'সহ আরও অনেকগুলো গান। ফিউশন ঘরানার সঙ্গীতের মধ্যে এগুলো আলাদা জায়গা করে নেয়। যার ফলে কার্লোস সান্তানা শক্তির সঙ্গীতকে তার শোনা সবচেয়ে 'ইনটেন্স' বা গম্ভীর মানের সঙ্গীত বলে আখ্যায়িত করেন।

১৯৭৮ সালে এই ব্যান্ড ভেঙে যায়। কোনো ব্যক্তিগত আক্রোশের জন্য নয় বরং ব্যান্ডের সদস্যদের ব্যস্ততার জন্য। এর মধ্যে ওস্তাদ জাকির হোসেন ফিউশন সঙ্গীতের পাশাপাশি সান ফ্রানসিসকো শহরে আলী আকবর কলেজে শিক্ষকতাও করতেন। আবার ব্যান্ড সঙ্গীতের জন্য তিনি যেন হিন্দুস্তানি ক্ল্যাসিকাল ভুলে না যান সেজন্য উদ্বিগ্ন থাকতেন তার বাবা আল্লা রাখা খান। এদিকে বিনয়াক্রমের বাবা মারা যান এসময়েই। সব মিলিয়ে ব্যান্ডের কাজের গতি ধীরে ধীরে কমে আসে। তবে এর মাঝে শক্তি মিউজিক ট্যুর করে, প্রকাশ করে তিনটি অ্যালবাম। সেই অ্যালবামগুলো 'শক্তি উইথ জন ম্যাকলফলিন', 'আ হ্যান্ডফুল অব বিউটি' ও 'ন্যাচারাল ইলিমেন্টস'।

ব্যান্ডটি ভেঙে যাবার পরও ১৯৮০ এর দশকে বিভিন্ন লাইন আপের সঙ্গে গান তৈরি করে যায় শক্তির জাকির হোসেন ও জন ম্যাকলফলিন। এর মধ্যে ড্রামার ত্রিলোক গুরুর সঙ্গে ১৯৮৫ সালে 'সং ফর এভরিওয়ান' ও ১৯৮৭ সালে পন্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া 'মেকিং মিউজিক'।

নতুন রূপে 'শক্তি' যুক্ত হলেন শঙ্কর মহাদেবন

১৯৯০ এর দশকের শেষেও ট্যুর করে এই ব্যান্ড। এর মধ্যে ৯৭ সালে রিইউনিয়ন নামের ট্যুরটিতে এল. শঙ্করকে পুনরায় পেতে চান জন ম্যাকলফলিন। তিনি কোনো উত্তর না দেওয়ায় পন্ডিত চৌরাসিয়াকে নিয়েই ট্যুর সম্পন্ন করেন তারা।

জন ম্যাকলফলিন মনে করলেন ইনস্ট্রুমেন্টাল ঘরানার এই ব্যান্ডে একজন ভোকলিস্টের প্রয়োজন। জাকির হোসেন ভারতে ফিরলে তার সাথে দেখা হয় শঙ্কর মহাদেবনের সঙ্গে যিনি বলিউডের বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক তো বটেই একইসঙ্গে একজন দক্ষ ধ্রপদী ধারার সঙ্গীত শিল্পীও। শঙ্কর মহাদেবন তার রেকর্ড করা গান জন ম্যাকলফলিনকে পাঠান। জন ম্যাকলফলিন শুনে মুগ্ধ হয়ে সঙ্গে সঙ্গেই শঙ্কর মহাদেবনকে ফোন করেন। এরপর ১৯৯৯ সাল থেকে তিনিও শক্তির অংশ হয়ে যান।

বিশ্ব সঙ্গীতে ফিউশনের শক্তি

ব্যান্ড হিসেবে শক্তি কেন এত শক্তিশালী? ১৯৬০ এর দশকে পপ সঙ্গীতের উত্থানের সাথে সাথে জ্যাজ ধারার সঙ্গীত জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে। তখন জ্যাজের সঙ্গে পপ বা ব্রাজিলিয়ান ফোক ধারার সঙ্গীতের মিশ্রণ বাজারে আসতে শুরু করে।

ফলে সেগুলো ক্রমেই জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। একই সঙ্গে সেসময় ভারতী ধ্রুপদী সঙ্গীত, যা পশ্চিমা যেকোনো ধারা থেকে একেবারেই ব্যতিক্রম জায়গা করে নিতে শুরু করে। ফলে জ্যাজের সঙ্গে ভারতীয় ধ্রুপদীর এমন মিশ্রণ গোটা সঙ্গীত জগতেই এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনে। সানাই বাদক ভারতরত্ন ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান লন্ডনের কুইন্স এলিজাবেথ হলে তার কনসার্টে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন এর কিছু অংশ এমন যে 'মওলানারা কুরআন মজিদ পড়ান, পুরোহিতরা গীতা-রামায়ন, বাইবেলওয়ালারা তাদের বিষয়। সবাই ভিন্ন, কিন্তু করে প্রার্থনা একজনের। আর আমরা বলি, ষড়জ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত, নিষাদ। দুনিয়ার কেউ বলুক আটটি সুর। সঙ্গীত উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম সবখানে এক'- ব্যান্ডদল 'শক্তি' এই সর্বজনীন বিষয়টিই ধারণ করে।

এ বছর মর্যাদাপূর্ণ সঙ্গীত পুরস্কার গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড জিতেছে 'শক্তি'র অ্যালবাম 'দিস মোমেন্ট'। সেরা গ্লোবাল মিউজিক অ্যালবাম হিসেবে গ্র্যামি জেতে ব্যান্ডদল শক্তি।

Comments

The Daily Star  | English

Ending impunity for crimes against journalists

Though the signals are mixed we still hope that the media in Bangladesh will see a new dawn.

15h ago