নিষিদ্ধ থাকাকালে অনেক মূল্যবান বই পড়েছি: কনকচাঁপা

কনকচাঁপা। ছবি: সংগৃহীত

দেশের খ্যাতিমান কণ্ঠশিল্পী কনকচাঁপা তিনবার পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র  পুরস্কার। তারপরও দীর্ঘদিন বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় সব অনুষ্ঠানে তাকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। এমনকি দেশে স্টেজ শো করতেও বাধা দেওয়া হয়েছে তাকে।

ছাত্র-জনতার সফল গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। দর্শকনন্দিত এই কণ্ঠশিল্পী কথা বলেছেন তার বিশ্বাস, রাজনীতি, সংগীত নিয়ে। সেই সাক্ষাতকারের অংশবিশেষ দ্য ডেইলি স্টারের পাঠকদের জন্য।

কনকচাঁপা। ছবি: সংগৃহীত

দ্য ডেইলি স্টার: দীর্ঘদিন টেলিভিশন, বেতার বা স্টেজে ছিলেন না। এ বিষয়গুলো নিয়ে আপনার ভাবনা কী?

কনকচাঁপা: আমার রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে পুরো সাত বছর নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলি, করোনা মহামারি আমাকে অনেক শিক্ষা দিয়েছিল। আমি বুঝেছিলাম, অনেক কাপড় না থাকলেও বাঁচা যায়। অনেক খাবার, বিলাসিতা খুবই অন্যায় এবং নিবিড়ভাবে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর শান্তিই সত্যিকারের শান্তি।

ঠিক তেমনি এই যে আমার শিল্পী সত্ত্বাকে আটকে দিলো, তাতে আমার অনেক উপকার হয়েছে। জন্মের পর থেকেই গানের সঙ্গে বেড়ে উঠেছি। নিজেকে দেখার ফুসরত হয়নি বলা চলে। কোন কোন গান গেয়েছি, সেটা গাওয়া আসলে দরকার ছিল কি না, তাও ভাবার সময় পাইনি। সত্যিকার অর্থে কিছু ভাবার, কিছু শোনার সময় পেয়েছি বিভিন্ন জার্নির ফ্লাইটে। পরিবারের সবার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে তাদের লেখা চিঠি পড়তাম ফ্লাইটে।

বাস্তব জীবনে আমার কোনো ব্যক্তিগত সময়ই ছিল না। এই নিষিদ্ধ থাকাকালে আমি অনেক মূল্যবান বই পড়েছি। গান যা গাওয়ার তা তো গেয়ে ফেলেছি। এখন আমাকে আটকে রেখে কী লাভ? আমার গান আকাশে বাতাসে ভাসে। কোনো টিভি চ্যানেলে বাজলেই কী, না বাজলেই কী!

জীবনে কখনো অসুস্থ ইঁদুর দৌড়ে দৌড়াইনি। এই ফাঁকে মায়ের যত্ন বেশি করে নেওয়ায় মন দিয়েছি। স্বামী-সন্তানদের সময় দিয়েছি।

ডেইলি স্টার: এই অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই অনেক পীড়া দেয়?

কনকচাঁপা: দেশ আমাকে সারাজীবনই অবহেলা করেছে। বড় বড় স্টেজ প্রোগ্রামে খুবই কম ডাক পেয়েছি। জীবনে একবারও সরকারি সফরে ডাকা হয়নি। এগুলোতে আমি অভ্যস্ত। জাতীয় পুরস্কারের জুরি বোর্ড জানে নিশ্চয়ই, আমাকে কতবার পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

যদিও তিনবার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছি, কিন্তু দর্শক জানে কতগুলো গানে আমাকে তারা পুরস্কার পাওয়া থেকে বঞ্চিত রেখেছে। আফসোস নেই। ইদানীং এই পুরস্কার এত নিচে নেমেছে যে আমি পাইনি বলে উল্টো আনন্দিতই হয়েছি। মানুষের ভালোবাসাই আমার শক্তি।

কনকচাঁপা। ছবি: সংগৃহীত

ডেইলি স্টার: ছাত্র-জনতার বিজয় নিয়ে আপনার অভিমত কী?

কনকচাঁপা: আল্লাহর পরে বরাবরই আমার সব ভরসা যুবসম্প্রদায়ের ওপর। তারাই শক্তি, তারাই বল। অকুতোভয়, অনন্য সাধারণ। দেখিয়ে দিলো তারা ঘুমায় না। মধ্যবয়সী মানুষ সহ্য করতে করতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেও দম আটকে চুপ থেকেছে। কিন্তু যুবসম্প্রদায় দেখিয়ে দিলো যে অন্যায় সহ্য করাও অপরাধ।

আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বারবার বলতাম, রাত যত গভীর হয় ভোর তত কাছে আসে। সত্যিই তারা একটা নতুন ভোর এনে দিলো জীবন দিয়ে!   আল্লাহ তাদের উত্তম প্রতিদান দিন। এই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি এবং তাদের প্রতি আমার ততটাই শ্রদ্ধা, যতটা আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি জানাই।

ডেইলি স্টার: রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার ইচ্ছা আছে?

কনকচাঁপা: আমি মানবতার সেবা করে যাবো, যেভাবে সারাজীবন করেছি। এরচেয়ে বেশি কিছু বলার নেই। রাজনৈতিক পটভূমি অনেক বড় জায়গা। এখানে কাজ করার মতো, অথবা তারচেয়েও বেশি সততা, ভালোবাসা আমার আছে। কিন্তু আমি রাজনৈতিক মনস্ক মানুষ, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নই।

আমি বুঝতে পেরেছি একজন দুঁদে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কতটা জ্ঞান রাখেন। আমি মূর্খের মতো কাজ করতে চাই না। এই বিষয়ে বিষদ পড়াশোনা করা দরকার।

আমি পুরোপুরি বাংলাদেশের কনকচাঁপা হতে চাই। আমি মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে মানুষের সেবা করবো। তবে, সাধারণ মানুষ যদি আমাকে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে দেখতে চান, তখন সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে তা পালন করার চেষ্টা করবো।

ডেইলি স্টার: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে কণ্ঠশিল্পী হিসেবে আপনার প্রত্যাশার কী?

কনকচাঁপা: নতুন সরকারের কাছে মিথ্যাচার মুক্ত বাংলাদেশ চাই। আমি চাই দ্রব্যমূল্য সহনশীল থাক, আয়ের শুরুতেই উপযুক্ত ট্যাক্স অটোমেটিক কেটে রাখুক, ঘুষের কোনো জায়গায় না থাকুক, চাঁদাবাজি বন্ধ হোক।

আর একটা স্বপ্ন খুব দেখি, সেটা হলো—আমাদের দেশের ভিআইপিরা যেমন একটা সম্মানিত লাউঞ্জ ব্যবহার করেন, তেমনই আলাদা একটা লাউঞ্জ তৈরি করে দিতে হবে প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য। বৃদ্ধদের জন্য বরাদ্দ ভাতা যেন বৃদ্ধরাই পান। সব ধর্ম-মতের মানুষ যেন তাদের পরিপূর্ণ অধিকার নিয়ে এ দেশে বাস করতে পারেন নিশ্চিন্তে।

আমি আরও চাই সুবিধাবঞ্চিত শিশু, সংখ্যালঘু শব্দগুলো আমাদের অভিধান থেকে, ভাষা প্রায়োগিক দিক থেকে একদম উঠে যাক। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রয়োজন মতো, স্বস্তিতে ব্যবহার করার মতো টয়লেট থাকতে হবে এবং সেখানে সাবান ও স্যানিটারি টাওয়েল থাকবে। আমার এই আশাগুলো পূর্ণ করুন, এটাই এই সরকারের কাছে চাওয়া।

ডেইলি স্টার: চলতি সময়ের গান নিয়ে কী ভাবছেন? গানের সুদিন ফিরবে কবে?

কনকচাঁপা: গান তো হচ্ছেই। শিল্পী নিজেই সেটা পোস্ট দিচ্ছেন। অন্যদের ট্যাগ করছেন। সেগুলো আইডিতে মাইল মাইল লম্বা হয়ে দৃশ্যমান হচ্ছে। তাতে শিল্পী তৃপ্ত হচ্ছেন।

এদিকে ইউটিউবে মিলিয়ন-বিলিয়ন ভিউ হচ্ছে! তাতেই পুরো গানের জগৎ অতি সন্তুষ্ট! এই সন্তুষ্টিই গান অন্যত্র চলে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে আমি মনে করি।

এই মিলিয়ন-বিলিয়ন ভিউয়ের লড়াই-বড়াইয়ের চড়াই-উৎরাই পার হয়ে যেদিন  সত্যিকারের গানের পিপাসা মিটানোর কাজে হাত দেবে আমাদের দেশের তারকারা, সেদিন গান আগের জায়গায় অথবা বলা যায় তার নিজের জায়গায় তৃপ্তি সহকারে চুপটি করে বসবে। তার একদিন আগেও গানের সুদিন ফিরবে না।

Comments

The Daily Star  | English

Depositors leave troubled banks for stronger rivals

Depositors, in times of financial uncertainty, usually move their money away from troubled banks to institutions with stronger balance sheets. That is exactly what unfolded in 2024, when 11 banks collectively lost Tk 23,700 crore in deposits.

10h ago