রক কিংবদন্তি শাফিন আহমেদের জন্য শোকগাঁথা

মাইলসের সাবেক বেইজ গিটারিস্ট ও ভোকাল শাফিন আহমেদ। ছবি: শেখ মেহেদী মোর্শেদ/স্টার
মাইলসের সাবেক বেইজ গিটারিস্ট ও ভোকাল শাফিন আহমেদ। ছবি: শেখ মেহেদী মোর্শেদ/স্টার

সংগীতশিল্পী শাফিন আহমেদ ভক্তদের কাছে ব্যান্ড সংগীতের অনুকরণীয় একজন শিল্পী। একাধারে তিনি সুরকার, সংগীত পরিচালক, বেজ গিটারিস্ট, সংগীতশিল্পী ও শ্রোতাপ্রিয় ব্যান্ড 'মাইলস' এর অন্যতম সদস্য।

১৯৭৯ সালে  মাইলস ব্যান্ডের সূচনা হয় ফরিদ রশীদের হাত ধরে। তার কিছুদিন পর শাফিন, হামিন দুই ভাই ব্যান্ডে যোগ দেন। তার দুই বছর পর মানাম আহমেদ ব্যান্ডে যোগ দেন। এরপর মাইলসে যোগ দিয়েছেন সৈয়দ জিয়াউর রহমান তূর্য ও ইকবাল আসিফ জুয়েল। মাইলসের ৮৪টি গানের মধ্যে ৪৬টি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন শাফিন আহমেদ। এর মধ্যে ১৩টির সুর করেছেন ব্যান্ডটির কিবোর্ডিস্ট মানাম আহমেদ। বাকি গানগুলোর সুর করেছেন শাফিন আহমেদ।

১৯৬১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি জন্ম শাফিন আহমেদের। তার মা কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী ফিরোজা বেগম এবং বাবা সংগীতজ্ঞ কমল দাশগুপ্ত। যুক্তরাজ্যে পড়াশুনার সুবাদে পাশ্চাত্য সংগীতের সংস্পর্শে আসেন। দেশে ফিরে এসে মাইলস ব্যান্ডে যোগ দেন তিনি।

শাফিন আহমেদের কণ্ঠে শ্রোতাপ্রিয় গানের তালিকায় একক অ্যালবাম  ও মাইলসের গানের তালিকায় রয়েছে-

'চাঁদ তারা সূর্য', 'প্রথম প্রেমের মতো', 'গুঞ্জন শুনি', 'সে কোন দরদিয়া', 'ফিরিয়ে দাও', 'ধিকি ধিকি', 'পাহাড়ি মেয়ে',  'কি যাদু', 'কতকাল খুঁজব তোমায়', 'হৃদয়হীনা', 'স্বপ্নভঙ্গ', 'জ্বালা জ্বালা', 'শেষ ঠিকানা', 'পিয়াসী মন', 'বলব না তোমাকে', 'জাতীয় সঙ্গীতের দ্বিতীয় লাইন', 'আজ জন্মদিন তোমার', 'প্রিয়তমা মেঘ' গানগুলো।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শাফিন। ছবি: সংগৃহীত
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শাফিন। ছবি: সংগৃহীত

২০১৯ সালে মাইলসের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এক প্রেসমিট অনুষ্ঠিত হয় দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারে। প্রেসমিট শেষে শাফিন আহমেদের সঙ্গে কথোপকথনে তার মা কিংবদন্তি শিল্পী ফিরোজা বেগম সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে শাফিন বলেন, 'আমার মায়ের কাছ থেকে গান শেখার সৌভাগ্য হয়েছে। ছোটবেলায় কিছু নজরুল সংগীত শিখেছি। আমার আব্বার সুরের কিছু পুরনো দিনের গান শিখেছি। মাকে দেখেছি তিনি তার শোর আগে কীভাবে প্রস্তুতি নিতেন। কীভাবে গানের গলা ঠিক রাখার চর্চা করতেন। ছোটবেলা থেকে কখনো গানের বিষয়ে আমাকে বাধা দেননি। বড়বেলায় যখন গান করতাম তখন আমার কিছু গান মায়েরও পছন্দ ছিল। আমি ফিরোজা বেগমের সন্তান হয়ে গর্ববোধ করি।'

তারপরে শাফিন আহমদের জন্মদিনে আত্মজীবনী বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে দ্য ডেইলি স্টারকে শাফিন বলেন, 'আমি তো বহু বছর নিজের জীবনটাকে আড়ালে রেখেছিলাম। শুধুমাত্র সংগীতজগতটাই মানুষের নলেজে ছিল। সংগীত জীবনের পঞ্চাশ বছর চলে যাওয়ার পরে, এই পর্যায়ে এসে মনে হলো নিজের জীবনটা তুলে ধরার সবচেয়ে ভালো সময় এখন। সবার জীবন এক রকম হয় না। আমার জীবনে অনেক ঘটনা জড়িয়ে রয়েছে। অনেক কিছুই না বলা রয়ে গেছে। আমার একটা আত্মজীবনী লেখা হচ্ছে। সেখানে সব যে বলেছি তা নয়। তবে অনেককিছু থাকবে সেখানে।'

সংগীতশিল্পী ও সুরকার শাফিন আহমেদ বৃহস্পতিবার ভোর ৬টায় আমেরিকার ভার্জিনিয়ার একটি হাসপাতালে মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর।  

মানাম আহমেদ, সুরকার ও মাইলস ব্যান্ডের সদস্য

মানাম আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত
মানাম আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

কী বলবো শাফিন আহমেদ নিয়ে তার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। আমার সুর করা গানগুলো শাফিনের কণ্ঠে সবচেয়ে বেশি সুরেলা হয়ে উঠেছিল। নিজেকে পরিচিত করেছিল আমার সুর করা গানগুলো গেয়ে। তার মধ্যে আমার সুর করা  'ধিকিধিকি', 'চাঁদতারা সূর্য,' 'জ্বালা জ্বালা' গানগুলো দিয়েই বেশি শ্রোতাপ্রিয়তা পেয়েছিল। এই গানগুলোই তার পরিচয়, মাইলস ব্যান্ডের শ্রোতাপ্রিয় গান।

আমি মূলত মাইলস ব্যান্ডে জয়েন করি ব্যান্ড হওয়ার ৩ বছর পর, ৮২ সালের দিকে। তারপর দীর্ঘদিন এই ব্যান্ডের সঙ্গে আছি। আমাদের হাজারো স্মৃতি জমা আছে। কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলি? প্রতিটি শোয়ের আগে আমাদের আনন্দে কাটতো প্র্যাকটিস সেশনে। সেই স্মৃতি ফিরে ফিরে আসছে আমার মনে। আর কষ্ট পাচ্ছি।

মাইলস ছাড়া শাফিন আহমেদের একক গান করেছি। তার জনপ্রিয় গানগুলো ছাড়াও তার অনেক গান আছে, যে সব গানের কথা অনেকেই জানেন না। 'পিয়াসী মন'। 'এসোনা', 'প্রিয়তমা মেঘ' নামে গান আছে তার কণ্ঠে। আমার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না শাফিন আর নেই।

ফাহমিদা নবী, সংগীতশিল্পী

ফাহমিদা নবী। ছবি: সংগৃহীত
ফাহমিদা নবী। ছবি: সংগৃহীত

শাফিন ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে এক রকম চুপ হয়ে আছি। শিল্পীরা এমনিতে খুব অভিমানী হয়। অনেক যন্ত্রণা বুকে নিয়ে চুপ থাকেন শিল্পীরা। শাফিন ভাইয়ের গান, স্টাইল, ফ্যাশন সচেতনতা খুব টানত। এছাড়া  আলাদা ব্যাপার ছিল তার গানগুলোর মধ্যে। তার বাবা সংগীতজ্ঞ কমল দাশগুপ্ত, মা ফিরোজা বেগমের গানের প্রভাব ছিল তার কণ্ঠে। তার গান শুনতে শুনতে কয়েকদিন আগেই আমার মা এই কথাটি বলেছিলেন।

তার সুর করা 'ব্যথার শ্রাবণ' নামে একটা  গান কিছুদিন আগে আমার হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়েছিলেন শাফিন ভাই। গানটা আমার কণ্ঠে ভালো যাবে এমন বলেছিলেন তিনি। কিন্তু, তার সুরকরা গানটা আর আমার কণ্ঠে ধারণ করা হলো না। এই কষ্টটা আমার থেকে যাবে অনেকদিন। আমি টেলিভিশনে 'সুরের আয়না' নামে একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতাম। সেখানে দুইবার অতিথি হয়ে এসেছিলেন তিনি। সংগীত নিয়ে অনেক ভাবনার কথা জেনেছিলাম। গানের মধ্য দিয়েই তিনি বেঁচে থাকবেন এটাই আমার বিশ্বাস।

লতিফুল ইসলাম শিবলী, গীতিকার

লতিফুল ইসলাম শিবলী। ছবি: সংগৃহীত
লতিফুল ইসলাম শিবলী। ছবি: সংগৃহীত

শাফিন ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে একটা ঘোরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। অনেক স্মৃতি এসে এলোমেলো করে দিয়ে যাচ্ছে। ব্যান্ড তারকা আইয়ুব বাচ্চু ভাইয়ের পর তার চলে যাওয়া একটা বড় শুন্যতা তৈরি করবে ব্যান্ড সংগীতে। আমি  মাইলসের জন্য খুব বেশি গান লিখিনি। তার কারণ আমার গান লেখার ধরন অন্যরকম ছিল, কিন্তু শাফিন ভাইয়ের সঙ্গে মধুর একটি সম্পর্ক ছিল। দেশের সংগীতে রক আইকন বলতে যা জানি,  তাকে আমার তাই মনে হতো। সেই ৯০ দশক থেকে তাদের ফ্যাশন, লাইফস্টাইল, বাজানোর স্টাইল অনুকরণ করতো লাখো তরুণ। আমৃত্যু এই ফ্যাশনবোধ ধরে রেখেছিলেন তিনি। ব্যান্ড সংগীতের একজন কিংবদন্তি শাফিন আহমেদ। তার একক 'পাগলা ঘণ্টি' অ্যালবামের বেশিরভাগ গান আমি লিখেছিলাম। তবে আমার লেখা 'হ্যালো ঢাকা' ও 'পলাশীর প্রান্তর' গান দুইটির কথা বেশি বলে শ্রোতারা। অন্য শিল্পীরা যেখানে চুপ থাকতেন সেখানেও শাফিন ভাই দেশের সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো নিয়ে কথা বলতেন। নিজের ফেসবুকে লিখতেন। এখানেও অন্যদের চেয়ে আলাদা ছিলেন অনন্য ছিলেন।

রনিম রহমান, গীতিকার

রনিম রহমান। ছবি: সংগৃহীত
রনিম রহমান। ছবি: সংগৃহীত

আমাকে হাতে ধরে গান লেখার জগতে নিয়ে এসেছেন শাফিন ভাই। মূলত, এর আগে আমি ছড়া-কবিতা লিখতাম।  ৯৮ সালে তার একক 'ছবি আর স্মৃতি গুলো' অ্যালবামে  'রাজকুমারী' নামে একটা গান লেখার মাধ্যমে আমার গান লেখার সূচনা হয়। তবে আমার লেখা 'জাতীয় সংগীতের দ্বিতীয় লাইন' গানটি শাফিন ভাইয়ের কণ্ঠে ব্যাপক শ্রোতাপ্রিয়তা পেয়েছিল। গানটি 'মাইলস' ব্যান্ডের 'প্রতিধ্বনি' অ্যালবামে ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। এই গান ছাড়া আমি 'কেঁপে উঠে মন', 'মন চাই' শিরোনামে গানগুলো লিখেছি শাফিন ভাইয়ের জন্য।

 

Comments

The Daily Star  | English

No place for Islamic extremism in Bangladesh: Yunus

Islamic extremism will never find a place in Bangladesh again, said Chief Adviser Muhammad Yunus recently

49m ago