নেপথ্যের কারিগর

বউ সাজিয়ে হাত পাকানো আতিয়া এখন ‘দেশসেরা’ প্রস্থেটিক মেকআপশিল্পী

আতিয়া রহমান
আতিয়া রহমান। ছবি: সংগৃহীত

ওটিটিতে দুই বাংলায় সাড়া ফেলে দিয়েছিল সৈয়দ আহমেদ শাওকীর 'কারাগার'। সিরিজটিতে 'রহস্যমানব'রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন চঞ্চল চৌধুরী। প্রথম সিজনের পুরোটাজুড়ে দেড়শ বছরের পুরনো এক কয়েদির থেকে চোখ ফেরাতে পারেনি দর্শক। এমনই তার সাজসজ্জা ছিল যে অবিশ্বাস করার উপায় ছিল না। পর্দায় চঞ্চল অভিনীত চরিত্রটিকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে যিনি উপস্থাপন করেছেন তিনি আতিয়া রহমান, দেশসেরা প্রস্থেটিক মেকাপশিল্পী।

পর্দায় যা দেখে সেটাই মনে রাখে দর্শক, নেপথ্যের নায়কদের গল্প বেশিরভাগ সময়ই আড়ালেই থেকে যায়। নেপথ্যের কারিগর আতিয়া রহমান তার সাফল্যের গল্প বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারকে।

শখের বসে এক সময় বউ সাজাতেন তিনি। সেখান থেকে কীভাবে হয়ে উঠেছেন দেশসেরা প্রস্থেটিক মেকআপশিল্পী, বলেছেন সেই গল্প।

‘সাবরিনা’র জন্য নাজিয়া হক অর্ষার প্রস্থেটিক মেকআপ করছেন আতিয়া
‘সাবরিনা’র জন্য নাজিয়া হক অর্ষার প্রস্থেটিক মেকআপ করছেন আতিয়া। ছবি: সংগৃহীত

এ বছর 'ব্লেন্ডার্স চয়েস-দ্য ডেইলি স্টার ওটিটি অ্যান্ড ডিজিটাল কনটেন্ট অ্যাওয়ার্ড' এ সেরা মেকআপ আর্টিস্টের পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। মনোনয়ন পেয়েছিলেন ওয়েব সিরিজ 'কারাগার' ও 'সাবরিনা'র জন্য, পুরস্কার পেয়েছেন 'কারাগার' এর জন্য।

আতিয়া বললেন, 'বরাবরই স্বপ্ন দেখেছি একটু আলাদা কিছু করার। চেয়েছি এমন পেশা বেছে নিতে, যেটা আমাকে স্বতন্ত্র একটা পরিচয় এনে দিবে। আমার সেই স্বপ্নপূরণ হয়েছে।'

আতিয়া শোবিজে আসেন ২০১৩ সালে, নির্মাতা কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে। ডোপ প্রডাকশনের বিজ্ঞাপনচিত্রে প্রথমবার সুযোগ পান।

আতিয়া বলেন, 'কাজ করতে গিয়ে সবার প্রথমে যে বিষয়টা খেয়াল করলাম, মেকআপের ক্ষেত্রটা পুরুষের দখলে। মেকআপম্যান থেকে মেকআপ আর্টিস্ট হয়ে ওঠার জার্নিটা মোটেও সহজ ছিল না।'

রূপসজ্জা বা মেকআপে হাতেখড়ি কীভাবে? প্রশ্নটার উত্তর দিতে গিয়ে বেশ নস্টালজিক হয়ে ওঠেন আতিয়া। ফিরে যান ফেলে আসা অতীতে, 'আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকাতেই। নাটোরে আমার নানু বাড়ি। যখনই সেখানে বেড়াতে যেতাম, আমার সবচেয়ে পছন্দের কাজ ছিল বউ সাজানো। এই সুযোগটা কোনোভাবেই হাতছাড়া করতাম না।'

বর্ণনাও দিলেন সোনালি সেই সব দিনের, 'সে সময় বউ সাজানোতে ব্যবহৃত হতো লাল টিপ, কপালে আর গালে আলপনা করা হতো স্নো ক্রিম দিয়ে।'

রূপসজ্জায় যার এতো আগ্রহ সেই আতিয়া নিজে সেভাবে সাজেন না। তার আগ্রহ শুধু অন্যকে সাজানো। অন্যকে সাজিয়েই আনন্দ পান তিনি।

‘কারাগার’ সিরিজের জন্য চঞ্চল চৌধুরীর মেকআপ করছেন আতিয়া
‘কারাগার’ সিরিজের জন্য চঞ্চল চৌধুরীর মেকআপ করছেন আতিয়া। ছবি: সংগৃহীত

মেকআপকে পেশা হিসেবে নিতে গিয়ে বেশি কিছু প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হন আতিয়া। বলছিলেন, 'ভাবলাম প্রফেশনাল দক্ষতা নিয়েই মাঠে নামব। দুঃখজনক বিষয় হলো বাংলাদেশে মেকআপ শেখানোর কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। এমনকি কলকাতায়ও কিছু খুঁজে পেলাম না। পেলাম মুম্বাইয়ে। অবশেষে মুম্বাই গিয়ে বেসিক ট্রেনিংটা সেরে ফেললাম।'

শুরুতেই আতিয়ার কাজের ধরন শোবিজের নির্মাতারা খুব পছন্দ করলেন। একে একে কাজের চাপ বাড়তে থাকে তার। বিজ্ঞাপনচিত্র আর টেলিভিশনের কাজ করে ভালোই চলছিল, তবে আতিয়ার লক্ষ্য ছিল সুদূরপ্রসারী। বরাবরই নতুন কিছু শেখার প্রতি তার ঝোঁক। সুযোগ করে প্রস্থেটিক মেকআপের কায়দা-কানুনও রপ্ত করেন মুম্বাইয়ের ইনস্টিটিউট থেকে।

অনেকের ধারনা, শুধু সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজটাই করেন মেকআপশিল্পীরা। আতিয়া সৌন্দর্য বৃদ্ধি যেমন করেন, তেমনি প্রয়োজনে সৌন্দর্যহানিও করেন। ক্ষেত্রবিশেষে বীভৎসও করে তোলেন। শোবিজে তার প্রমাণ রেখেছেন ভুরি ভুরি।

২০২০ সালে তানিম নূরের ওয়েব সিরিজ 'একাত্তর' দিয়ে ওটিটিতে অভিষেক হয় আতিয়ার। সেই কাজের মধ্য দিয়ে এক নতুন মাত্রা তৈরি হয় তার ক্যারিয়ারে, আর বয়ে আনে প্রশংসাও।

আতিয়া বলেন, 'বিজ্ঞাপনে কিন্তু আমি ভালোই করছিলাম, আয়ও হচ্ছিল বেশ। কিন্তু ওটিটিতে কাজের পর পরিচিতিটা বেড়েছে।'

গত তিন বছরে ওটিটিতে আলোচিত সিনেমা-সিরিজের সিংহভাগেই যুক্ত হয়েছে আতিয়ার নাম। 'বলি', 'লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলমেন', 'কাইজার', 'দুই দিনের দুনিয়া', 'ওভার ট্রাম্প', 'মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন', 'ভাইরাস' ও 'সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি'র মতো আলোচিত ও প্রশংসিত সব প্রজেক্টের মেকআপশিল্পী আতিয়া। সামনে আসছে ওয়েব ছবি 'কাছের মানুষ দূরে থুইয়া'।

মেকআপ-বিষয়ক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কথা আলোচনায় আসতেই হতাশার কথা জানান এই শিল্পী, 'দেশে প্রপার কোনো প্রতিষ্ঠান না থাকায় ভালো মেকআপ আর্টিস্ট তৈরি হওয়াটাও বেশ কঠিন। নারীদের জন্য আরও কঠিন। প্রথমত মানুষ ভালো দৃষ্টিতে দেখে না। আর নিজেকে প্রমাণ করতেও সময় লাগে।'

তবে আশার আলোও দেখেন আতিয়া, 'মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি যে পাল্টাচ্ছে তা আমি টের পাই। বিশেষ করে যে সব অভিনয়শিল্পী, পরিচালক বা টিমের সঙ্গে আমি কাজ করেছি, তারা এ ক্ষেত্রে বেশ ভূমিকা রেখেছে।'

এই পেশায় যারা আছেন তাদের সিংহভাগই পুরুষ। এ কারণে 'মেকআপম্যান' বলতেই সবাই অভ্যস্ত। আতিয়া বলেন, 'শুধু বাংলাদেশে না, ভারতেও পুরুষ মেকআপ আর্টিস্টের সংখ্যাই বেশি। তবে এখন অনেক নারীই আসছেন এই পেশায়। আমি আশাবাদী কোনোদিন হয়তো আমরা মেকআপ ডিরেক্টরের পদটাও দেখব।'

আতিয়ার দাবি, বাংলাদেশে তিনিই প্রথম পেশাদার প্রস্থেটিক মেকআপশিল্পী। শুধু তাই নয় বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন জগতেও তিনিই প্রথম নারী মেকআপশিল্পী।

আতিয়ার এই পথচলায় তিনজনের ভূমিকা বেশ প্রবল। তাদের কথা বলে আড্ডা শেষ করলেন তিনি। তারা হলেন—আতিয়ার মা, বোন আশফিকা রহমান আর কাছের বন্ধু সিমন প্লুটা। তারা সবসময়ই আতিয়ার পাশে ছিলেন, আশ্বাস যুগিয়েছেন। 'তারা না থাকলে আমার এতদূর আসাই হতো না। আমার সব অর্জনের ভাগ তাদেরও।'

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

6h ago