উত্তরের ‘পাথরের খনি’ এখন পর্যটনের নতুন গন্তব্য
ভারত সীমান্তবর্তী দেশের সবচেয়ে উত্তরের জেলা পঞ্চগড় মূলত কৃষির পাশাপাশি নুড়ি পাথরের জন্য সুপরিচিত ছিল। সামান্য গভীরতায় মাটি খুঁড়ে পাওয়া পাথর এ জেলার গ্রামীণ অর্থনীতির মেরুদণ্ড। হাজার হাজার একর কৃষি জমি ও বসতবাড়ির নিচে পাথরের 'খনি'। তবে জেলার মানুষের কাছে তা এখন অতীত।
গত তিন দশকে পঞ্চগড়ের অর্থনীতিতে এসেছে অনেক পরিবর্তন। জেলার অর্থনীতি এখন আর পাথর তোলায় সীমাবদ্ধ নেই। এটি এখন পর্যটন ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। সারাদেশ থেকে টানছে পর্যটক।
দীর্ঘদিন ধরে সীমিত অবকাঠামো ও ঢাকা থেকে অনেক দূর হওয়ায় ব্যবসায়ী বা দর্শনার্থীদের কাছে পঞ্চগড় যেন ছিল 'দূরের দেশ'। গত তিন দশকে উন্নত সড়ক যোগাযোগ জেলায় পর্যটন সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
তিন দিক থেকে ভারতবেষ্টিত পঞ্চগড়ের অনন্য ভৌগলিক সৌন্দর্য সারাদেশ থেকে টানছে দর্শনার্থীদের। এখানকার শীত পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় মৌসুম। এখানে শীত আসে অনেক আগে, যায়ও দেরিতে। শীতে এই জেলার তাপমাত্রা পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে যায়। বিশেষ করে তেঁতুলিয়ায়।
জেলার সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটনের একটি বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য। তেঁতুলিয়া থেকে প্রায় ১৬০ কিলোমিটার দূরে থাকলেও অক্টোবর-নভেম্বরে আকাশ পরিষ্কার থাকলে জেলার অনেক জায়গা থেকে এর তুষারাবৃত চুড়া দেখা যায়। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক এই দৃশ্য দেখতে মহানন্দার তীরে আসেন।
পর্বতের দৃশ্য ছাড়াও পঞ্চগড় এখন আরেকটি অনন্য দৃশ্যের জন্য পরিচিত। তা হলো—টিউলিপ বাগান। অনুকূল আবহাওয়া কৃষকদের এই ফুল চাষে আগ্রহী করেছে।
২০২২ সালে প্রথম টিউলিপ ফোটার পর থেকে বাগানগুলো দেশের পর্যটকদের আকৃষ্ট করছে।
বেশ কয়েক দশকে জেলার অর্থনীতি পাথর তোলা থেকে বদলে গেছে চা চাষে। পঞ্চগড় দেশের একমাত্র জায়গা যেখানে সমতল ভূমিতে চা বাগান আছে। ১৯৯০'র দশকে এ জেলায় শুরু হয় চা চাষ। এখন তেঁতুলিয়াসহ জেলাজুড়ে প্রায় ১০ হাজার একর বিস্তৃত চা বাগান আছে। এ ছাড়াও, আছে প্রায় ৫০টিরও বেশি টি এস্টেট।
এখানকার চা বিশ্বমানের। অর্গানিক চা উৎপাদনকারী হিসেবে পঞ্চগড়ের পরিচিতি বেড়েছে।
যদিও এখন আর মাটি খুঁড়ে পাথর তোলা হয় না। তবুও নদী থেকে পাথর ও বালু তোলা জেলার অর্থনীতির অংশ। এর সঙ্গে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের জীবিকা জড়িত। তবে জেলার অর্থনীতি এখন পর্যটন, চা ও আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্যের দিকে চলে গেছে।
নদী থেকে সংগ্রহ করা বালি, বিশেষ করে ভজনপুরের সূক্ষ্ম বালি দেশের নির্মাণ কাজে ব্যবহার করা হয়।
দেশের একমাত্র শিলা জাদুঘর পঞ্চগড়ে। ১৯৮৪ স্থাপিত এই জাদুঘরে প্রাগ-ঐতিহাসিক পাথর রাখা আছে। এটি এই জেলার সাংস্কৃতিক গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। এই জাদুঘরে আছে নানান গ্রামীণ নিদর্শনও।
মির্জা শাহ মসজিদ, গোলোকধাম মন্দির ও ভিতরগড়ের ধ্বংসাবশেষসহ বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক স্থান এই জেলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে।
খুলনা থেকে বন্ধুদের নিয়ে তেঁতুলিয়ায় আসা আতিকুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তিনি গত পাঁচ বছরে তিনবার এখানে এসেছেন মূলত কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্য দেখতে।
ঢাকা থেকে সরাসরি বাসে পঞ্চগড় আসতে এখন প্রায় আট থেকে ১০ ঘণ্টা লেগে যায়। ঢাকা থেকে ট্রেনেও আসা যায় এই জেলায়।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পঞ্চগড়ের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এখনো লুকানো রত্নের মতো। এই জেলার পর্যটনের সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগাতে সরকারের আরও সহযোগিতা প্রয়োজন।'
Comments