আবাসন খাতে এখনো থাকছে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ

গণঅভ্যুত্থান, আবাসন খাত, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, কালো টাকা, টিআইবি,

সম্প্রতি নগদ অর্থ, বন্ড বা সিকিউরিটিজ, আমানত, আর্থিক স্কিম ও যন্ত্রপাতিসহ সম্পদের ওপর ১৫ শতাংশ কর দিয়ে অবৈধ আয়কে বৈধ করার বিধান বাতিল করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তবে ফ্ল্যাট ও জমি কেনার ক্ষেত্রে কালো টাকা সাদা করার বিধান বাতিল করেনি কর প্রশাসন।

তাই এক্ষেত্রে কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি না হয়ে অবৈধ আয় বা কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ থেকে গেছে। কর প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তকে সমালোচনা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

গত মাসে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে অবৈধ আয়ের জন্য দেওয়া সাধারণ ক্ষমা প্রত্যাহারের দাবি ওঠে সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে। ওই দাবির প্রেক্ষাপটে সাধারণ ক্ষমার নিয়ম বন্ধ করে এনবিআর।

কিন্তু সম্পত্তির আকার ও অবস্থানের ওপর নির্ভর করে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর পরিশোধ করে রিয়েল এস্টেট (ফ্ল্যাট, বিল্ডিং ও জমি) খাতে বিনিয়োগ করলে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখে রাজস্ব প্রশাসন।

এজন্য ঢাকার গুলশান, বনানী, মতিঝিল, তেজগাঁও, ধানমন্ডি ও শাহবাগে জমি খাতে বিনিয়োগে প্রতি বর্গমিটারে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা কর নির্ধারণ করা হয়। অন্যদিকে ফ্ল্যাট ও স্থাপনা কেনার জন্য প্রতি বর্গমিটারের জন্য কর নির্ধারণ করা ছয় হাজার টাকা।

এনবিআর সূত্র জানায়, অন্তর্বর্তী সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে কর প্রশাসন ১৫ শতাংশ কর দিয়ে অবৈধ নগদ টাকা, সিকিউরিটিজ ও আমানতকে বৈধ করার বিধান বাতিল করা হয়েছে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'যখন শুনলাম পুরো নিয়মটি বাতিল করা হচ্ছে, তখন মনে হয়েছিল এটি একটি ভালো সিদ্ধান্ত। এটিকে 'নতুন বাংলাদেশ' রূপকল্পে বৈষম্যবিরোধী মূল চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হয়েছিল।'

তিনি বলেন, 'তবে রিয়েল এস্টেটের মতো কোনো খাত বা উপখাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একই বিধান রাখার ক্ষেত্রে যদি অপারেশনাল পর্যায়ে কোনো ফাঁকফোকর থেকে যায় তা হবে অত্যন্ত হতাশাজনক।'

'তার মানে বৈষম্য অব্যাহত থাকবে, কারণ এ ধরনের সুযোগের মানে হলো কালো টাকার মালিকদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার পরিবর্তে পুরস্কৃত করা হবে,' বলেন তিনি।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'এর অর্থ এটাও দাঁড়ায় যে, অবৈধ আয়ের মানুষদের বৈষম্যমূলক সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে এসব খাতে তাদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ আরও মজবুত হবে। বিপরীতে সৎ উপার্জনকারীদের জন্য এ খাতগুলো আরও প্রতিবন্ধক হয়ে উঠবে।'

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, 'বাস্তবে এই সিদ্ধান্তটি দুর্নীতির জন্য উৎসাহব্যঞ্জক হবে, যা অন্তর্বর্তী সরকারের করা উচিত হবে না।'

তিনি দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের সত্যিকার চেতনায় বিষয়টি পর্যালোচনার আহ্বান জানান।

এসএমএসি অ্যাডভাইজরি সার্ভিসেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলেন, 'যদি অবৈধ সম্পত্তিকে বৈধ করার সুযোগ বাতিল করার উদ্দেশ্যে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো, তাহলে আংশিক প্রত্যাহারের প্রস্তাব না দিয়ে তা পুরোপুরি প্রত্যাহার করা উচিত ছিল।'

তিনি বলেন, 'এই নিয়মের অধীনে জমি ও অ্যাপার্টমেন্টের জন্য এই জাতীয় স্বেচ্ছাসেবী প্রবেশের সুযোগ এখনো আছে। যার অর্থ আমরা সম্পূর্ণ সাধারণ ক্ষমার বিধানসহ রিয়েল এস্টেটে অবৈধ সম্পদকে স্বাগত জানাচ্ছি।'

২০২০-২১ অর্থবছর থেকে পরপর দুই বছর আয়ের উৎস নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি না হয়ে করদাতাদের অপ্রদর্শিত সম্পদ বৈধ করার সুযোগ দিয়েছে এনবিআর।

ফ্ল্যাটে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে করদাতারা নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিলে সম্পত্তির আকার ও অবস্থানের ওপর নির্ভর করে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর পরিশোধ করলে কর্তৃপক্ষ অর্থের উৎস বিবেচনা করবে বলেও বিধান রাখা হয়েছে।

চলতি অর্থবছরের জন্যও এ বিধান বহাল রাখা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, 'বিষয়টি পর্যালোচনার পর মন্তব্য করতে পারবো। যদি কেউ অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করে ও কোনো এজেন্সি তার উৎস জানতে না চাইতে পারে, তাহলে এ ধরনের বিধান থাকার কথা নয়।'

তিনি বলেন, 'ফ্ল্যাট ও জমি ক্রয়ে অবৈধ অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ নতুন নয়। বছরের পর বছর ধরে এটি চলে আসছে। সেক্ষেত্রে করের হার বেশি থাকে।'

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'মৌজার ওপর নির্ভর করে জমিসহ সম্পত্তির একটি সরকারি হার রয়েছে।'

কিন্তু বাস্তবে সরকারিভাবে নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি দামে সম্পত্তি হাতবদল হয়। এই অসঙ্গতি বিপুল পরিমাণ অপ্রদর্শিত সম্পদ তৈরি করে।

তিনি বলেন, 'সরকারকে এমন একটি উপায় খুঁজে বের করতে হবে, যেন ক্রেতা-বিক্রেতারা সম্পত্তির হস্তান্তর মূল্য দেখাতে পারেন।'

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে অন্তত ২২ বার অবৈধ অর্থ বৈধ করার স্কিম চালু হয়েছে। কিন্তু তাতে সাড়া মেলেনি।

এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪৫ হাজার ৫২২ কোটি টাকা সাদা করা হয়েছে, যেখানে তারা মোট ৪ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা কর পেয়েছে।

২০২০-২১ অর্থবছরে রেকর্ড ২০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা সাদা করা হয়েছে। এখান থেকে এনবিআর ২ হাজার ৬৪ কোটি টাকা কর পেয়েছে।

এর আগে, ২০০৬-০৭ অর্থবছরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার জরিমানা পরিশোধের পর কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ দেয়। ওই বছর ৯ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা সাদা করা হয়।

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh inflation rate drops in April

Few steps to cut inflation-induced poverty

High inflation has become the bane of low-income people’s existence for the better part of the past two years as spiralling prices have dramatically eaten away at their purchasing power.

16h ago