সরকারের রাজস্ব আয়-ব্যয়ের তথ্যে গরমিল থাকছেই

দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রাজস্ব আদায়ের হিসাবে পার্থক্য প্রায় ১১ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা।
সরকারি তথ্যে গড়মিল
অলঙ্করণ: আনোয়ার সোহেল/স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

সাম্প্রতিক মাসগুলোয় রপ্তানি তথ্যে গরমিল দূর করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নিলেও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের তথ্যে অসঙ্গতি থেকেই যাচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে—গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিলে কর আদায় হয়েছে দুই লাখ ৭৭ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) জানিয়েছে, তারা আদায় করেছে দুই লাখ ৮৯ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা।

অর্থাৎ দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রাজস্ব আদায়ের হিসাবে পার্থক্য প্রায় ১১ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা।

এমন চিত্র নতুন নয়। অর্থ মন্ত্রণালয় ও রাজস্ব বোর্ডের তথ্যে দেখা গেছে—গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিলে কর আদায়ে ফারাক ছিল চার হাজার ৩১ কোটি টাকা।

কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অর্থ মন্ত্রণালয় সাধারণত হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের (সিজিএ) কার্যালয়ের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কর আদায়ের হিসাব করে। কর প্রশাসন বকেয়া বিবেচনায় নিয়ে রাজস্ব আদায়ের হিসাব করে।

এটি দুই প্রতিষ্ঠানের তথ্যের ব্যবধানের একটি বড় কারণ।

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) খরচের তথ্যেও একই ধরনের অসঙ্গতি দেখা যায়।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো খরচ করেছে এক লাখ ২৫ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা।

'গত কয়েক বছরে ডেটা গভর্নেন্স বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে' উল্লেখ করে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) প্রধান অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যদি প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, রপ্তানি, রাজস্ব আয় ও খরচের প্রাক্কলনের দিকে তাকাই, তাহলে দেখা যাবে তথ্যের অসামঞ্জস্যতা বেশ স্পষ্ট।'

অন্যদিকে অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, একই সময়ে মোট খরচ হয়েছে ৯২ হাজার ১২৬ কোটি টাকা। এটি আইএমইডির হিসাবের তুলনায় ৩৩ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা কম।

এটিও কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে বার্ষিক উন্নয়ন খরচের ক্ষেত্রে আইএমইডি ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে পার্থক্য ছিল ৪১ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা।

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এ ধরনের অসঙ্গতি রাজস্ব ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় বড় সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অর্থ মন্ত্রণালয় যদি খরচের প্রকৃত তথ্য না পায়, তাহলে ঋণ পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হয়। খরচের হিসাব যদি ভুল বা অতিরঞ্জিত হয়, তাহলে এর ওপর ভিত্তি করে আমরা যে পরিকল্পনা করব তা দুর্বল হবে।'

তার মতে, 'এটা অনেকটা চোখ বন্ধ করে গাড়ি চালানোর মতো। খাদে পড়ে যেতে পারেন।'

তার মতে, সিজিএ'র তথ্য বেশি নির্ভরযোগ্য কেননা এটি মাঠ থেকে নেওয়া। তথ্যের অসঙ্গতি দূর করতে তিনি ডেটা কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা-শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের বরাত দিয়ে তিনি আরও বলেন, 'এখানে দুই ধরনের ত্রুটি আছে। একটি ইচ্ছাকৃত। সরকারের ভাবমূর্তি বাড়াতে সাধারণত তথ্য হেরফের করা হয়। আরেকটি অনিচ্ছাকৃত, যা হিসাবে ভুলের কারণে হতে পারে।'

তার ভাষ্য, 'যদি তথ্য বসাতে গিয়ে অনিচ্ছাকৃত ভুল হয় তাহলে আসল হিসাব বদলে যাবে। ইচ্ছাকৃত ভুল থাকলে তা বন্ধ করা দরকার।'

গত এপ্রিলে বাংলাদেশ ব্যাংক জানতে পারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিলে রপ্তানি ব্যুরোর তথ্য প্রকৃত রপ্তানি তুলনায় প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার কম।

'গত কয়েক বছরে ডেটা গভর্নেন্স বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে' উল্লেখ করে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) প্রধান অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যদি প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, রপ্তানি, রাজস্ব আয় ও খরচের প্রাক্কলনের দিকে তাকাই, তাহলে দেখা যাবে তথ্যের অসামঞ্জস্যতা বেশ স্পষ্ট।'

তার ভাষ্য, এটি এমন বিষয় যা সরকারকে অবশ্যই দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করতে হবে। সামষ্টিক অর্থনীতি ও মূল আর্থিক সূচকগুলোর সঠিক চিত্র ছাড়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা খুব জটিল।

'ডেটা গভর্নেন্সে জোর দিলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাও ভালো হবে। এটি রপ্তানি তথ্য, মুদ্রাস্ফীতি ও প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সত্য। এটি রাজস্ব আয়-ব্যয়ের মতো অভ্যন্তরীণ তথ্যের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।'

ডেটা গভর্নেন্স অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার হয়ে উঠবে বলে আশা করে তিনি আরও বলেন, 'এটি ছাড়া অর্থনীতির বর্তমান অবস্থার সঠিক চিত্র পাবো না।'

এনবিআরের নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ইতোমধ্যে এনবিআর, সিজিএ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে সমন্বিত পরিসংখ্যান বজায় রাখতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।'

'স্পষ্ট করে বলেছি, ম্যানুয়ালি করা পরিসংখ্যান আমি গ্রহণ করব না। তিনটি পরিসংখ্যান একই হবে।'

অসামঞ্জস্যতার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'বকেয়া পাওনার কারণে এমনটি হয়ে থাকতে পারে।'

আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মহিউদ্দিনকে মুঠোফোনে পাওয়া যায়নি।

আইএমইডি কর্মকর্তারা এর আগে বলেছিলেন, মন্ত্রণালয় ও বিভাগের তথ্যের ভিত্তিতে তারা বার্ষিক উন্নয়ন খরচের হিসাব করেন। অর্থ মন্ত্রণালয় সিজিএর তথ্যের ভিত্তিতে তা করে থাকে।

Comments