তীব্র তাপপ্রবাহে বিপাকে মুরগি খামারিরা
সাভারের কলমা এলাকার বাসিন্দা আকরাম হোসেন রিপন একজন মুরগি খামারি। বাজারে ভালো দাম থাকায় লাভের আশায় তিনি খামারে এক হাজার লেয়ার মুরগি তুলেছিলেন। কিন্তু এই খামারির আশাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে চলমান তীব্র তাপপ্রবাহ।
দেশজুড়ে চলা তাপপ্রবাহে তার খামারে মোট ১৬০টি মুরগি মারা গেছে। তাই লাভের আশা করলেও আকরাম হোসেনকে এখন লোকসান গুনতে হচ্ছে।
তিনি জানান, তার ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। কয়েক বছর ধরে মুরগির খামার করলেও আগে কখনো এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি।
আকরাম হোসেন বলেন, 'খাবারের দাম বাড়তি, ২৪ ঘণ্টা জেনারেটের চালু রেখেছি, ওষুধ দিতে হয়েছে, বাড়তে শ্রমিক খরচ। এর মধ্যে আবার এতগুলো মুরগি মারা গেল। সব মিলিয়ে বেশ অস্বস্তিতে আছি।'
'আজকেও (গতকাল) এক ব্যবসায়ী লেয়ার মুরগি দিতে কল করেছিল। পরে বলেছি আবহাওয়া ঠিক হোক, তারপর খামারে মুরগি তুলব। গত বছরও প্রায় এক লাখ টাকা লস হয়েছিল। এবারও ইতোমধ্যে বড় অঙ্কের ক্ষতি হলো,' বলেন তিনি।
আকরাম হোসেন রিপন নয়, চলতি মাসের শুরু থেকে টানা তাপপ্রবাহ ও লোডশেডিংয়ের কারণে দেশের অনেক খামারি এই পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন। খামারে প্রতিদিনই মারা যাচ্ছে শত শত মুরগি। অনেক খামারি লোকসান করে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার কথাও ভাবছেন।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার দাবি করেছেন, তীব্র তাপপ্রবাহে গত ১০ দিনে দেশের প্রান্তিক খামারিদের প্রায় ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, 'এখনকার আবহাওয়া মুরগির জন্য অসহনীয়। গড়ে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ মুরগি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।'
তিনি বলেন, 'স্বাভাবিকভাবে মুরগির জন্য আদর্শ তাপমাত্রা হলো ২২ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যখন তা ৩০ ডিগ্রি অতিক্রম করে, তখনই মুরগির শ্বাস নিতে সমস্যা হয়। এতে মুরগি দুর্বল হয়ে যায় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে বিভিন্ন ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। এ কারণে বর্তমানে অনেক মুরগি মারা যাচ্ছে।'
তিনি আরও বলেন, 'চলমান পরিস্থিতিতে মুরগিরা খাবার খাচ্ছে কম। এতে ডিম উৎপাদন কমে যাচ্ছে, শেপও নষ্ট হচ্ছে। ওপেন হাউজে মরটালিটি রেট বেশি। তবে এনভায়ারমেন্ট কন্ট্রোল হাউজে মরটালিটি রেট কম।'
খামারিরা বলছেন, গত কয়েক দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে তীব্র তাপপ্রবাহে ব্রয়লার মুরগি হিটস্ট্রোকে মারা গেছে। এতে ডিম উৎপাদনও কমছে। ফলে আগামীতে ডিম ও মুরগির দাম আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
গাজীপুরের কাপাসিয়ার কেন্দুয়াব গ্রামের খামারি মাইন উদ্দিন জানান, তার খামারে এক হাজার লেয়ার মুরগি রয়েছে। এর মধ্যে গত মঙ্গলবার ও বুধবার এই দুদিনে ১২টি মুরগি মারা গেছে।
তিনি বলেন, 'এক সপ্তাহ আগে আমার ফার্ম থেকে প্রতিদিন ৯০০ পিস ডিম উৎপাদন হতো। কিন্তু তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মুরগিরা ঠিকমত খাবার খাচ্ছে না। এ কারণে ডিম উৎপাদনও কমে গেছে। বর্তমানে প্রতিদিন ৬০০ থেকে ৬৫০ পিস ডিম উৎপাদন হচ্ছে।'
ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, 'স্বাভাবিকভাবে মুরগির জন্য আদর্শ তাপমাত্রা হলো ২২ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যখন তা ৩০ ডিগ্রি অতিক্রম করে, তখনই মুরগির শ্বাস নিতে সমস্যা হয়। এতে মুরগি দুর্বল হয়ে যায় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে বিভিন্ন ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। এ কারণে বর্তমানে অনেক মুরগি মারা যাচ্ছে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। অনেক কষ্ট করে এ ব্যবসা দাঁড় করেছি। কিন্তু দিন দিন লোকসান গুনতে গুনতে এখন আর কোনো আশা দেখছি না।'
বরিশালের উজিরপুরের জল্লা ইউনিয়নের খামারি নিখিল চন্দ্র বিশ্বাস জানান, গত দুই দিনে ১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না, এতে তার খামারের ১৫টি মুরগি মারা গেছে। ফলে তার ৫ হাজার ২০০ টাকা ক্ষতি হয়েছে।
তিনি আরও জানান, খামারে তার প্রায় সাত লাখ টাকা বিনিয়োগ করা। কিন্তু তীব্র গরম ও লোডশেডিং তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ রেয়াজুল হক বলেন, 'দেশে যখন তীব্র গরম শুরু হয়, তখনই খামারিদের সতর্ক করা হয়। এই পরিস্থিতিতে তাদের কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে তা জানানো হয়। যারা সেই নির্দেশনা মেনে চলেছেন, তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। যারা মানছেন না, তারাই ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।'
এদিকে, শনিবার পর্যন্ত তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে বলে সতর্ক করেছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর।
চলতি বছরের ২১ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় বাংলাদেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ওই দিন জেলায় গড় তাপমাত্রা ছিল ৩৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এল নিনোর কারণে তীব্র তাপপ্রবাহ তৈরি হয়েছে, যা বর্তমানে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে প্রভাব ফেলছে।
Comments