অস্থিতিশীলতা ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেকর্ড ৮.৩৭ বিলিয়ন ডলার বিক্রি

বাংলাদেশ ব্যাংক
বাংলাদেশ ব্যাংক। ছবি: সংগৃহীত

বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে চলতি অর্থবছরের ৭ মাসেরও কম সময়ে ব্যাংকিং খাতে রেকর্ড ৮ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

স্থানীয় ব্যাংকগুলোর কাছে গত অর্থবছরে ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছিল বাংলাদেশে ব্যাংক।

অর্থনীতিবিদদের শঙ্কা, এক্সচেঞ্জ রেট ও ঋণের হারের সীমা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবস্থান অটুট থাকলে মার্কিন ডলার বিক্রির এই গতিও অব্যাহত থাকবে, এমনকি তা আরও বাড়তে পারে।

মার্কিন ডলারের এই রেকর্ড বিনিয়োগ বৈদেশিক মুদ্রার চলমান অস্থিরতা কমাতে খুব কম অবদান রেখেছে। বিশ্বব্যাপী পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে আমদানি খরচ বেড়েছে। ফলে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত হ্রাস পেয়ে এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

রিজার্ভ গতকাল পর্যন্ত ৩২ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার ছিল, যা আগের বছরের তুলনায় ২৮ দশমিক ১৬ শতাংশ কম।

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি বাজারকে ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার নির্ধারণ করতে না দেয় এবং ঋণের ওপর ৯ শতাংশ সুদের হারের সীমা তুলে না নেয়, তাহলে রিজার্ভ আরও কমতে পারে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে অবস্থান নিয়েছে, তা এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে আরও প্রকট করবে। বাজারভিত্তিক এক্সচেঞ্জ রেট চালু না করলে বাজারে বিপুল পরিমাণ ডলার বিনিয়োগ ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।'

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক এই অর্থনীতিবিদ উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, 'গত ১০ মাসে উচ্চ মূল্যস্ফীতি সত্ত্বেও ঋণগ্রহীতা ও জনগণের একটি অংশের মধ্যে পণ্যভোগের চাহিদা এখনো বেশি।'

তিনি আরও বলেন, 'সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আমদানি কিছুটা কমে যাওয়ায় চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু বাজারভিত্তিক এক্সচেঞ্জের অনুমতি দেওয়া হলে স্থানীয় মুদ্রার আরও অবমূল্যায়ন হবে, যা চাহিদা কমাতে সহায়ক হবে।'

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ১০৭ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে টাকার মান কমেছে ২৪ দশমিক ৪১ শতাংশ।

কিন্তু, মনসুর এতে একমত হননি। তিনি বলেন, 'বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে টাকার প্রকৃত অবমূল্যায়নের হার আর বেশি। ব্যাংকগুলো ১১৫ টাকা দরে মার্কিন ডলার কিনছে। বাজারে এটি ১০৬ বা ১০৭ টাকা নয়।'

তিনি বলেন, 'হঠাৎ করে টাকার আবার অবমূল্যায়ন হতে পারে। এই ধরনের ঝুঁকির নিয়েই অর্থনীতি এগোচ্ছে।'

এর আগে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও আমদানি বিল নিষ্পত্তির জন্য ব্যাংকগুলোতে মার্কিন ডলারের ঘাটতি দেখা দেওয়ায় তা কার্যকর হয়নি। ফলে, গত কয়েক মাসে টাকার মূল্য কমপক্ষে ২০ শতাংশ কমেছে।

কিন্তু, বাজারকে ডলার এক্সচেঞ্জ রেট নির্ধারণের অনুমতি দেওয়া হলে হয়তো এ ধরনের অবমূল্যায়ন ও রিজার্ভের ক্ষয় এড়ানো যেত।
উচ্চ রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রাপ্তি এই মুহূর্তে ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।

'টাকা-ডলারের বিনিময় হারের নমনীয়তা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অর্থপাচার মোকাবিলায় সহায়তা করবে', বলেন আহসান এইচ মনসুর।

ঋণের ওপর ৯ শতাংশ সুদের হার প্রত্যাহার বাংলাদেশ ব্যাংকের তহবিল বাড়ানোর আরেকটি হাতিয়ার হতে পারে এবং তা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারে।

মনসুরের মতে, ২০২০ সালের এপ্রিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন এই সীমা আরোপ করেছিল, তখন প্রধান প্রধান উন্নত দেশগুলোতে সুদের হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ।

কিন্তু, উন্নত দেশগুলোতে এই হার সম্প্রতি ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে গেলেও বাংলাদেশে এখনো ৯ শতাংশের মধ্যে আটকে আছে।
তিনি বলেন, 'এটা পুরোপুরি অযৌক্তিক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত বৈশ্বিক প্রবণতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সুদের হার সমন্বয় করা। তা না হলে মানুষ কেন তাদের অর্থ বাংলাদেশে আনবে?'

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনও বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে শৃঙ্খলা ফেরাতে একাধিক বিনিময় হার প্রত্যাহারে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান।

বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সমন্বিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রপ্তানিকারকরা ব্যাংক থেকে প্রতি মার্কিন ডলারের জন্য সর্বোচ্চ ১০২ টাকা পেতে পারবেন। ব্যাংকগুলো বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে রেমিট্যান্সের প্রতি ডলার ১০৭ টাকায় কিনতে পারবে।

আমদানিকারকরা ওয়েটেড এভারেজ এক্সচেঞ্জ রেট প্লাস ১ টাকার ওপর ভিত্তি করে ডলার কিনবেন।

জাহিদ হোসেন বলেন, 'যদি বাজারভিত্তিক এক্সচেঞ্জ রেটের অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলে তা বাজারে অস্থিতিশীলতা কমাতে সহায়তা করবে।'

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান ডেইলি স্টারকে জানান, ডলার ঘাটতির কারণে তার ব্যাংকের লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খোলার সক্ষমতা কমে গেছে। আসন্ন রমজান মাসে চাহিদা মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য এলসি খোলার কথা বললেও পর্যাপ্ত ডলার না থাকায় তা পুরোপুরি মেনে চলা তাদের পক্ষে কঠিন।

আইএমএফের সঙ্গে বাংলাদেশের সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হয়েছে, যা আগামী ৩০ জানুয়ারি আইএমএফের চূড়ান্ত অনুমোদন পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এটি দেশকে কিছুটা স্বস্তি এনে দিতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেছেন, রেমিট্যান্স প্রবাহ কম থাকা, একইসঙ্গে আমদানি হ্রাস পাওয়া ও রপ্তানি আয় কিছুটা বাড়ার পরেও পরিস্থিতির তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।

চলতি অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে আমদানি পরিশোধের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩২ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ৪ দশমিক ৪১ শতাংশ বেশি। এ সময়ে রপ্তানি ১১ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়ে ২০ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার এবং রেমিট্যান্স ২ দশমিক ১৪ শতাংশ বেড়ে ৮ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার হয়েছে।

২০২৩ অর্থবছরে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ অনুমান করা হয়েছে, যা আগে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছিল ১৩ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে যথাক্রমে ৩৩ দশমিক ৪ শতাংশ ও ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ।

২০২৩ অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহে প্রবৃদ্ধি মাত্র ৪ শতাংশের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।

Comments